বিকাশ সরকার : বাংলা কবিতার অন্যতম শক্তিশালী কণ্ঠস্বর
শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ
বিকাশ সরকারের শ্রেষ্ঠ প্রেম কাব্যোপখ্যান হল একশোটি অংশুল কবিতার একটি সুচারু সংকলন ! এই সংকলিত প্রেমের কবিতায় কল্পনা মদির সমুজ্জ্বল রঙের সুন্দর বিমূর্ত শিল্পের সঙ্গে যেন মিশে আছে সামান্য পরিমাণে অধ্যাত্মবাদী ভাবনার শিবরঞ্জনী গীত। সংকলনটির প্রারম্ভেই রয়েছে অবহেলিত মানুষের অধিকার নিয়ে সরব জ্যামাইকান রোগে শিল্পী, গীটার বাদক, গীতিকার বব মার্লে'র সেই বিখ্যাত উক্তি, 'তুমি নাকি বৃষ্টি ভালোবাসো। অথচ বৃষ্টি এলে সেই ছাতা খুলেই পথে বেরোও। রোদ ঝলমলে দিনই তো তোমার পছন্দ। আমি কিন্তু জানি রোদের বদলে ছায়াচ্ছন্ন আশ্রয়ই তোমার পছন্দ । মন উদাসী বাতাসের কথা কতবার বললে। সেই বাতাস বইলে জানলাগুলি প্রথমেই তুমি বন্ধ করে দাও। আমি তাই সন্ত্রস্ত হই যখন বলো, তুমি আমায় ভালোবাসো। " আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জনপ্রিয় জ্যামাইকান সঙ্গীত এবং সংস্কৃতির অন্যতম বৈগ্রহিক সংগীত শিল্পী এবং গীতিকবির আসনে বসানো হয় বব মার্লে'কে। 'বাফেলো সোলজার', 'নো, ওম্যান, নো ক্রাই', 'গেট আপ স্ট্যান্ড আপ', 'ব্ল্যাক প্রগ্রেস'-এর মতো এমন অনেক ভুবন মোহিনী গানে সংগীতপ্রেমীদের হৃদয়জয়ী বব মার্লে'র এই উক্তিটিই আসলে বিকাশ সরকারের গোটা বইটির অনন্যসাধারণ প্রিল্যুডের কাজ করেছে। এই ভাবেই যেন বিকাশ ও তাঁর 'প্রেমপত্র' কবিতায় লিখেন এই কথাই “যে-ফুলের সাহচর্যে অতিরঞ্জিত হয়ে উঠল তোমার ফরসা, তীক্ষ্ণ ওই মুখ, সেই ফুল আমাকে অহর্নিশি অভিশম্পাত করে।" আপাত দৃষ্টিতে এমন উচ্চারণ অনায়াস মনে হলেও অত্যন্ত কঠিন কিন্তু এই কনফেশন। মসৃপতার বিপ্রতীপে অনিশ্চয়তা না থাকলে প্রেম জমাট বাঁধে না। প্রেমের কবিতা লেখা তাই সহজসাধ্য নয় মোটেই। অনস্বীকার্য যে বিরহ বা বিয়োজনের বিষাদ ব্যতীত বিরচিত হয় না প্রেমের অবিসংবাদী অভিজ্ঞান ; নির্মিত হয় না কবিতার নিত্যস্পন্দিত বাক্জগৎ! কল্লোলিত পার্বত্য ঝরনার মতোই বিকাশ কিন্তু স্বতস্ফুরত তাঁর প্রেম - কবিতায়। মুক্তাচরণ প্রেমের কবিতাগুলি পড়ার পরেও তার অনুরণন থেকে যায় হৃদয়মননে দীর্ঘক্ষণ। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়তে হয় বিকাশের মায়াবী কলমে উত্থিত তরঙ্গিলী কথন।
প্রথম পৃষ্ঠা থেকেই, পাঠকদের অত্যন্ত সুন্দর, দীপ্যমান কবিতাগুলির নৈকব্য ঘটে! বিকাশ লেখেন, ” তোমার ঠোঁটের থেকে কুর্চিফুল ঝরে, ঝরে দুখি যত বকুলের ফল/ বাউলগানের মতো জেগে থাকে রহস্যে মাখামাখি তোমার সকল / ভালোবাসছ না আর, জানি জানি, বিচ্ছেদ হয়ে গেছে দৈবদুর্বিপাকে/ তবু তোমারই শরীর থেকে, গহনমাদল আজও বেজে যেতে থাকে” (গ্রহনমাদল বেজে যেতে থাকে)। কিম্বা "পূর্বাজন্মে ছিলে, পরজন্মে আছো, শুধু এই জন্ম নিয়তিসম্বল / কী রাগ তুমি জানি না তো, জানি শুধু তুমি এক বিষাদ্গাজল।" (বিষাদগজল)
বিকাশের প্রেমের কবিতা আসলে উজ্জ্বল ইমেজারি সম্পন্ন প্রাণবন্ত চিত্রপট। এমন ক্যানভাসে একই সঙ্গে যেন বেয়ে গড়িয়ে পড়ে ঈপ্সা আর বিষাদের দ্রাবিত রঙ! আর এই আখ্যানে অনপেক্ষিত নয় বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা সমূহ। প্রেম এবং অনিশ্চয়তাজনিত বিরহের অন্বেষিত ধারণা রোম্যান্টিক হলেও এর মধ্যে সুপ্ত রয়ে যায় সমাজ পরিবর্তনের শক্তিশালী প্রস্বপাস্ত্র ! "ভাতশীৎকার" কবিতায় বিকাশ তাই লিখেন, "তোমার আঁচলে বাঁধা রয়েছে দেখছি শস্যদানা আর প্রেম/ ভালোবাসার রোদ তুমি দু' হাতে ছড়াও/ তোমার উড়ন্ত চুলের শব্দ, তাঁতে বোনা আঁচল খসে পড়ার শব্দ / ভালোবাসা ছড়িয়ে দেওয়ার শব্দ/ সব ঢেকে যায় চোখ থেকে জল পড়বার শব্দে / বিষণ্ণ রুমালে অশ্রু মোছার শব্দ পাই আমি/ চুমু ও ভাতচিৎকার/ শরীরে শরীর ও ভাতশীৎকার।” একই সঙ্গে চরম আশাবাদের কথাও ধ্বনিত হয় তাঁর কবিতায় যখন বিকাশ ” ঢেকে যায় লক্ষ জোনাকি পোকায় লেখেন, ” এত যে নিকষ আঁধার, তুমি এলে ভিজে ভিজে সে আঁধার ধুয়ে ভেসে যায় / পেশিরক্তস্নায়ুলিঙ্গঘিলু আর হৃদপিন্ড ঢেকে যায় লক্ষ লক্ষ জোনাকি পোকায়।” একই ভাবে বিকাশ ফের অবলীলায় লেখেন, "আমি এক ভাত শিকারী, ভাতের ভিতর দেখি আনমনা প্রেমিকের মুখ! " (পেক্সামের বড়ি থেকে উঠে আসছে প্রেমিকার মুখ)। শুধুই রোম্যান্টিকতায় অনু-লিপ্ত নয়; ভাত শিকারী বিকাশ সুক্ষতার সঙ্গে এঁকেছেন এক জটিল সময়ের ছবি।
এই ভাবে মানবিক সংবেদনশীলতার অন্বেষিত ভাবনায় বিকাশের কবিতা অনেক সময়ই হয়ে উঠে প্রথা বহির্ভূত। আর এই কারণেই ভিন্ন মাত্রা লাভ করে তাঁর কবিতার ফর্ম এবং কনটেন্ট। বিকাশের প্রেমের কবিতায় রয়েছে জীবনকে স্পর্শ করার তীব্র অভীপ্সা। সঙ্গত কারণেই এমন সব কবিতায় সম্পৃক্ত হয়েছে আলো আঁধার সংমিশ্রিত মানব মনের জটিলতা সহ সত্তা এবং অস্তিত্বের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মৌলিক প্রশ্নসব! আবেশি আধানের মতো বিকাশের মনেও বিদ্যুন্মালা সম প্রশ্ন জাগে, ” আমি গ্রামের ছেলে, খুব আমি বোকাসোকা, অধিকাংশ ব্যাকরণহীন/ নামধাম যা-ই থাক, শহর আমাকে ডাকে সেরগেই দুখি এসেনিন/ তুমি কি সেসব বোঝো শহরের মেয়ে? কাছে এসো, বুঝে নিও / দুদিন খাইনি ভাত, এমও করতে যেন ভুলে গেছে ছোটভাই থিও/ আমি কি হলুদ লুটাই মৌরিখেতের ধারে বসে দেখি প্রাণবন্ত ছৌ / নোংরাছিন্ন পোশাক দেখে আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে ভালেরির বউ / শহরের মেয়ে বুকে হাত রেখে বলো দেখি তুমি কি এসব বোঝো?” পরিশেষে বিকাশ "সেরগেই আর্তুর গখ" নামক এই কবিতায় অমোঘ পাঞ্চ লাইনের মতোই লেখেন, "কবিতার গলা টিপে ধরে তুমি শুধু ছন্দ ও মাত্রার ভুল খোঁজো। প্রেম সন্ধানে অভিযাত্রিক বিকাশের কবিতার প্রতিটি পঙক্তিই অনন্য। বইটির ব্লাবে প্রকাশকও এটাই বলতে চেয়েছেন বিকাশের কবিতা, " চিরাচরিত পদ্ধতি অনুসরণ করে না, বরং তৈরি করে একটি অন্য ন্যারেটিভ যা বিকাশীয়, কিংবা বলা যায় ওটাই বিকাশ, বিকাশের সিগনেচার টিউন।” বিকাশ... বিকাশ সরকার এই সময়ের "বাংলা কবিতার অন্যতম শক্তিশালী কণ্ঠস্বর।” এই বিষয়ে দ্বিমতের কোনও অবকাশ নেই।