গল্পের সন্ধ্যায় গল্পের জন্য: এক সমৃদ্ধ সন্ধ্যা
অশেষ সেনগুপ্ত
December 30, 2024
উত্তর-পূর্ব ভারতের সাহিত্য চর্চার অন্যতম পরিসর ‘গল্পের জন্য’ তাদের পঞ্চম বর্ষপূর্তিতে আয়োজন করল এক ব্যতিক্রমী ‘গল্প সন্ধ্যা’। শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর আগরতলা প্রেস ক্লাবের ভূমিতলে অনুষ্ঠিত এই সাহিত্য সন্ধ্যাটি ছিল গল্পের এবং গল্পকারদের এক বিশেষ নিবেদন। অনুষ্ঠানের শুরুতে দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মনমোহন সিং-এর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নীরবতা পালনের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এরপর ‘গল্পের জন্য’-এর সম্পাদক বিশিষ্ট লেখক সৌম্যদীপ দেব স্বাগত বক্তব্য রাখেন এবং উপস্থিত অতিথি ও দর্শকদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানান। সূচনালগ্ন থেকে এই গল্প পরিসরের সংগঠিত হয়ে উঠার কাহিনী তিনি তুলে ধরেন। তাঁর কণ্ঠে উঠে আসে প্রয়াত গল্পকার সুবিমল রায় এর মতো বর্ষীয়ান লেখকদের নাম। যাদের হাত ধরে 'গল্পের জন্য' ধীরে ধীরে পূর্ণতা লাভ করেছে।
অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বটিতে ছিল ছোটগল্প নিয়ে মনোগ্রাহী আলোচনা। এই পর্বে বিশিষ্ট গল্পকার তথা গল্পের জন্য এর সভাপতি দুলাল ঘোষের সভাপতিত্বে ‘ত্রিপুরার ছোটগল্পে নিজস্বতা: সময় ও ভাষা নির্মাণ’ বিষয়ে এক সমৃদ্ধ আলোচনা পেশ করেন মোহনপুর স্বামী বিবেকানন্দ মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ঔপন্যাসিক ড. সুতপা দাস। তিনি ত্রিপুরার ছোটগল্পের ভাষা, সময়, শৈলী, এবং শব্দচয়নের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন। বিভিন্ন ছোটগল্পের বিশেষ অংশ তুলে ধরে তিনি ব্যাখ্যা করেন কীভাবে স্থানীয় ভাষার প্রভাব ত্রিপুরার গল্পগুলিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে ত্রিপুরার ছোটগল্প বিভিন্ন সময়ে সমাজের পরিবর্তন, ভাষার বিবর্তন এবং সাংস্কৃতিক আদান প্রদানকে কীভাবে ধারণ করেছে। সেদিন ড. দাসের আলোচনায় যেমন উঠে এসেছে নারী জীবনের যন্ত্রণা তেমনি প্রতিফলিত হয় মানুষের মানসিক ও জৈবিক চাহিদার অসামঞ্জস্য। হতদরিদ্র ভবঘুরের নিজেকে খুঁজে পাওয়ার সংগ্রাম কিংবা বর্তমান অসহিষ্ণু সামাজিক নির্মমতার আস্ফালন, তাঁর আলোচনায় ছোটগল্পের প্রতিটি রন্ধ্রের সফল ব্যবচ্ছেদ সেদিন অবলোকন করে গোটা প্রেক্ষাগৃহ।
এরপর রাজ্যের প্রখ্যাত গল্পকার দেবব্রত দেব ছোটগল্পের শিল্প এবং তার নিরীক্ষা নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি উত্তরপূর্বের আঞ্চলিক সাহিত্য ও ছোটগল্পের বিকাশে নিজস্ব ভাবনার দিক তুলে ধরেন।
বাংলা ছোটগল্পে অসামান্য কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রখ্যাত ছোটগল্পকার শ্রী ঋতেন চক্রবর্তীকে ‘গল্পের জন্য ২০২৪’ সম্মাননা প্রদান করা হয়। তাঁর লেখনী বাংলা ছোটগল্পকে সমৃদ্ধ করেছে এবং এই সম্মান তাঁর অবদানের প্রতি কৃতজ্ঞতার নিদর্শন। শ্রী চক্রবর্তী তাঁর অনুভব প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন এই ধরনের সাহিত্য চর্চার আয়োজন গল্পের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও আগ্রহকে জাগিয়ে তোলে। তিনি আরও জানান, গল্পের মাধ্যমে সমাজের জটিল সমস্যাগুলি সহজভাবে উপস্থাপন করা যায় এবং এই ধরনের আলোচনার আয়োজন আরও হওয়া উচিত।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে গল্প পাঠের আয়োজন করা হয়। গল্পকার সুজয় রায়ের সভাপতিত্বে এ পর্বে গল্প পাঠ করেন অধ্যাপক এবং গল্পকার অর্পিতা আচার্য, পদ্মশ্রী মজুমদার, এবং দেবব্রত দেব। প্রতিটি গল্পেই উঠে আসে বিভিন্ন সামাজিক বিষয়। গল্পকারদের গল্পের মাধ্যমে জীবনের গভীরতর সত্য এবং মানবিক মূল্যোধের বিভিন্ন রূপ সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়।
যদিও রাষ্ট্রীয় শোকের কারণে পূর্ব নির্ধারিত সঙ্গীত পরিবেশনা স্থগিত করা হলেও শিল্পী তনুময় বিশ্বাস এবং মৌরিতা রায়কে শুভেচ্ছা জানিয়ে তাঁদের হাতে প্রীতি উপহার তুলে দেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানের দুটি পর্বের সমাপ্তি ঘটে উভয় সভাপতির অনুভব প্রকাশের মাধ্যমে। প্রথম পর্বের সভাপতি দুলাল ঘোষ এবং দ্বিতীয় পর্বের সভাপতি সুজয় রায় তাঁদের বক্তব্যে গল্প এবং সাহিত্যচর্চার গুরুত্বের উপর আলোকপাত করেন। এরপর ‘গল্পের জন্য’-এর পক্ষ থেকে সামগ্রিক ভাবে ধন্যবাদ সূচক বক্তব্য রাখেন আগরতলা মহিলা মহাবিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যক্ষা এবং প্রাবন্ধিক ড. গীতা দেবনাথ। তিনি জানান, এই ধরনের আয়োজন সাহিত্য জগতে এক নতুন মাত্রা যোগ করে এবং সাহিত্যপ্রেমীদের মধ্যে নতুন আলোচনার সূত্রপাত ঘটায়।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত সাহিত্যপ্রেমী ও বিশিষ্টজনেরা ‘গল্প সন্ধ্যা’কে ত্রিপুরার সাহিত্য জগতে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এই ধরনের আয়োজনের মাধ্যমে সাহিত্যিক পরিবেশ আরও উন্নত এবং সমৃদ্ধ হবে বলেও তাদের আশা।
‘গল্পের জন্য’-এর সম্পাদক সৌম্যদীপ দেব জানান, এই আয়োজন সফল করার পেছনে সবার সহযোগিতা ছিল অসামান্য। তিনি আরও জানান, ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে এ ধরনের আয়োজন করার পরিকল্পনা রয়েছে।
‘গল্প সন্ধ্যা ২০২৪’ শুধুমাত্র একটি সাহিত্য আয়োজন নয়, এটি ছিল প্রকৃত অর্থে গল্পকার ও গল্পপ্রেমীদের সফল ভাবনা বিনিময়। ত্রিপুরার ছোটগল্প এবং বাংলা ছোটগল্পের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই আয়োজন নিঃসন্দেহে রাজ্যের সাহিত্য জগতে একটি অন্যতম পদক্ষেপ।