ত্রিপুরার বাংলা সাহিত্য : কিছু তথ্য কিছু কথা

শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ

গুয়াহাটিতে অনুষ্ঠিত সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনেল রাইটার্স মিট'এ (১৫ -১৯ নভেম্বর, ২০২৩) নয় দেশের কবি সাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে ভালো লেগেছিল। ভালো লেগেছিল গুয়াহাটির কটন কলেজ আর দিশপুর মহাবিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের মুহূর্তগুলি। ওরা অনেকেই আমার লেখালিখির সঙ্গে পরিচিত। অনেকে আবার লেখালিখি পড়ার সুযোগ না পেলেও আমার নাম শুনেছে। অসাধারণ হয়ে উঠেছিল সাহিত্য বিষয়ক আমাদের ইন্টারঅ্যাক্টিভ সেশন। ত্রিপুরা তথা উত্তরপূর্ব ভারতের সাহিত্য নিয়ে বিশেষ করে কটন কলেজের পড়ুয়াদের আগ্রহ আর ঔৎসুক্য আমায় মুগ্ধ করেছিল। ত্রিপুরা প্রসঙ্গে এই কথাই বলেছিলাম, আমাদের সাহিত্য ... বাংলা সাহিত্য যথেষ্ট ঐতিহ্যময়। ত্রিপুরার রাজপরিবারের ইতিবৃত্ত ‘’রাজমালা’’ লিখিত হয়েছিল বাংলায়। রাজা ধর্মমাণিক্যের রাজত্বকালে (১৪৩১ খ্রিষ্টাব্দে) বাংলা পদ্যে রচিত প্রথম রাজমালা কালানুক্রমিকভাবে চৈতন্য চরিতামৃত এবং কৃত্তিবাসী রামায়ণের থেকেও প্রাচীন। তবে ত্রিপুরি রাজবংশের ইতিবৃত্ত লিখিত হয়েছিল রাজমালার থেকেও প্রাচীনতম আরও একটি গ্রন্থে। গ্রন্থটির নাম ‘’রাজাবলী’’। দুস্প্রাপ্য এই গ্রন্থটি এক সময় এশিয়াটিক সোসাইটিতে পাওয়া যেতো। পরে তা হারিয়ে যায় ! মেলে নি পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক গ্রন্থটির আর কোনও হদিশ। কিন্তু ১০০০ বছর আগেও ত্রিপুরার রাজ দরবারে যে বাংলা ভাষা চর্চিত হতো রাজাবলী তারই প্রমাণ। ত্রয়োদশ শতকে রাজ ভাষা হিসেবে গোটা বিশ্বে বাংলাকে প্রথম স্বীকৃতি দেয় রাজন্য ত্রিপুরাই। রবীন্দ্র প্রতিভার প্রথম স্বীকৃতি প্রদানের কৃতিত্বও এই রাজ্যের। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রচার প্রসারে পার্বত্য রাজ্য ত্রিপুরার ঐতিহাসিক অবদান তাই অনস্বীকার্য।

রাজন্য আমল অবসানের পর প্রতিভাবান বাঙালি কবি সাহিত্যিকেরা ত্রিপুরার বাংলা সাহিত্যের ধারাকে বহমান রেখেছেন। তবে ত্রিপুরার বাংলা সাহিত্যের মৌলিকত্ব এবং মৃত্তিকা গন্ধ কিন্তু ব্যাপ্ত করেছেন ত্রিপুরি, মণিপুরি, চাকমা, সাঁওতালি কবি সাহিত্যিকেরাই। ত্রিপুরার মিশ্র সংস্কৃতির সৌরভ ব্যাপ্ত হয়েছে এঁদের সাহিত্য সৃজনে। ত্রিপুরি রাজনন্দিনী অনঙ্গমোহিনী (দেববর্মা) দেবীর হাতে সূচিত হয়েছিল ত্রিপুরার আধুনিক বাংলা কবিতার শুরুয়াত। তাঁর “শোকগাথা”, “কণিকা”, “প্রীতি” নামক কাব্যগ্রন্থগুলি ত্রিপুরার কাব্যচর্চার ইতিহাসে সম্পদ বিশেষ । পরিশীলিত বাংলায় কবিতা লিখতেন অনঙ্গমোহিনীর পিতা মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য। তাঁর রচিত হোরি গীতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বীরচন্দ্র মাণিক্যের কাব্য প্রতিভার নিদর্শন রয়েছে “হোরি”, “ঝুলন গীতি”, “প্রেম মরীচিকা”, “উচ্ছ্বাস”, “অকাল কুসুম” এবং “সোহাগ” গ্র্ন্থে।

ত্রিপুরায় বাংলা গদ্যের প্রথম পথচিহ্ন নির্দিষ্ট করেছিলেন নবদ্বীপ চন্দ্র দেববর্মা, সতীশ দেববর্মা, বড় ঠাকুর সমরেন্দ্র দেববর্মা, কর্নেল মহিম ঠাকুর প্রমুখ। নবদ্বীপ চন্দ্র দেববর্মার "আবর্জনার ঝুড়ি" অত্যুৎকৃষ্ট গদ্য হিসেবে সাহিত্য বোদ্ধাদের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে। ত্রিপুরার গদ্য সাহিত্যে বলিষ্ঠতার স্বাক্ষর হিসেবে উজ্জ্বল হয়ে আছে করবী দেববর্মা সঙ্কলিত এবং সম্পাদিত "সতীশ দেববর্মার রচনা সমগ্র" নামক গ্রন্থটি । বড় ঠাকুর সমরেন্দ্র দেববর্মা তাঁর জীবদ্দশাতেই কথা সাহিত্যিক হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। তাঁর "আগ্রার চিঠি", "ভারতীয় স্মৃতি", "ত্রিপুরার স্মৃতি" এবং "জেবুন্নিসা বেগম" নামক গ্রন্থগুলি ত্রিপুরার কথা সাহিত্যের অন্যতম নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত। রাজন্য আমলের অবসানের পর সলিল কৃষ্ণ দেববর্মা, করবী দেববর্মা, ধবল কৃষ্ণ দেববর্মা, সলিল দেববর্মা, সবিতা দেববর্মা, বিজয় দেববর্মা, মানস দেববর্মা, খগেশ দেববর্মা, রাতুল দেববর্মা, পাঞ্চালি দেববর্মা প্রমুখ তাঁদের সাহিত্য কৃতির মাধ্যমে ত্রিপুরার বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন। সঙ্গীত নাটক একাডেমীর সদস্য সলিল কৃষ্ণ দেববর্মার "জলের ভেতর বুকের ভেতর" শুধু সাহিত্য সমালোচকদের দ্বারাই প্রশংসিত হয় নি; পাঠক সমাদৃত কাব্যগ্রন্থ হিসেবেও স্বীকৃত হয়েছে । "অনার্য কন্যা" করবী দেববর্মা কবি এবং প্রাবন্ধিক হিসেবে সর্বত্র প্রভূত প্রশংসিত হয়েছিলেন। তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য এবং চর্চিত কাব্যগ্রন্থ হল "লুণ্ঠিত সময় সীতা"। অন্যতম বরিষ্ঠ বুদ্ধিজীবী এবং সমাজসেবী সলিল দেববর্মার প্রবন্ধ সঙ্কলন ""ত্রিপুরায় জনশিক্ষা আন্দোলনের ইতিহাস"" আক্ষরিক অর্থেই পার্বত্য রাজ্যটির জন আন্দোলনের এক প্রামাণ্য গ্রন্থ। মানস দেববর্মার ‘’স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী’’ নামক গল্পে আসলে পরিস্ফুট হয়েছিল আগরতলায় বাসরত শিক্ষিত এবং স্ব-জাতির ভাষা ককবরক না জানা অথচ বাংলা বলা ত্রিপুরিদের আইডেন্টি ক্রাইসিসের কথা ! তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের নাম ‘’পাঁচ টাকা দশ টাকার গল্প’’। রাজ পরিবার সঞ্জাত ত্রিপুরার ঐতিহ্যবাহী মিশ্র সংস্কৃতির বিভিন্ন মনোগ্রাহী দিক প্রাঞ্জল এবং সুললিত ভাষায় বিবৃত করেছেন মহারাণী ভানুমতী দেবীর প্রপৌত্রী সবিতা দেববর্মা তাঁর ‘’পাতার ভেলা ভাসাই নীরে’’ নামক আত্ম জৈবনিক গ্রন্থে। শুধু সাহিত্য সমালোচক এবং পাঠকদের দ্বারাই অভিনন্দিত নয়; ইতিহাসবেত্তাদের কাছেও সবিতা দেববর্মার বইখানি সমাদৃত এবং অমূল্য হিসেবে গৃহীত হয়েছে।

উল্লিখিত আগরতলাবাসী কবি সাহিত্যিকেরা সবাই কোনও না কোনও রকম ভাবে রাজ পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত। পারিবারিক আভিজাত্য সত্বেও এঁদের সবার লেখাতেই উচ্চারিত হয়েছে ত্রিপুরার মাটি, সাধারণ জন মানুষের কথা। এঁদের রচনাকর্ম পড়লে বহিঃরাজ্যের দীক্ষিত পাঠক বুঝতে পারেন, লেখাগুলি ঠিক বৃহত্তর বাংলা সাহিত্যের মতো নয়। আসলে অ-বাঙালি কবি সাহিত্যিকদের অবদানেই পল্লবিত হয়েছে ত্রিপুরার বাংলা সাহিত্য। তাই চাকমা হলেও মৌলিকতার গুণে ত্রিপুরার বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন যোগমায়া চাকমা। রাজ্যের বাংলা সাহিত্যের চর্চাকে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছেন মণিপুরি কবি সাহিত্যিক অমর সিনহা, সমরজিৎ সিনহা, ডঃ অশোক সিনহা, ওয়াংখেম বীরমঙ্গল, রাজকুমার তরুণজিৎ সিনহা এবং একামেবাদ্বিতীয়ম বিমল সিনহার মতো লেখকরা। চা বাগানে কর্মরত বিপ্লব উরাং'এর মতো অভিবাসিত সাঁওতালি কবি সাহিত্যিকেরাও ত্রিপুরার বাংলা সাহিত্যকে যথেষ্ট পরিমানে পরিপুষ্ট করেছেন।

ত্রিপুরি রাজ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বাংলার চর্চা ছিল; নিখাদ বাংলা ভাষায় সাহিত্য সৃজনে তাই তাঁদের ভাষাগত সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি । কিন্তু রাজ পরিবারের সদস্য না হলেও ত্রিপুরার বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে মৌলিকতার সমন্বয়ে আরও পুষ্ট এবং বেগবান করে তুলেছেন গ্রাম ত্রিপুরার কবি সাহিত্যিক সুধন্ব ত্রিপুরা, শ্যামাচরণ ত্রিপুরা, নগেন্দ্র জমাতিয়া, চন্দ্রকান্ত মুড়াসিং, নন্দকুমার দেববর্মা, বিকাশরাই দেববর্মা, কবি সবিতা দেববর্মা, মধুসূদন দেববর্মা, ধরিঞ্জয় ত্রিপুরা, এন সাচালাং ত্রিপুরা সহ আরও অনেকেই। এঁরা আদতে কেউই বঙ্গ সন্তান নন; মাতৃভাষাও বাংলা নয়। এঁদের লেখাতে তবু সৃজিত হয়েছে ত্রিপুরার বাংলা সাহিত্যের বেশ কিছু ক্ল্যাসিকস। সুধন্ব দেববর্মার ককবরক উপন্যাস হাচুক খুরিও ... বাংলায় অনূদিত "পাহাড়ের কোলে" সামগ্রিকভাবে উত্তরপূর্ব ভারতের সাহিত্যে এক অন্যতম মাইলস্টোন। একই রকম ভাবে ত্রিপুরা তথা উত্তরপূর্ব ভারতের বাংলা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদ হয়ে উঠেছে শ্যামাচরণ ত্রিপুরার সূক্ষ হিউমার মেশানো রম্য রচনাবলী "চরণ চন্তাইয়ের ঝুলি"। নন্দ দেববর্মার গদ্য এবং পদ্য ত্রিপুরার বাংলা সাহিত্যকে আজও সমৃদ্ধ করে চলেছে। তুখোড় বাংলা গদ্য লিখে চলেছেন বিকাশরাই দেববর্মা। অসাধারণ কিছু বাংলা কবিতা লিখেছেন কবি এন সাচালাং ত্রিপুরা।

আমরা তাই গর্বের সঙ্গে বলি, ললিত কলার দেশ বলে খ্যাত ত্রিপুরার বাংলা সাহিত্যের অরিজিন্যাল ফ্লেভার পাওয়া যায় ত্রিপুরি, মণিপুরি, চাকমা, সাঁওতালি কবি সাহিত্যিকদের লেখায়। জাতিগত কিম্বা ভাষাগত ভাবে ত্রিপুরি, মণিপুরি, চাকমা, সাওতালিরা কেউ বঙ্গ সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত নয় এবং উল্লিখিত সব ক'টি সম্প্রদায়েরই নিজস্ব সমৃদ্ধ ভাষা সহ লোক সাহিত্যের ইতিহাস রয়েছে। তারপরেও ভালোবেসে সবাই পার্বত্য রাজ্যটির বাংলা ভাষার প্রচার এবং প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। এ-ই হল আমাদের মিশ্র সংস্কৃতির মাহাত্ম্য । আবারও বলছি এঁদের লেখাতেই রয়েছে ত্রিপুরার বাংলা সাহিত্যের স্বতন্ত্রতা; ভাষা বাংলা হলেও ত্রিপুরার এই লেখাগুলির বিষয় এবং আঙ্গিক গড়পড়তা বৃহত্তর বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে সাযুজ্য নয় একেবারেই। আর এখানেই নিহিত রয়েছে ত্রিপুরার সাহিত্যের সার্থকতা। সুনিপুণ দক্ষতায় এঁরা চিত্রায়িত করেন এই অঞ্চলের মাটি মানুষের কথা। মিশ্র সংস্কৃতির কথা। এঁদের সাহিত্যে অনুরণিত হয় অঞ্চলের লোকসংস্কৃতি, অরণ্যচারী জনজাতিদের জীবনচর্যার পদাবলী, বিলুপ্তপ্রায় পশুপাখির কাহিনী, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের বিষাদিত আখ্যান, উপত্যকায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অহংকৃত ঝঙ্কার, নগর সভ্যতার অপ্রতিরোধ্য আগ্রাসন, অরণ্য ধ্বংসের সকরুণ বিলাপ, নির্বিচারে প্রকৃতি পরিবেশ ধ্বংসের বিষণ্ণ কাহন। প্রকারান্তরে এই কবি সাহিত্যিকেরাই হয়ে উঠেন ত্রিপুরা, উত্তরপূর্ব ভারতের শাণিত কন্ঠস্বর। এইভাবেই সাঁঝুলি আকাশে ধ্রুবতারার মতো স্ব-মহিমায় দীপ্যমান হয়ে উঠে যাবতীয় মৌলিকতা সহ আমাদের রাজ্যের বাংলা সাহিত্য। অতীব গুরুত্বপূর্ণ অবদান সত্বেও আজ যে কোন কারণেই হোক, ত্রিপুরার বাংলা সাহিত্যের আলোকিত অঙ্গনে ত্রিপুরি, মণিপুরি, চাকমা, সাঁওতালি কবি সাহিত্যিকদের নামগুলি আলোচিত কিম্বা চর্চিত হয় না। নাম উল্লিখিত না হলেও ত্রিপুরার বাংলা সাহিত্যের স্বতন্ত্র ফ্লেভার কিম্বা অরিজিন্যালিটি সংস্থাপনে লিখিত ডক্যুমেন্ট হিসেবে কিন্তু রয়ে যায় ত্রিপুরি, মণিপুরি, চাকমা, সাঁওতালি কবি সাহিত্যিকদের অবিস্মরণীয় সব রচনা সম্ভার !


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.