।। গুমনাম হে কহি ।।
অরিন্দম নাথ
আমাদের এক ডিজিপি ছিলেন বি জে কে থাম্পি ৷ ভীষণ ধার্মিক লোক ৷ সাঁই বাবার শিষ্য ৷ একমাত্র ছেলের নামও রেখেছিলেন সাঁই ৷ আমার স্ত্রী পারমিতার ছোটবেলার বন্ধু ৷ তাদের ছোটবেলা কেটেছে কুঞ্জবনের কোয়ার্টারে ৷ সেই সূত্রে পরিবারটির সঙ্গে পরিচিতি ৷ আমি রেজিস্ট্রি বিয়ে করেছিলাম ৷ থাম্পি সাহেব আমার বিয়ের একজন সাক্ষী ৷ স্যার তখন ত্রিপুরার বাইরে পোস্টেড ৷ জানুয়ারি মাস ৷ তীর্থমুখে উত্তরায়ণের মেলা বসেছে ৷ অনেকেই গোমতী নদীতে অবগাহন করে পিতৃপুরুষের নামে তর্পণ করছেন ৷ এই ভিড়ের মধ্যে স্যার এসে হাজির হয়েছেন ৷ সাধারণ মানুষের বেশে ৷ আমাদের পুলিশ সদর থেকে এই খবর পাওয়ার পর খোঁজ খোঁজ রোগ শুরু হয়ে গেল ৷ শেষমেষ স্যারকে আবিষ্কার করা হল গোমতী নদীর জলে ৷ স্নান করছেন ৷ শঙ্কু মহারাজ একটি বইয়ে লিখেছিলেন, “সবতীর্থ বারবার, গঙ্গাতীর্থ একবার ৷”
আমাকে তীর্থমুখ বারবার ডেকেছে ৷ প্রথম দর্শন ১৯৭৮ সালে ৷ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর ৷ মুড়ির টিন বাসে চড়ে ৷ তখন ত্রিপুরায় মুড়ির টিন বাসই চলত ৷ ছোট আকৃতির বাসগাড়ি ৷ যাত্রীদের মুড়ির মত ঠেসে পোড়া হত ৷ কথায় বলে শ্যাক দ্য বটল্ বিফোর ইউজ ৷ ঝাঁকানি দিয়ে মুড়ির টিন বাস সর্বদাই লোকেদের ব্যবহারের উপযোগী করে দিত ৷ সেটা ছিল আমাদের পারিবারিক সফর ৷ আমার এক কাকু ছিলেন পূর্ত দপ্তরের বাস্তুকার ৷ আশুতোষ দেবনাথ ৷ তাঁর শ্বশুর বাড়ি অমরপুরের রঙ্গামাটিতে ৷ তাঁর এবং তাঁর পরিবারের লোকজনদের সাথে গিয়েছিলাম ৷ আতিথেয়তা ছিল সত্যি উল্লেখ করার মত ৷
কয়েক বছর হয়েছে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু হয়েছে ৷ তখনকার ডুম্বুর ছিল অনেক ঝক্ ঝকে পরিষ্কার ৷ উগ্রবাদীদের কোনও আনাগোনা ছিল না ৷ এর আগে পর্যন্ত আমি কোনও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প দেখিনি ৷ সব মিলিয়ে গোমুখ, মন্দিরঘাট, ডুম্বুর বিদ্যুৎ প্রকল্প, সাথের ব্যারেজ, পাওয়ার হাউস এবং সাথের অমলিন প্রাকৃতিক পরিবেশ আমাকে মুগ্ধ করেছিল ৷ আমার কৈশোর মনে অনেক প্রশ্ন উঁকি ঝুঁকি দিয়েছিল ৷ টারবাইন কিভাবে ঘুরে ? ঘড়ির কাঁটা ধরে না উল্টো ভাবে ? জলকে কেন টানেলিং করে পাহাড়ের উপর তোলা হয় ? এই এলাকার স্লেট পাথরের বয়স কত ? এমনি অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বাস্তুকার কাকু আমাকে সেদিন ঋদ্ধ করেছিলেন ৷ তখনও অপকেন্দ্রিক বলের সাথে পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে আমার পরিচয় ঘটেনি ৷ তবে সেদিন এতটুকু বুঝেছিলাম বৃত্তাকারে কোনও কিছুকে চক্কর কাটালে এর মধ্যে অতিরিক্ত বল এসে যুক্ত হয় ৷
তীর্থমুখের সাথে আমার ভালোবাসা ছিন্ন হয় না ৷ পুলিশের চাকুরীতে যোগ দেবার পর প্রশিক্ষণার্থী হিসাবে আমার প্রথম পোস্টিং হয় নতুন বাজার থানায় ৷ সেটা ১৯৯২ সালের জানুয়ারি মাস ৷ তখন আবার উগ্রপন্থা আমদের রাজ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ৷ পুলিশে যোগ দিয়ে ডুম্বুর নিয়ে একটি তথ্য জানতে পারি ৷ উগ্রবাদীদের একটি বড় অংশ এসেছে ডুম্বুর জলাশয়ের কারণে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া পরিবারগুলো থেকে ৷ এখানে হয়তো সরকারের স্বদিচ্ছার কোনও অভাব ছিল না ৷ উচ্ছেদকৃতদের পুনর্বাসনের দায়িত্বে যারা ছিল তারা ঠিক ভাবে কাজ করেনি ৷ অসাধু পন্থার অবলম্বন করেছিল ৷ প্রথম জঙ্গী বিরোধী অপারেশনও করেছিলাম এই এলাকায় ৷ এর বিবরণ অন্যত্র দিয়েছি ৷
আমি দক্ষিণ জেলায় আবার যোগ দিই ২৬ শে অক্টোবর ১৯৯৮ তারিখে ৷ এডিশনাল এসপি, অপারেশন হিসেবে ৷ আরেকজন অতিরিক্ত এসপি ছিলেন ৷ হিমাংশু গুপ্তা ৷ এসপি ছিলেন শ্রীযুক্ত বি কে রায় ৷ দুই দিনের মাথায় তীর্থমুখ থেকে ডাক আসে ৷ ২৮ শে অক্টোবর ১৯৯৮ তারিখে বিকেলে তীর্থমুখ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের তিনজন ইঞ্জিনিয়ার গিয়েছিলেন পায়চারি করতে বেরিয়েছিলেন ৷ কড়ইছাড়া এলাকায় ৷ সঙ্গে তীর্থমুখ প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার ডা. প্রণব দেববর্মা ৷ বৈরীরা দূর্গাপ্রসাদ গোছাইত ও বিকাশ দাস নামে দুইজন ইঞ্জিনিয়ার এবং ডাক্তারকে অপহরণ করে ৷ রবীন্দ্র কুমার দে নামে একজনকে হত্যা করে ৷ ডা. প্রণব দেববর্মাকে কিছু পরে ছেড়ে দেয় ৷ দুর্গাপ্রসাদ গোছাইত ছিলেন এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার ৷ বিকাশ দাস এবং রবীন্দ্র কুমার দে জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার ৷ তাঁরা ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের লাগোয়া বাংলায় থাকতেন ৷
সেখানে নিরাপত্তার জন্য এক কোম্পানি সিআরপিএফ মোতায়েন ছিল ৷ পাহাড়ের মধ্যে দুই কিলোমিটার জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র ৷ উগ্রপন্থীদের দাবী ছিল ডুম্বুরের বাঁধ ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য ৷ কারণ ত্রিপুরায় প্রচুর গ্যাস পাওয়া গিয়েছে ৷ গ্যাসকে ভিত্তি করে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে উঠছে ৷ গোমতী নদীতে বাঁধ দেওয়ার ফলে প্রচুর লোক গৃহহারা হয়েছে ৷ অনেক পরিবারের সদস্য উগ্রপন্থায় যোগ দিয়েছে ৷ ভেঙ্গে দিলে অনেক লোককে পূনর্বাসন দেওয়া যাবে ৷ এর আগে এমএনএফকে সঙ্গে নিয়ে টিএনভি বৈরীরাও ডুম্বুরের পাহারার উপর আক্রমণ করেছিল ৷ সবমিলিয়ে একটা ভয় ছিল বৈরীরা বাঁধের ক্ষতি করতে পারে ৷ ডুম্বুরের খুব কাছে বাংলাদেশ সীমান্ত ৷ ফলে খুব সহজেই উগ্রবাদীরা ওপার থেকে যাতায়ত করত ৷ তখন সেই অঞ্চলে এটিটিএফ উগ্রবাদীদের রমরমা ছিল ৷
দুর্গাপ্রসাদ গুছাইত, ডা. প্রণব দেববর্মা, রবীন্দ্র কুমার দে ও বিকাশ দাস প্রতিদিন বিকেলে পায়চারি করতেন ৷ করইছড়া অবধি যেতেন ৷ আধা কিলোমিটারের মতো রাস্তা ৷ সেখানে ঝর্ণার আকারে অতিরিক্ত জল গড়িয়ে পড়তে দেওয়া হয় ৷ সিআরপিএফের সেন্ট্রি পোস্ট থেকে খানিকটা দেখা যেত ৷ বাঁ-পাশে পাহাড় ৷ খানিকটা দূরে কড়ইছড়া রিয়াং বস্তি ৷ উগ্রবাদীরা তাঁদের রুটিন চলাফেরা লক্ষ্য করছিল ৷ সেদিন সন্ধ্যার সময় বন্দুকের মুখে চারজনকে অপহরণ করতে চায় ৷ রবীন্দ্রবাবু ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত নৌসেনা কর্মী ৷ তিনি বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করেন ৷ বৈরীরা তাঁকে গুলি করে ৷ তিনি সেখানেই মারা যান ৷ বাকি তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে যায় ৷ পরদিন ডাক্তারবাবু ফিরে আসেন ৷ কিছুটা দূরে নিয়ে গিয়ে তাঁকে উগ্রপন্থীরা ছেড়ে দিয়েছিল ৷ সম্ভবত উপজাতি বলে ৷ তিনি অল্প বিস্তর আহত হন ৷
পরদিন এসপি সাহেবের সঙ্গে আমি ঘটনাস্থলে যাই ৷ ঘন্টা দেড়েক সাক্ষীদের সঙ্গে কথা বলি ৷ ডা. প্রণব দেববর্মাকে পাই না ৷ তিনি চিকিৎসার জন্য আগরতলা চলে গিয়েছিলেন ৷ আমরা ঘটনার রি-কনস্ট্রাকশন করি ৷ ঘটনার পর সিআরপিএফ এগিয়ে গেলে তাদের সঙ্গে গুলি বিনিময় হয় ৷ ততক্ষণে অন্ধকার নেমে এসেছে ৷ বৈরীরা অপহৃতদের নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় ৷ আমরা সেই রাস্তা ধরে এগিয়ে যাই ৷ কড়ইছড়া বস্তিতে দশ পনেরটি রিয়াং পরিবারের বাস ৷ একটি অঙ্গনাদি কেন্দ্র ৷ এরপর উঁচু পাহাড় ৷ প্রায় নাক বরাবর ৷ পাথুরে জমির মধ্য দিয়েই কড়ইছড়া বয়ে চলেছে গোমতীর দিকে ৷ কড়ইছড়ার মধ্যে দিয়েই পায়ে চলা পথ ৷ কয়েকটি গুলির খালি খোকা পাই ৷ একে সিরিজ বন্দুকের ৷ বুঝতে পারি বৈরীরা সেখান থেকেই গুলি চালিয়েছিল ৷ দুপুর রোদ্দুরের মধ্যে পাহাড়ে চড়তে বেশ কষ্ট হয় ৷ পাহাড়ের উঁচুতে অন্নরামপাড়া ৷ সেখান থেকে ডান দিকে রাস্তায চলে গেছে সাতভাইয়া চাকমাপাড়া হয়ে ডুম্বুর জলাশয়ের দিকে ৷ আর বাঁদিকের রাস্তা বাইগনছাড়া, মুক্তদয়ালপাড়া হয়ে লেবাছাড়া মুখ দিয়ে নতুনবাজার ৷ একজন অফিসারের নেতৃত্বে একটি অপস্ পার্টিকে দায়িত্ব দেওয়া হয় আগে গিয়ে খোঁজ করার জন্য ৷ আমরা আবার পাহাড় থেকে নেমে আসি ৷ আমাদের সঙ্গে সাধন নন্দী ৷ নতুনবাজার থানার ওসি ৷
এই ঘটনার সরাসরি যুক্ত কোন বৈরীকে আটক করতে সক্ষম হই না ৷ আমি সবে জেলায় যোগ দিয়েছিলাম । নিজের কোন ধারনাই ছিল না ৷ বৃক্ষরাম রিয়াং নামে একজন বৈরী সহযোগী আটক হয়েছিল ৷ তার বাড়ি পাহাড়পুরে ৷ অপহৃতের আত্মীয়-স্বজনেরা তার মাধ্যমে মুক্তিপণের টাকা পাঠাত ৷ এনিয়ে দুর্গাপ্রসাদ গোছাইতের পরিবার আমাদের উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন । মোট নয় লক্ষ টাকা দিয়েছিল বলে প্রকাশ ৷ গোছাইত ছিলেন মেদিনীপুরের বাসিন্দা ৷ শোনা তাঁর বাবা লন্ডনে অ্যামিনস্টি ইন্টারন্যাশনেলের মধ্যমে এটিটিএফের সুপ্রিমো রঞ্জিৎ দেববর্মাকে অনুরোধ করেছিলেন ৷ তাঁর ছেলেকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য ৷ তিনি ত্রিপুরার বাঙালি নন ৷ দুর্গাপ্রসাদ গোছাইত মুক্তি পান ৷ বিকাশ দাস পান না ৷ আমি পরে রঞ্জিত দেববর্মাকে এই বিষয়টি নিয়ে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম ৷ সে না জানার ভাব করে ৷ বিষয়টি আমার কাছে রহস্য ৷ ওনার বাড়ি ছিল বিলোনিয়ায় ৷ বামপন্থী পরিবার ৷ বৈরীরা টাকাও নিয়েছিল ৷ পুলিশের কাজ সন্দেহ করা ৷ ডাক্তারবাবু কি জড়িত ছিলেন ? বিকাশবাবু ফিরে এলে হয়তো অনেক রাজ প্রকাশ পেত ৷