ত্রিপুরার প্রত্নভূমিতে রামায়ণের প্রভাব
পান্নালাল রায়
ভারতবর্ষ সহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রামায়ণের বিরাট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।এর মধ্যে কোনও কোনও দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির অন্যতম উৎস হচ্ছে রামায়ণ। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে যেমন রামায়ণ বহুল চর্চিত,সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য উপকরণ,তেমনই ব্যতিক্রম নয় উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্য ত্রিপুরাও।সুদূর অতীত কাল থেকেই ত্রিপুরার লোক জীবনে যে রামায়ণের প্রভাব রয়েছে তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে রাজ্যের নানা প্রত্ন সম্পদ আর ইতিহাসের উপাদানে। এই রাজ্যে লোক সংস্কৃতির ধারাও রামায়ণ চর্চার সাক্ষ্য বহন করছে।
ত্রিপুরা খুবই প্রাচীন এক রাজ্য। সমুদ্র গুপ্তের শিলালিপিতেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়।প্রাচীন কালে এই রাজ্যের আয়তনও ছিল বিরাট। ত্রিপুরার রাজাদের ইচ্ছা ও নির্দেশে রচিত হয়েছিল 'রাজমালা'।মূলত রাজা ও রাজবংশের গুণকীর্তন নির্ভর কাব্যগাঁথা হলেও 'রাজমালা'তে বর্ণিত পঞ্চদশ শতকের পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ ইতিহাসের সঙ্গে মোটামুটি সঙ্গতিপূর্ণ বলেই মনে করেন ঐতিহাসিকগণ।ত্রিপুরার রাজাগণ চন্দ্র বংশ উদ্ভূত বলে বর্ণিত আছে 'রাজমালা'য়।ত্রিপুরার ধর্মপ্রাণ রাজাদের কুল দেবতা হলেন চতুর্দ্দশ দেবতা।সুপ্রাচীন কাল থেকেই ত্রিপুরার রাজাদের সঙ্গে রামায়ণ ও মহাভারতের এক যোগসূত্রের কথা জানা যায়।ত্রিপুরার রাজা ত্রিলোচন যুথিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে আমন্ত্রিত হয়ে হস্তিনাপুর গিয়েছিলেন।তার অনেক পরবর্তীকালের অপর এক ধার্মিক রাজা কুমার মণু নদীর তীরে ছাম্বুলনগরে শিবের আরাধনা করেছিলেন। সুপ্রাচীন কালের ত্রিপুরা নিয়ে নানা কথা প্রচারিত থাকলেও বৈদিক যুগ থেকেই ভারতবর্ষের সঙ্গে তার সাংস্কৃতিক যোগসূত্রের কথা সুবিদিত।ত্রিপুরার মাণিক্য রাজবংশের প্রতিষ্ঠা পঞ্চদশ শতকে।তারপর থেকেই মাণিক্য রাজাদের মোটামুটি এক ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায়।কিন্তু তার আগে ত্রিপুরার 'ফা' রাজাদের সময়কালে কিংবা তারও আগে ত্রিপুরার জনজীবন ও সংস্কৃতিতে রামায়ণের প্রভাবের প্রমাণ ছড়িয়ে আছে রাজ্যের নানা প্রত্ন সম্পদে।
ত্রিপুরার ঊনকোটি শৈবতীর্থ হিসেবে পরিচিত। এখানে পাহাড়ে ছড়িয়ে আছে পাথরের নানা বিগ্রহ, আছে পাহাড়ের গায়ে পাথরে খোদাই নানা দেবদেবীর মূর্তি।ভূমিকম্প সহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে অনেক মূর্তি ইতিমধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে।কিছু আজ ধ্বংসের পথে।এই ঊনকোটিতে ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরার তদানীন্তন প্রধান মন্ত্রী ধনঞ্জয় ঠাকুর রাম-লক্ষ্মণ,রাবণ,হনুমান, রাক্ষস ও রাক্ষসী ইত্যাদি মূর্তিও দর্শন করেছিলেন বলে 'শ্রীরাজমালা'র সম্পাদক কালীপ্রসন্ন সেন বিদ্যাভূষণ তাঁর সম্পাদিত গ্রন্হটিতে(দ্বিতীয় লহর) উল্লেখ করেছেন। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত গ্রন্থটিতে তিনি লিখেছেন-"...ঊনকোটি শৃঙ্গের পশ্চিম পার্শ্বে খোদিত মূর্তি সমূহের অস্পষ্ট ও ভগ্নাবস্হা হইতে,এখনও দশমহাবিদ্যা,রাম-রাবণের যুদ্ধ এবং পূতনা বধ ইত্যাদি কতিপয় মূর্তি অতি কষ্টে চিনিয়া লওয়া যাইতে পারে।..."প্রত্ন বিশেষজ্ঞদের মতে ঊনকোটির বিগ্রহ সমূহের সৃষ্টি শুরু হয় খৃষ্টীয় অষ্টম-নবম শতাব্দীতে। অবশ্য পরবর্তী নানা সময়ে যুক্ত হয়েছে আরও শিল্পকর্ম। তা হলে দেখা যাচ্ছে,অষ্টম-নবম শতাব্দী ও পরবর্তীকালে ত্রিপুরায় রামায়ণের প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল।ঊনকোটির অশোকাষ্টমী মেলার কথাও উল্লেখ করতে হয়।এই অশোকাষ্টমীও রামায়ণের সঙ্গে যুক্ত। পুণ্যার্থী মানুষ এই তিথিতে ঊনকোটির সীতাকুণ্ডে পুণ্য অবগাহন করেন।কুণ্ডের নাম সীতা এসেছে রামায়ণ সূত্রেই।অনুরূপ ভাবে ত্রিপুরার প্রত্নভূমি পিলাকের কথাও উল্লেখ করা যায়।সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের অনুমান একদা বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির মিলন ঘটেছিল পিলাকে।পিলাকের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বিভিন্ন সময়ে নানা বিগ্রহ, প্রাচীন যুগের ইট,টেরাকোটা ফলক,পাচিলের ধ্বংসাবশেষ, মুদ্রা ইত্যাদি আবিষ্কৃত হয়েছে।প্রায় ঊনকোটির বিগ্রহ সৃষ্টি শুরুর সময়কালেই পিলাকেরও সৃষ্টিকর্ম শুরু হয়েছিল বলে মনে করা হয়।পিলাকের শ্যামসুন্দর টিলায় যেসব টেরাকোটার ফলক আবিষ্কৃত হয়েছে তাতে চিত্রিত রয়েছে পুরাণ ও রামায়ণের চিত্রকলা।শ্রীরাম,লক্ষ্মণ, হনুমান, নরসীমা,গণেশ,কার্ত্তিকেয় সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে টেরাকোটার ফলকে।পিলাকও ত্রিপুরায় রামায়ণ সংস্কৃতির প্রাচীনত্বের সাক্ষ্য বহন করছে।পিলাক ও ঊনকোটির সৃষ্টিকর্ম ত্রিপুরার মাণিক্য যুগের শত শত বছর আগেকার কথা।সেসময়ও ত্রিপুরা ছিল রামায়ণের প্রভাব পুষ্ট।
এবার আসা যাক মাণিক্য যুগের কথায়।'রাজমালা'র যুগের রাজা ত্রিলোচন বা কুমারের মতো ত্রিপুরার মাণিক্য যুগের রাজারাও ছিলেন ধর্মপ্রাণ। ত্রিপুরার রাজবংশ প্রথমে শৈব থাকলেও পরবর্তীকালে তাঁরা বৈষ্ণব ধর্মালম্বী হন।কিন্তু বৈষ্ণব হলেও শিব ও শক্তির প্রতি তারা চিরদিনই সমান আস্হাবান ছিলেন।ত্রিপুরার রাজবংশের কুলদেবতা চতুর্দ্দশ দেবতার মধ্যেও শাক্ত, শৈব ও বৈষ্ণব সকল সম্প্রদায়ের উপাস্য দেবতাই আছেন। মাণিক্য যুগের রাজাগণ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ অনুবাদ করিয়েছেন, রচনা করিয়েছেন এবং প্রজাদের মধ্যে তা প্রচারের ব্যবস্থা করেছেন। গোবিন্দ মাণিক্য (১৬৬০-৭৬ খ্রিঃ) বৃহন্নারদীয় পুরাণ বাংলাতে অনুবাদ করিয়েছিলেন। রাজা চেয়েছিলেন প্রজাদের ঘরে ঘরে এই পুঁথির প্রচার হোক। পরবর্তী সময়ে মহারাজা রাধাকিশোরের (১৮৯৬-১৯০৯ খ্রিঃ) আদেশে বৃহন্নারদীয় পুরাণের এই বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। বিশিষ্ট গবেষক ড.অঙ্কিতা দত্ত সীতানাথ দে'র একটি রচনা সূত্রে জানিয়েছেন যে,ত্রিপুরার রাজা রামগঙ্গা মাণিক্যের(১৮০৪-০৯ খ্রিঃ) পৃষ্ঠপোষকতায় শিবেন্দ্র দ্বিজ সংস্কৃতে রচনা করেছিলেন আধ্যাত্ম রামায়ণ এবং তা প্রজাদের মধ্যে প্রচার করা হয়েছিল। রাজা রামগঙ্গা মাণিক্য শ্রীরামের একনিষ্ঠ উপাসক ছিলেন।
রাজা বা রাজবংশ ছাড়াও প্রজা সাধারণ সহ সামগ্ৰিক ভাবে ত্রিপুরার জনজীবন ও সংস্কৃতিতে রামায়ণের বিরাট প্রভাব রয়েছে।ত্রিপুরার লোক জীবন রামায়ণের প্রভাব পুষ্ট। রাম পাঁচালী,রামায়ণের পালা কীর্তন ত্রিপুরায় এক সময় খুবই জনপ্রিয় ছিল।হেমন্তে ফসল তোলার পর কৃষিজীবী পরিবারের বিরাট অবসর।গা গঞ্জে বসতো তখন রামায়ণ পালা কীর্তনের আসর।দুর্গা পূজার পরও পূজা মণ্ডপের সামনে রামায়ণ গানের আসরে উপছে পড়তো ভীড়।বলাই বাহুল্য, বৈদ্যুতিন মাধ্যম আর নেট-মোবাইলের দাপটে এই অনাবিল আনন্দের সংস্কৃতি আজ যেন ক্রমেই অপসৃয়মান।ইতিমধ্যেই প্রায় হারিয়ে গেছে পটচিত্রে রামায়ণের কথা।রামায়ণের কয়েকটি কাহিনি আঁকা পটচিত্র খুলে খুলে পট শিল্পীরা গান গাইতেন বাড়ি বাড়ি ঘুরে।আজকের গ্রাম ত্রিপুরায় সে দৃশ্য বিরল।ত্রিপুরায় রামায়ণ চর্চা প্রসঙ্গে ককবরক রামায়ণের কথা অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়।অধ্যাপক প্রভাসচন্দ্র ধর প্রধানত কৃত্তিবাসী রামায়ণকে অনুসরণ করে ককবরক ভাষায় রামায়ণ রচনা করেন।দীর্ঘ সতেরো বছরের প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতে ১৯৯৭ সালে গ্রন্হটি প্রকাশিত হয়।দেশ বিদেশের বিভিন্ন ভাষায় রামায়ণ চর্চার সঙ্গে যুক্ত হয় ত্রিপুরার ককবরক ভাষাও।
সব মিলিয়ে ত্রিপুরা যে দেড় সহস্রাধিক বছর ধরে রামায়ণ চর্চার ঐতিহ্য বহন করে চলেছে তার সাক্ষ্য দেয় রাজ্যের প্রত্ন সম্পদ আর ইতিহাসের ধূসর পৃষ্ঠা।এমনকি সমাজ জীবনেও ছড়িয়ে আছে সেই ঐতিহ্যের আলোর বিচ্ছুরণ!