একাত্তরের স্মৃতি : কিছু কথা

শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ

বলতে লজ্জা নেই একাত্তরের বিষয়ে কিছু লিখতে বসলে আমার সত্যি ডিপ্রেশনের মতো অবস্থা হয় ! বিষাদে ছেয়ে যায় মন। শুধু ভাবি আর ভাবি মানুষ এমন নির্মম হতে পারে ! পাকিস্তানি মিলিটারি আর রাজাকার বাহিনী মিলে ২০০০ - ৪০০০ বাঙালি মহিলাকে ধর্ষণ করেছিল। সে দেশে সোহাগপুর নামে একটি গাঁয়ে একজন পুরুষকেও ওরা জীবিত রাখে নি। পাক মিলিটারি তারপর মহিলাদের ওপর পৈশাচিক অত্যাচার চালিয়েছিল। বিদেশি মিডিয়া সেই গাঁয়ের নাম দিয়েছিল, "ভিলেজ অব উইডোজ"। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের লালসা মেটাতে গিয়ে হিন্দু কিম্বা মুসলিম রমণী বলে বাছ বিচার করে নি। ২ ফেব্রুয়ারি, ২০০৪’ রেডিফ ডট কম’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একাত্তরে পাকিস্তানি সেনতবাহিনীর লেঃ জেনারেল আমীর আবদুল্লা খান নিয়াজি স্বীকারোক্তির মতো বলেছিলেন, ‘’ I clearly wrote in my letter that there have been reports of rapes and even the West Pakistanis are not being spared. I informed my seniors that even officers have been suspected of indulging in this shameful activity.’’ ধর্ষণের পাশাপাশি গণহত্যায় মেতে উঠেছিল পাকিস্তানি সেনা বাহিনী। শহিদ হয়েছিল ৩০ লক্ষেরও বেশি। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত এই বিষয়ে বিশ্বের অন্যান্য প্রভাবশালী দেশকে অবহিত করার চেষ্টা করলেও বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব কেউ দিতে চায় নি। পরিস্থিতি বদলে যায় অ্যামেরিকার ডিপ্লোম্যাট আর্চার কে ব্লাড যখন রিচারড নিক্সন প্রশাসনকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচার সম্পর্কে অবহিত করার জন্য একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন। নিক্সন প্রশাসনকে পাঠানো চিঠিটি গণ মাধ্যমে ফাঁস হয়ে যায়। নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিশ্ব জুড়ে হইচই শুরু হয়। টেলিগ্রাম’টি আজ ব্লাড টেলিগ্রাম নামে খ্যাত। সেই টেলিগ্রামে আর্চার লিখেছিলেন, "with support of the Pak military, non-Bengali Muslims are systematically attacking poor people's quarters and murdering Bengalis and Hindus." উন্মত্ত পাক বাহিনীর অত্যাচার আর গণহত্যার হাত থেকে বাঁচার জন্য এক কোটি নিরন্ন বাঙালি ভারতে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল।

একাত্তরে শৈশবাস্থায় ছিলাম ঠিকই ; তবু আমার কিছুটা বোধশক্তি তখন থেকেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। যুদ্ধের ভয়াবহতা আমাকে বিস্মিত করেছিল। মনে পড়ে আগরতলায় আমাদের পুরোনো দালান বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা ভাড়া নিয়েছিল। নাম দিয়েছিল "ঢাকা হাউস" । মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তখন আমাদের পারিবারিক সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। বুঝতে পেরেছিলাম চারপাশে একটা চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। আমাদের বাড়িতেও অনেক বাংলাদেশি সপরিবারে আতিথ্য নিয়েছিলেন। তবে তাঁরা অবশ্যই সাধারণ বাঙালি শরণার্থী ছিলেন না। চিত্রতারকা থেকে শুরু করে সম্পন্ন ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, রাজনীতিক, পাকিস্তানি এয়ার ফোর্স ছেড়ে আসা পাইলট - এমন সব বাঙালিরাই এসেছিলেন। পাকিস্তানি এয়ার ফোর্স ছেড়ে আসা সেই পাইলট সপরিবারে মধ্যাহ্নভোজন করার সময় বাবাকে বলেছিলেন, ‘’আজ আগরতলায় আপনাদের বাড়িতে বসে খাচ্ছি; ১৯৬৫’এ কিন্তু এই শহরের বুকে পাকিস্তানি এয়ার ফোর্সের হয়ে আমাদের বম্বিং করার প্ল্যান ছিল ।‘’ গর্জন নামে এক তরুণ ব্যবসায়ী এক ঢাউস বিদেশি গাড়ি নিয়ে আগরতলায় চলে এসেছিলেন। আতিথ্য নিয়েছিলেন আমাদের বাড়িতেই । গর্জন কাকুর দৌলতেই আমি সেই ছেলেবেলাতেই বিদেশি গাড়ি চড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। সন্ধ্যায় আমাদের বাড়িতে বাবা আর মা’র সঙ্গে ওদের জমাটি গান আর আড্ডার আসর জমতো। আড্ডায় স্বাভাবিক কারণেই আমার প্রবেশাধিকার ছিল না। আমি ওদের কাছ থেকে ক্যাডবেরি চকোলেট পেয়েই খুশি থাকতাম। আগরতলা ছিল ওদের অনেকটা ট্র্যানজিট ক্যাম্পের মতো। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই আগরতলা থেকে আমাদের দেশের অন্য রাজ্যে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য চলে যেতেন। বাকিরা পরিবার নিয়ে পাড়ি দিতেন উত্তরপূর্ব ভারতের অন্যতম শৈল শহর শিলং অথবা গুয়াহাটিতে । শুনেছি অনেকে আবার সেখান থেকে চলে যেতেন পশ্চিমবঙ্গে। অবস্থাপন্ন ছিলেন বলে হয়তো তাঁদের খুব একটা কষ্ট সইতে হয় নি। আমাদের বাড়িতে অতিথি হিসেবে থাকা একজন রাজনীতিক পরে স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রীও হয়েছিলেন। কিন্তু সাধারণ শরণার্থীদের যে কী দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে দিন কাটাতো হতো - সে সব বড় হয়ে জানতে পেরেছি। আগরতলায় আসা শরণার্থীদের সম্ভবত প্রথমে রাখা হয়েছিল চিলদ্রেন্স পার্কে । পরে তাদের সেখান থেকে অন্যত্র থাকার ব্যবস্থা করা হয়।

বাঙালি শরণার্থীদের অবস্থা দেখে অ্যামেরিকার কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ কবিতা লিখেছিলেন সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড। গিন্সবার্গ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিকে ভারতের কলকাতায় এসেছিলেন। কলকাতার বেশ কয়েকজন সাহিত্যিকের সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল যার মধ্যে একজন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। গিন্সবার্গ সুনীলের বাড়িতেই উঠেছিলেন। সেই সময় বাংলাদেশ থেকে অনেক শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছিল। ব্রিটিশ রাজের সময় পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের সংযোগকারী সড়ক হিসেবে কাজ করতো "যশোর রোড"। বৃষ্টি হওয়ায় তখন যশোর রোড জলমগ্ন অবস্থায় ছিল। সড়ক পথে না এগোতে পেরে গিন্সবার্গ অবশেষে নৌকায় করে বনগাঁ পেরিয়ে বাংলাদেশের যশোর সীমান্তে পৌঁছেন। সঙ্গে ছিলেন সুনীল । তারা যশোর সীমান্ত ও এর আশপাশের শিবিরগুলোতে বসবাসকারী শরণার্থীদের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেন। এই অভিজ্ঞতা থেকেই গিন্সবার্গ এই কবিতাটি লিখেছিলেন। এই দীর্ঘ কবিতার সাথে সুর দিয়ে এটিকে গানে রূপ দিয়েছিলেন তিনি। আমেরিকায় ফিরে গিয়ে তার বন্ধু বব ডিলান ও অন্যান্য বিখ্যাত গায়কদের সহায়তায় এই গান গেয়ে কনসার্ট করেছিলেন। বাংলাদেশী শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন গিন্সবার্গ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচারে ভারতে পালিয়ে আসা অগণিত বাঙালি শরণার্থীদের দুর্দশা সম্পর্কে অবশেষে অবহিত হন বিশ্ববাসী।

এদিকে আকাশে যুদ্ধের কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছিল। বড়রা সবাই বলাবলি করতো – যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। আমাদের বাড়ির উঠোনে Z আকারে ট্রেঞ্চ কাটা হয়েছিল। শুধু তাই নয়; বাবা রাজমিস্ত্রিদের দিয়ে কুড়ি ইঞ্চির সিমেন্টের বাঙ্কার বানিয়েছিলেন। সেই বাঙ্কারের দেওয়ালে তারপর স্তূপীকৃত করে রাখা হয়েছিল বালির বস্তা। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে সেবার ডিসেম্বরের শীতার্ত রাতে পাক মিলিটারি আগরতলায় শুরু করেছিল ভয়াবহ শেলিং । পাকিস্তানি সেনা বাহিনী আগরতলার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান বেছে নিয়ে গোলা ছুড়েছিল। পশ্চিম কোতোয়ালি এবং মেইন পোস্ট অফিসকে নিশানা করে ওদের ছোড়া গোলা এসে পড়েছিল মধ্য পাড়ায়। বনমালীপুরে সেই সময়ের পাওয়ার হাউসকে লক্ষ্য করে ছোড়া গোলা গিয়ে পড়েছিল এক ইঞ্জিনিয়ারের কোয়ার্টারে। আর ঢাকা হাউস'কে লক্ষ্য করা শেল গিয়ে পড়েছিল আমাদের বাড়ির ঠিক ডানদিকে সৌমেন ঠাকুরের উঠোনে। আমাদের বাড়িতে বৃষ্টির মতো আছড়ে পড়েছিল স্প্লিন্টার। ড্রয়িং রুমের জানলার কাঁচ ভেঙ্গে গিয়েছিল। সৌমেন ঠাকুরের বাড়ির উঠোনে মুচড়ে পড়ে গিয়েছিল মস্তো বাতাবী লেবুর গাছ। মারা গিয়েছিল দু' জন। সেই শেল যদি লক্ষ্যভ্রষ্ট না হয়ে আমাদের ঢাকা হাউসের ওপর আঘাত হানতো - আমরা কেউ সেই রাত্তিরে বাঁচতাম না। একাত্তরের স্মৃতি চারণ বা আজ এই লেখার কথা উঠতোই না! এর ক'দিন পরে দেখেছি আমাদের বাড়ির সামনে দিনরাত ভারতীয় সেনা বাহিনীর একের পর এক কামান টানা কনভয়, ট্যাঙ্ক, খচ্চরের আখাউড়া মুখী অভিযান। এর যেন আর শেষ নেই। টানা সপ্তাহ খানেক নন স্টপ এই চলাচল ছিল। ইংরেজিতে একে বলে ম্যাসিভ মিলিটারি বিল্ট আপ। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতাম সাঁজোয়া বাহিনীর অভিযান। মনে আছে একবার সাইরেন বাজা মাত্র খচ্চরগুলি সার বেঁধে রাস্তায় বসে গিয়েছিল। মিলিটারি ট্রেনিং বলে কথা। আমাদের রাজ্যের ওপারে দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তে যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল পুরো দস্তুর।

এক রাত্তিরে আমরা সবাই বাঙ্কারে ঘুমিয়ে আছে। রাত তখন প্রায় তিনটে । হঠাৎ আমাদের বাঙ্কারের সামনে কে যেন কাতর কণ্ঠে ডাকাডাকি করছে, ‘’কোই হ্যায়। থোড়া মদদ কিজিয়ে প্লিজ। ‘’ আমাদের ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল । সবাই অবাক। বাবা উঠে বসলেন। বাঙ্কারের দরজা খুলে বেরোলেন। আমরাও উঁকি দিলাম। দেখি আঁধারের মাঝে দু’জন লোক দাঁড়িয়ে আছে। তারা বাবাকে হিন্দিতে বলেছিলেন, কিছু কাজে আগরতলার কুঞ্জবনে এসেছিলেন। যুদ্ধ লাগায় সব বন্ধ বলে আটকা পড়েছেন। নিজের রাজ্য থেকে পরিবারের বার্তা এসেছে। কিছু ইমারজেন্সি হয়েছে । তাই যে কোনও ভাবেই হোক দেশে ফিরতে হবে। পরিবারের বার্তা পেয়েই রাতেই হেঁটে এসেছে আগরতলায়। সকাল হলেই গাড়ি ভাড়া করে চলে যাবে। আজকের হাড় কাঁপানো শীতের রাতটা যদি এই বাড়িতে মাথা গোঁজার ঠাই হয় তবে কৃতজ্ঞ থাকবেন। আমাদের জমি বাড়ি তখনও বিশাল। বাবা তাদের একটা খালি ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। সকাল বেলায় বাবা গিয়ে দেখেন তারা উধাও। বাবা পরে বলেছিলেন, লোকদু’টিকে আশ্রয় দেওয়া ঠিক হয় নি । ওরা ডিজার্টার। ভারতীয় সেনাবাহিনীরই সদস্য। ফ্রন্ট থেকে পালিয়েছে।

তবে একাত্তরে ভারতীয় সেনা বাহিনীর বীরত্বগাথাও কম নয়। একাত্তরের ৩/৪ ডিসেম্বরের ভয়াবহ রাতে, কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) ও পি কোহলি (তখন একজন ক্যাপ্টেন) ১৪ গার্ডের ব্রাভো কোম্পানির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। রেজিমেন্টটি আগরতলা থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে গঙ্গাসাগরে একটি ভারী সুরক্ষিত পাকিস্তানি অবস্থান দখল করার দায়িত্ব পেয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানি সেনা বাহিনী দুর্ভেদ্য প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। তখন রেজিমেন্টের সদস্য অ্যালবার্ট এক্কা গোলাগুলি উপেক্ষা করেই শত্রুপক্ষের বাঙ্কারের সামনে এগিয়ে যান। বাঙ্কারে প্রবেশ করে সম্মুখ সমরে তিনি একাই শত্রুদের নিকেশ করেন। মুক্ত হয় পাকিস্তানি ঘাঁটি। কিন্তু গুলি লেগেছিল তাঁর শরীরেও। মারাত্মক ভাবে জখম হয়েছিলেন তিনি। দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন তিনি। পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর ক্রমাগত গোলা বর্ষণ থেকে সুরক্ষিত করেন শহর আগরতলাকেও।

দেশের সামরিক ইতিহাসে,১৯৭১’র যুদ্ধে এমন ভূমিকার জন্য ল্যান্স-নায়েক আলবার্ট এক্কাকে মরণোত্তর ভারতের সর্বোচ্চ যুদ্ধকালীন বীরত্ব পুরস্কার, পরম বীর চক্র অর্পণ করা হয়। ২০০০’এ ৫০ তম প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে, ভারত সরকার একটি পোস্টাল স্ট্যাম্প জারি করে তাঁর স্মৃতিতে । পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর আগ্রাসন থেকে আগরতলাকে বাঁচানোর জন্য আজ শহরে তাঁর নামে একটি ইকো পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। এই ইকো পার্ক আজ আলবার্ট এক্কা পার্ক নামে পরিচিত। একাত্তরের যুদ্ধের সঙ্গে আগরতলাবাসীরও হৃদয় আর মননে অপরিহার্যভাবে জড়িয়ে আছে ল্যান্স-নায়েক আলবার্ট এক্কা’র নাম !

প্রথমদিকে নাকি অগ্রসরমুখীন ভারতীয় সেনাবাহিনীর হতাহতের সংখ্যা ছিল যথেষ্ট। বিশ্বের সর্বত্র রণাঙ্গনে এটাই হয়ে থাকে বরাবর। প্রতিরোধকারী শত্রুপক্ষের আঘাতে সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় অ্যাডভান্স কলাম । প্রথমাবস্থায় ভারতীয় সেনাবাহিনিকেও এই ক্ষতিটা সামলাতে হয়েছিল। আর রণকৌশলগত কারণেই ভারত যুদ্ধটা চালিয়েছিল উত্তরপূর্ব দিক থেকে। উত্তরপূর্বের মধ্যে যুদ্ধের ভারতের ফ্রন্টলাইন স্টেট ছিল ত্রিপুরা। ভারতের এই ছোট্ট রাজ্যটিকেই একাত্তরের যুদ্ধের ঘাত প্রতিঘাত সইতে হয়েছে সবচেয়ে বেশি।

এদিকে যুদ্ধের অল্প ক’দিন পরেই শুনতে পেয়েছিলাম ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে মার খেয়ে পিছু হটছে পাকিস্তানি সেনা বাহিনী। বড়রা সবাই তখন নিয়ম করে আকাশবাণী দিল্লি আর কলকাতার বাংলা সংবাদ কান পেতে শুনতেন। বিশেষ করে সাংবাদিক দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়ের ভরাট কণ্ঠে যুদ্ধের খবর সংক্রান্ত পাঠ শোণার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। রেডিওতেই সেই সময় বহুবার শুনেছি ১৯৭১-এর ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’এর বজ্র নির্ঘোষ কণ্ঠে স্বাধীনতা ঘোষণার অন্তর্ভুক্ত সেই বিখ্যাত রেকর্ডেড উক্তি, ‘’সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।" শুনেছি ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১’এ পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান’এর উর্দু ভাষণও। আমি কিছুই বুঝতে পারিনি । বোঝার কথাও নয়। বড়রা ইয়াহিয়া’র ভাষণ শুনে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল, ‘’ ভাষণ দেবে কী। এতো জড়িয়ে কথা বলছে। কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে মদ খেয়ে টাল হয়ে আছে।

এর আগে ঘটে গিয়েছিল আরও কিছু নাটকীয় ঘটনা। একদিন সকাল বেলায় দেখি কান ফাটানো তুমুল গর্জন করে ভারতীয় ফাইটার আমাদের দালানের ছাদের ওপর দিয়ে উড়ে গেল পশ্চিম দিকে । চোখের পলকে ঘটে গেল গোটা ঘটনা। নীল আকাশের বুকে রয়ে গেল কয়েকটি সাদা সমান্তরাল রেখা। বাবা সেদিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ওরা ঢাকায় পাক বাহিনীর হেড কোয়ার্টারে বম্বিং করার জন্য অভিযান চালিয়েছে। ফাইটারগুলি ফিরে আসতে খুব বেশি সময় নেয় নি। একই ভাবে ওরা ফিরে গিয়েছিল পূব দিকে - নিজেদের বেইসে। এসব ঘটনা আমার কাঁচা মনে চিরতরে দাগ কেটেছিল। আজও ভুলতে পারি নি শৈশবে দেখা যুদ্ধের সেই ঘনঘটা। আজও কেন জানি না বারবার স্বপ্নে দেখি আকাশে উড়ে যাচ্ছে যুদ্ধ বিমান ! আজ জেনোসাইড নিয়ে যখন পড়তে শুরু করি - যুদ্ধের ভয়াবহতায় আরও বেশি করে কেঁপে উঠি। ম্যাচিসমো'র জয়গান তো আমরা সবাই অতি সহজেই গাইতে পারি। কিন্তু মানবিকতার উষ্ণতা কী অত সহজে সর্বত্র ব্যাপ্ত করা যায় ! বিশ্বাস করি আন্তরিকতা, সদিচ্ছা, শুভবোধ থাকলে মানবিকতার মাধ্যমেই বিশ্বজয় সম্ভব। বিভাজনের পরিবর্তে ঐক্যের মাধ্যমেই সম্ভব এই ইপ্সিত বিশ্বশান্তি। একাত্তর আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। যুদ্ধের মোড়কে আসলে টক্সিক ম্যাসকুল্যানিটির ধ্বজা উড়ানোর জন্য শিশু আর মহিলার ওপর অত্যাচার কখনই চাই না। অনেক পাপের ভারে ধ্বস্ত হয়েছে পৃথিবী। চিরতরে বন্ধ হোক এর পুনরাবৃত্তি । আজ তাই সবার কণ্ঠেই ধ্বনিত হোক জন লেননের সেই যুদ্ধবিরোধী গান, "গিভ পিস আ চান্স" ...


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.