করোনা মোকাবেলায় এক্ষুনিই রাজ্যে ‘কমপ্লিট লকডাউন’ প্রয়োজন
জয়ন্ত দেবনাথ
করোনার কোন পজেটিভ কেইস ধরা না পড়লেও বিদেশে ফেরৎ ১৭২ জনের উপর নজরধারী চলছে ত্রিপুরায়। তাঁদের মধ্যে করোনা ভাইরাস না থাকলেই আমরা বেঁচে যাবো এমনটা ভাবা ঠিক নয়। কেননা, এখনো বহিঃদেশ ও রাজ্য থেকে লোক আসা বন্ধ হয়নি। তাই প্রশাসনের উচিৎ এক্ষুনিই ‘কমপ্লিট লকডাউন’ করা। অন্য রাজ্যের করোনা ভয়াবহতার নিরিখে বলা যায়, অন্যথায় পরে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
জানা গেছে, বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারির প্রেক্ষিতে বিশ্বের ১৮টি দেশ থেকে আজ ২৩শে মার্চ ২০২০ দুপুর ১২টা পর্যন্ত দুইশতের মতো লোক ত্রিপুরায় এসেছেন। যাদেরকে চিহ্নিত করা গেছে এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান দপ্তর, জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতায় তাদের উপর বিশেষ নজরধারী চলছে। এর মধ্যে ২৮ জন বিদেশ ফেরতের যাবতীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষ হয়েছে এবং তাদের শরীরে করোনা ভাইরাসের কোন লক্ষন পাওয়া যায় নি। তাই তাদেরকে করোনা মুক্ত ঘোষনা করা হয়েছে। বাদ বাকি ১৭২ জনের উপর নজরধারী ও পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। এদের মধ্যে পাঁচ জনকে হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছিল। এই পাঁচ জন সহ, এখন পর্যন্ত রাজ্যে ১৫ জনের করোনা লক্ষন দেখা দেওয়ায় তাদের পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু সবার রিপোর্টই নেগেটিভ এসেছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, যে দুইশ’র মতো বিদেশ ফেরৎ লোক ত্রিপুরায় ঢুকেছেন তাদের মধ্যে চিন থেকে এসেছেন ৬ জন, ইতালি থেকে ২ জন, হংকং ১ জন, থাইল্যান্ড ১৮ জন, মালয়েশিয়া ৪ জন, সিঙ্গাপুর ৫ জন, জার্মানি ২ জন, বাংলাদেশ ৭৪ জন, কুয়েত ৭ জন, ইউ কে ৬ জন, ইউ এ ই ৩৩, সৌদি আরব ১৩ জন, বেলজিয়াম ১ জন, ফ্রান্স ১ জন, স্পেন ১ জন, ইউ এস এ ২ জন, ওমান ৭ জন, মরিসিয়াস ১ জন, এবং ভারতবর্ষের অন্য বিভিন্ন রাজ্য থেকে এসেছেন ১৬ জন। যারা বাইরের দেশ ও রাজ্য থেকে এসেছেন তাদের প্রত্যেককে যথাযথ পরীক্ষা নিরীক্ষা পরই ছাড়া হচ্ছে।
প্রথমে প্রশাসনের পাহাড়ায় চৌদ্দ দিন নিজ বাড়ীতে রাখা হচ্ছে। এটাকে বলা হচ্ছে হোম ‘কোয়ারিনটাইন’ প্রিয়ড। করোনার কোন লক্ষন দেখা দিলেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু বেশ কিছু ক্ষেত্রেই এমন অভিযোগ এসেছে, এয়ারপোর্ট ও স্থলবন্দর দিয়ে প্রশাসনের নজর এড়িয়ে অনেকে বাড়ীতে চলে গেছেন। এমন বিদেশ ফেরৎ লোকজনদের সম্পর্কে কারো কাছে কোন তথ্য থাকলে তা সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ, স্বাস্থ্য কিংবা জেলা প্রশাসনের নজরে নেওয়ার জন্যে খোদ মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব অনুরোধ জানিয়েছেন।
রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তর এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অভিমত হলো- এই মারন ব্যাধি থেকে বাঁচার একটাই রাস্তা করোনা আক্রান্তের সংস্পর্শে না যাওয়া। এবং নিজেকে সমস্ত সামাজিক কর্মকান্ড থেকে আলাদা করে পুরো সময়ের জন্য ঘরে থাকা।
রাজ্যে এখনো সংক্রমণের কোন পজিটিভ কেইস ধরা না পড়লেও, বর্তমানে বিশ্বব্যাপি করোনা ভাইরাস সংক্রমন নিয়ে যে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা প্রতিরোধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দপ্তরের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশিকা মেনে রাজ্যে যে সমস্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে দাবী করা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছেঃ
১) রাজ্যে ১৫ জানুয়ারী, ২০২০ সালের পর করোনা ভাইরাস আক্রান্ত দেশগুলোতে যারা ভ্রমণ করেছেন, তাদের ক্ষেত্রে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে নজরদারি রাখা হচ্ছে। আগরতলা গভর্নমেন্ট মেডিক্যাল কলেজকে করোনা ভাইরাসের স্টেট টেস্টিং সেন্টার হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে।
২) ইতিমধ্যে রাজ্যের বিভিন্ন সীমান্তের চেকপোস্ট এবং আগরতলা এম বি বি এয়ারপোর্ট-এ বিশেষ নজরদারি দল কাজ করে যাচ্ছে এবং সমস্ত ফিল্ড লেভেলের স্বাস্থ্য কর্মীরা নজরদারী চালাচ্ছেন।
৩) ২টি ইন্টেন্সিফাই স্ক্রিনিং পয়েন্ট কার্যকর করা হয়েছে সেগুলি হল এম বি বি বিমানবন্দর, আগরতলা এবং আখাউরা চেকপোস্ট সহ ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী রাজ্যের অন্য চেকপোস্টগুলি বন্ধ রয়েছে।
৪) ধর্মনগর, আগরতলা, উদয়পুর ইত্যাদি বড় রেল স্টেশনগুলিতে হেল্প ডেস্ক/স্ক্রিনিং পয়েন্ট খোলা হয়েছে এবং সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
৫) বড় বড় বাস স্ট্যান্ডগুলিতেও হেল্প ডেস্ক খোলা হয়েছে এবং সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
৬) ১৭০ জন মেডিকেল অফিসারকে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য এই রোগ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
৭) আইসোলেসান এর জন্য আগরতলা গভঃ মেডিকেল কলেজ এন্ড জিবিপি হাসপাতাল (৬ শয্যা), গোমতী জেলা হাসপাতাল (৮ শয্যা), ধর্মনগর জেলা হাসপাতাল (১০ শয্যা), খোয়াই (৮ শয্যা), তেলিয়ামুড়া (২ শয্যা) এবং ত্রিপুরা মেডিকেল কলেজকে (৫ শয্যা)চিহ্নিত করা হয়েছে যেখানে রোগীর চিকিৎসা করা হবে। অর্থাৎ মোট আইসোলেশান শয্যার সংখ্যা ৩৫টি।
৮) সন্দেহজনক ব্যক্তিকে কোয়ারন্টিনের বা পৃথকভাবে রাখার জন্য ইতিমধ্যে রাজ্যে ৬ টি স্থান চিহ্নিত করে সেখানে ৮১টি শয্যার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেগুলি হল রাজধানীর সমবায় অফিস (৩৫ শয্যা), সিপার্ড (১৬ শয্যা), দেবদারু প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের (১০ শয্যা) নতুন নির্মিত ভবন, খোয়াই জেলায় চম্পাহাওয়ার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নতুন নির্মিত ভবন (১০ শয্যা), উত্তর ত্রিপুরায় রাজনগর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নতুন নির্মিত ভবন (১০ শয্যা)।
৯) এই রোগের বিস্তারকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ত্রিপুরা সরকার ১০ মার্চ এবং ১৩ মার্চ বিশেষ পরামর্শ বা এডভাইজারী জারি করেছিল যেখানে জনসমাগম এড়াতে বলা হয়েছে।
১০) ১৩ মার্চ রাজ্য সরকার মহামারী রোগ অ্যাক্ট ১৮৯৭ সম্পর্কিত একটা বিজ্ঞপ্তি জারি করেছেন যাতে স্বাস্থ্যকর্মী ও অন্যান্যদের নির্দিষ্ট দায়িত্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
১১) চিকিৎসাজনিত ক্ষেত্র ছাড়া স্বাস্থ্যকর্মীদের ছুটি বন্ধ করার জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দপ্তর থেকে পরামর্শ জারি করা হয়েছে।
১২) শিক্ষা দপ্তরের বিজ্ঞপ্তি নং এফ ১ (৯২)-সেক্রেটারি/এডুকেশন এন্ড আর ডি/২০১৯/৩৯৭ অনুসারে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ইউনিভার্সিটি এবং কলেজ বন্ধ রয়েছে।
১৩) করোনা মোকাবিলার জন্য নিম্নলিখিত প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ব্যবস্থা করার জন্য ভারত সরকারের কাছে আবেদন করা হয়েছেঃ
i) ৫০টি ইনফ্রা রেড থারমোমিটার, ii) ২০০০ পিপি্ iii) ৫০০০০ তিনস্তর বিশিষ্ট মাস্ক, iv) ৩০০০ এন ৯৫ মাস্ক
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দপ্তরের পক্ষ থেকে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করার অনুরোধ জানানো হয়েছেঃ
১) জনপ্রতিনিধি/সরকারী কর্মচারী/ চিকিৎসা পরিষেবার সঙ্গে যারা যুক্ত আছেন তারা ব্যতিত সমস্ত ৬৫ বছরের উর্ধে প্রবীণ নাগরিকরা বাড়ির অভ্যন্তরে থাকুন। শুধুমাত্র চিকিৎসাজনিত কারন বা কোনও জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে যাবেন না এবং কোনও সমাবেশ বা ভিড় এড়িয়ে চলুন।
২) ১০ বছর বয়সের নীচে সমস্ত শিশুদেরও ঘরে রাখুন। কোনও পার্ক, পিকনিক, খেলার মাঠ, যেখানে জনসমাগম ঘটে, সেখানে না নিয়ে যেতে অনুরোধ করা হচ্ছে।
ত্রিপুরার পার্শ্ববতী রাজ্য আসাম ও নাগাল্যান্ড সহ দেশের অর্ধেকেরও বেশী রাজ্যে ইতিমধ্যেই ‘কমপ্লিট লোক ডাউন’ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এ রাজ্যে সমস্যা হলো বাংলাদেশের সাথে সীমান্ত বানিজ্যই এখনো বন্ধ হয়নি। বন্ধ হয়নি আন্তদেশীয় বিমান চলাচল। কলকাতা, দিল্লী ও গোয়াহাটি থেকে প্রতিদিনই বিমান আসা যাওয়া করছে। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা মোকাবিলায় এই সব পরিষেবাগুলি এক্ষুনিই বন্ধ করা প্রয়োজন। প্রয়োজন যেভাবেই হোক বহিঃ দেশ ও রাজ্য থেকে করোনা আক্রান্তদের এরাজ্যে প্রবেশ পুরোপুরি বন্ধ করা। আর এর জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ‘কমপ্লিট লকডাউন’ এবং একটাও পজিটিভ কেইস রাজ্যে ধরা পরার আগেই তা করা উচিৎ বলে বিশেষজ্ঞ একাধিক ডাক্তারের অভিমত। (ত্রিপুরাইনফো)