পিলাকঃমাটির নিচে অজানা ইতিহাস
পান্নালাল রায়
ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের এক উল্লেখযোগ্য প্রত্নভূমি পিলাক। এখানে মাটির নিচে শুয়ে আছে অজানা ইতিহাস। মাঝে মাঝে মাটির নিচ থেকে আবিষ্কৃত হয় বিগ্ৰহ।চোখে পড়ে ইটের পাঁচিলের ধ্বংস স্তুপ। আরও নতুন আবিষ্কারের অপেক্ষায় যেন উন্মুখ হয়ে আছে পিলাকের বিগ্ৰহ বলয়।
দক্ষিণ ত্রিপুরার বিলোনিয়ার জোলাইবাড়ির কাছে পিলাককে যেন ঘিরে আছে এক রহস্য। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের অনুমান একদা ব্রাক্ষ্মণ্য ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির মিলন ঘটেছিল এখানে। কেউ কেউ বলছেন,পিলাক এক সময় বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রভাব পুষ্ট ছিল। আবার তার শিল্প সামগ্ৰী ব্রাক্ষ্মণ্য ধর্ম দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছে।পিলাকের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বিভিন্ন সময়ে নানা বিগ্ৰহ আবিষ্কৃত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে জলাশয়ের জন্য বা অন্য কোনো কারণে মাটি খনন করতে গিয়ে পাওয়া গেছে এই সব বিগ্ৰহ।আর হঠাৎ বিগ্ৰহ আবিষ্কৃত হলে নিস্তরঙ্গ গ্ৰামের মানুষ ছুটে যান প্রণতি জানাতে। দেবালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় তা। মাঝে মাঝে মাটির নিচ থেকে প্রাচীন যুগের ইঁট এবং মুদ্রাও আবিষ্কৃত হয়েছে।এসব কারণে স্বাভাবিক ভাবেই ধারণা জন্মে কোনো এক সময়ে এই অঞ্চলে হয়তো এক সমৃদ্ধ নগরী ছিল।
পিলাকের শ্যামসুন্দর টিলায় মাটি খনন করে উদ্ধার হয়েছে প্রাচীন দেয়ালের ধ্বংসাবশেষ। সেখানে আগেই বিগ্ৰহ আবিষ্কৃত হয়েছিল। অনুমান করা হয়েছে যে, সুদূর অতীতে এখানে বুদ্ধ স্তুপ ছিল।১৯৮৫ সালে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগ এখানে খনন কার্য চালায়।পাথরে তৈরি অবলোকিতেশ্বর, মস্তকবিহীন বুদ্ধ বিগ্ৰহ, ব্রোঞ্জ নির্মিত বুদ্ধ ইত্যাদি এখানে পাওয়া গেছে। পরবর্তী সময়ের খনন কার্যের ফলে বিশাল ধ্বংস স্তুপের মাঝে একটি স্তুপের স্বাভাবিক নিদর্শন পাওয়া গেছে।
শ্যামসুন্দর টিলার মতো পিলাক অঞ্চলের নানা দিকে এরকম বহু বিগ্ৰহ আর প্রাচীন ইঁট ছড়িয়ে আছে। বুদ্ধমূর্তি যেমন পাওয়া গেছে, তেমনই আবিষ্কৃত হয়েছে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তিও। আবার বুদ্ধস্তুপের মতো পাওয়া গেছে মন্দিরের ধ্বংসাবশেষও।
শ্যামসুন্দর টিলা পেরিয়ে কিছুটা অগ্ৰসর হলেই পাওয়া যাবে পূজা খলা। এখানে মাটির ঢিপি খনন করে পাওয়া গেছে প্রাচীন দেয়ালের ধ্বংসাবশেষ। পাওয়া গেছে দন্ডায়মান সূর্য মূর্তি,যা কিনা নবম শতাব্দীর বলে অনুমান করা হয়েছে।
পূজা খলা থেকে সামান্য কিছু সামনে গেলেই পাওয়া যাবে ঠাকুরাণীটিলা। এখানে মাটির নিচ থেকে অনেক বিগ্ৰহ আবিষ্কৃত হয়েছে।এর মধ্যে রয়েছে সূর্য, মহিষাসুর মর্দ্দিনী,শিব। এখানে পাওয়া গেছে মন্দিরের ধ্বংসাবশেষও। অনুমান করতে অসুবিধা হয়না যে, দেবদেবীরা প্রতিষ্ঠিত ছিলেন মন্দির সমূহে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো এক সময়ে ঠাকুরাণী টিলা অঞ্চল হিন্দু তথা ব্রাক্ষ্মণ্য ধর্মের এক বিরাট কেন্দ্র ভূমি হিসেবে গড়ে উঠেছিল।সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর পর বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব স্তিমিত হয়ে এলে আবার হিন্দু ধর্মের প্রসার ঘটেছিল এই অঞ্চলে।পিলাকের আবিষ্কৃত হিন্দু দেবদেবীর বিগ্ৰহ এবং মন্দির সমূহের ধ্বংসাবশেষ যেন আজও তার সাক্ষ্য বহন করছে।ঠাকুরাণী টিলায় আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় বিগ্ৰহটি হলো সূর্যদেবের। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন এমন বিশাল সূর্যমূর্তি সমগ্ৰ পূর্ব ভারতের আর কোথাও পাওয়া যায় নি।বিগ্ৰহটি দশ ফুট উঁচু এবং পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি প্রশস্ত। একটি ইঁট নির্মিত মন্দির কাঠামোর মধ্যে এই দন্ডায়মান বিগ্ৰহটি ছিল।মূর্তিটির নির্মান শৈলী বিশ্লেষণ করে পুরাতত্ত্ববিদরা বলেছেন, এতে বাংলার সেন রাজবংশের আমলের সৃষ্ট শিল্প শৈলীর নিদর্শন স্পষ্ট।তা থেকে ধারণা করা যায় যে,বাংলার সেন রাজবংশের সমসাময়িক কালে বা নবম-দশম শতাব্দীতে এখানে হিন্দু ধর্মের অন্যতম কেন্দ্র ছিল। পরবর্তী সময়ের খনন কার্যের ফলে আটটি ইঁট নির্মীত ছোট মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে ঠাকুরাণী টিলায়। এই সব মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ সম্পর্কে ত্রিপুরার বিশিষ্ট পুরাতত্ত্ববিদ ড.বিপ্রদাস পালিত বলেছেন-"...উৎখননের ফলে যে প্রকোষ্ঠ গুলোর ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে তাদের গড় পরিমাণ ৫মিঃ, ৪ মিঃ মতো।... মনে হয় এখানে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আকারের ছোট ছোট প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট বিভিন্ন দেবদেবীর পূজার জন্য মন্দির নির্মীত হয়েছিল।"
পিলাকে যত প্রস্তর বিগ্ৰহ পাওয়া গেছে তার সবই বেলে পাথরে তৈরি। এছাড়া পাওয়া গেছে ব্রোঞ্জ মূর্তি। এখানে একদিকে যেমন বুদ্ধ মূর্তি তৈরি হয়েছিল, তেমনই অপরদিকে সৃষ্টি হয়েছিল হিন্দু দেবদেবীর মূর্তিও। সে জন্যই ব্রাক্ষ্মণ্য ও বৌদ্ধ ধর্মের মিলনস্থল হিসেবে বর্ণিত হয়েছে পিলাক।সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী থেকেই তার শিল্প সামগ্ৰী সৃষ্টি শুরু হয়েছিল বলে মনে করা হয়। সুপ্রাচীন কালে পিলাককে কেন্দ্র করে ছিল এক সমৃদ্ধ জনপদ।গবেষকগণ আরও বলেছেন যে,পিলাকের ভাস্কর্য সমূহ সৃষ্টির পেছনে রয়েছে বিভিন্ন মানব গোষ্ঠীর বহু বছরের অবদান। সময়ে সময়ে এই সব মানব গোষ্ঠী এসেছিল বাংলা, চট্টগ্রাম ও আরাকান থেকে।শ্যামসুন্দর টিলা,সাগরঢেপা ও বালিরপাথর অঞ্চলে যেসব পোড়া মাটির ফলক আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলো গুপ্তোত্তর কালের শিল্প কীর্তির পরিচয় বহন করছে বলে অনেকে উল্লেখ করেছেন।পিলাকে কিছু স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা পাওয়া গেছে। এই সব মুদ্রা ৭ম-৮ম থেকে ১২শ-১৩শ শতাব্দী পর্যন্ত প্রচলিত ছিল বলে মনে করা হয়। মুদ্রার ভিত্তিতে বলা হয়েছে সমতট, আরাকান প্রভৃতি অঞ্চলের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাজাদের প্রভাব যেমন পিলাকে পড়েছিল, তেমনই আবার গুপ্ত ও সেন বংশীয় হিন্দু রাজাদের প্রভাবেও পিলাক প্রভাবিত হয়েছিল।গড়ে উঠেছিল হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি, প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মন্দির।পুরাতত্ববিদ ড.পালিত বলেছেন যে, ধারণা করা যায় হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের উভয় অংশের মানুষ একসঙ্গে মিলেমিশে বিকাশ ঘটিয়েছিল পিলাকের।এটাও হতে পারে পিলাক একদা সমতট বা হরিকেল রাজ্যের অধীন এক বিশাল মন্দির নগরী ছিল। তবে ঘটনা হলো বৌদ্ধ সংস্কৃতির শেষ পর্যায়ে এখানে হিন্দু সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। আবিষ্কৃত বিশাল বিগ্ৰহ সহ নানা প্রত্ন সামগ্ৰী যেমন পিলাকের প্রতি গবেষকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে, তেমনই তার ধর্মীয় সংস্কৃতির সমন্বয়ের ঘটনাও কম আকর্ষণীয় নয়! বিশিষ্ট পুরাতত্ত্ববিদ তথা আগরতলা সরকারি মিউজিয়ামের প্রাক্তন কিউরেটর রত্না দাস বলছেন,'পিলাকে প্রাপ্ত প্রত্ন সামগ্ৰীর গঠনশৈলী ও উপকরণ ব্যবহারের রীতি দেখে মনে হয় এ সকল বস্তু খ্রিষ্টীয় ৭ম থেকে ১১শ-১২শ শতাব্দীর অন্তর্গত। প্রচুর পুরাতন ইঁটের সমাবেশে মনে হয় বেশ বৃহৎ কোনো স্হাপত্য নিদর্শনও এখানে ছিল যা আজ ধ্বংসস্তূপেই পরিণত হয়েছে।'
ত্রিপুরার 'রাজমালা'তে পিলাক নিয়ে কোনো তথ্য নেই। সমরেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মা তাঁর 'ত্রিপুরার স্মৃতি' গ্ৰন্হে অন্য কথা বলেছেন পিলাক নিয়ে। ত্রিপুরার এক পরাক্রান্ত সেনাপতি ছিলেন বলিভীম নারায়ণ।২য় রত্ন মানিক্য যখন নাবালক রাজা(১৬৮৫-১৭১৩খ্রীঃ) তখন রাজ্যের সর্বময় কর্তৃত্ব ছিল বলিভীমের হাতে। কিন্তু প্রজাবর্গ তাঁর এই কর্তৃত্ব না মানায় রাজ্যে নানা অশান্তি সৃষ্টি হয়। তখন বলিভীম পিলাক অঞ্চলে এসে বসবাস করতে থাকেন।পিলাকে যেসব ইঁট পাওয়া গেছে তা বলিভীম নারায়ণ নির্মিত ভবনের ধ্বংসাবশেষ বলে সমরেন্দ্র চন্দ্র উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও লিখেছেন,পিলাকে প্রাপ্ত বিগ্ৰহ সকল বলিভীম কর্তৃক নির্মিত হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। কিন্তু পরবর্তী সময়ের গবেষণা, উৎখনন এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণে তাঁর এই ধারণা নস্যাৎ হয়ে যায়। সমরেন্দ্র চন্দ্র অবশ্য পিলাকের বিগ্ৰহ সকল পর্যবেক্ষণ করে বলেছিলেন যে, এই সব বিগ্ৰহ ভারতের উত্তর পশ্চিম প্রদেশ নিবাসী নিপুণ শিল্পীর কাজ নয়। এগুলো স্হানীয় অপটু শিল্পীর কাজ। কিন্তু তাঁর এই বক্তব্যও গ্ৰহণযোগ্য নয়। সর্বোপরি বলিভীম নারায়ণ প্রজা অসন্তোষের প্রেক্ষিতে রাজধানী থেকে পিলাক এসে এরকম বিরাট সংখ্যক বিগ্ৰহ সৃষ্টি করবেন, প্রাসাদ, মন্দির গড়ে তুলবেন তাও বিশ্বাসযোগ্য নয়।আর এসব বিষয়ে রাজমালাতে কোনো উল্লেখই নেই।
পিলাকের পুরাকীর্তি সমূহ সুপ্রাচীন যুগের। ত্রিপুরায় মাণিক্য রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়েছে পঞ্চদশ শতকে। কিন্তু তারও আগে থেকেই পিলাকে শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল। তৈরি হয়েছিল বিগ্ৰহ।গড়ে উঠেছিল বৌদ্ধ স্তুপ, মন্দির।বিগ্ৰহ সমূহের সৃষ্টিকালও সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী থেকেই শুরু বলে ধারণা করা হয়।পিলাকে প্রাপ্ত শিল্পকীর্তি সমূহ ত্রিপুরার প্রাচীনতম প্রত্ন নিদর্শন।
পিলাকের বাসুদেব বাড়ি,ঠাকুরাণী টিলা, পূজা খলা,বালির দীঘি,শ্যামসুন্দর টিলা, দেবদারু ইত্যাদি অঞ্চল থেকে যেমন নানা প্রত্ন নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে, তেমনই সংশ্লিষ্ট আরও নানা এলাকায় হয়তো মাটির নিচে রয়ে গেছে আরও প্রত্নসামগ্ৰী। বর্তমানে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া অর্থাৎ এ এস আই'র আইজল সার্কেলের অধীনে রয়েছে পিলাক। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে তা আরও ব্যাপক উন্নয়নের দাবি রাখে। শুধু উৎখনন আর সংরক্ষণই নয়, পর্যটকদের সুযোগ সুবিধা সহ তার প্রচার প্রসারে আরও উদ্যোগ চাই। নিশ্চিত, শুধু এ এস আই নয়, সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরকে এ ব্যাপারে একযোগে কাজ করতে হবে।ঠাকুরাণী টিলায় এ এস আই থেকে একটি মিউজিয়াম গড়ে তোলা হয়েছে।অবশ্যই এর আরও শ্রীবৃদ্ধি প্রয়োজন।শ্যামসুন্দর টিলা, পূজা খলা,ঠাকুরাণী টিলা-প্রতিটি প্রত্নস্হলেরই আরও উন্নয়ন প্রয়োজন।এর বাইরেও যেসব বিগ্ৰহ ছড়িয়ে আছে সেসব নির্দিষ্ট দর্শনীয় প্রত্নস্হল গুলোতে এনে সন্নিবেশ করতে হবে। পাশাপাশি অব্যাহত রাখতে হবে উৎখননের কাজ।কে জানে, হয়তো সূর্যালোক দেখার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে মাটির নিচের আরও বিগ্ৰহ সহ নানা প্রত্ন সামগ্ৰী!
ত্রিপুরায় ঊনকোটি, দেবতামুড়া,পিলাক -- এই সব গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্হল রয়েছে।তাই ত্রিপুরার জন্য আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার একটি পৃথক সার্কেল হতেই পারে।পৃথক সার্কেল হলে রাজ্যে এ এস আই'র কাজকর্মের গতিও স্বাভাবিক ভাবেই বৃদ্ধি পাবে।আর এইসব গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্হল গুলোকে কেন্দ্র করে নিঃসন্দেহে রাজ্যে পর্যটন শিল্পের আরও বিকাশ ঘটবে।