মায়ানমারে অশান্তি,অনুপ্রবেশ পূর্বোত্তরে

পান্নালাল রায়

কুকিদের পৃথক প্রশাসনিক ব্যবস্থার দাবি জোরদার করার সঙ্গে সঙ্গে যেন মণিপুরের পরিস্থিতি উন্নতির সম্ভাবনাও প্রশ্নের মুখে পড়েছে।নিজেরাই পৃথক স্বশাসিত অঞ্চল গড়ে তুলবে কুকিদের এই হুমকির পর পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করার আশঙ্কা করা হচ্ছে।এদিকে মায়ানমারের গৃহযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মণিপুর ও মিজোরামে নতুন করে অনুপ্রবেশ সমস্যা প্রকট হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

গত প্রায় সাত মাস যাবৎ মণিপুরে তীব্র জাতি সংঘাত জনিত অশান্তি চলছে।রাজ্যের পরিস্থিতি স্বাভাবিক না করতে পারার জন্য রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার বিরোধীদের প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছিল বেশ আগেই।কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা মণিপুর সফর করেছেন।রাজ্যের নানা সংগঠনের সঙ্গে তারা আলোচনা করেছেন।স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশে রাজ্যে নানা ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে।নানা কমিটি,বৈঠক হয়েছে।কিন্তু অবস্থার তেমন কোনও উন্নয়ন পরিলক্ষিত হয়নি।মায়ানমার থেকে অনুপ্রবেশ, সংরক্ষিত বনাঞ্চলে আফিম চাষ,উচ্ছেদ অভিযান এবং মৈতেইদের জনজাতি ঘোষণা সংশ্লিষ্ট ইস্যু নিয়ে মণিপুরে মৈতেই ও কুকি-জো জনজাতিদের সংঘাত শুরু হয়েছিল। দিনে দিনে এই সংঘাতের তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকে।মৈতেই ও কুকিদের সংঘাতে দুই শতাধিক মৃত্যু সহ আহত হয় কয়েকশো লোক।হাজার হাজার ঘরবাড়ি ও দোকানপাটে লুটপাটের ঘটনা ঘটে।লুট হয় বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র। রাজ্যের সকল অংশের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের ঐকান্তিক চেষ্টা ও নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতায় জাতি সংঘাতের তীব্রতা মাঝে মাঝে কমলেও জাতি বিদ্বেষের মাত্রা কিন্তু বেড়েই চলেছে।পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে এলে আবার বিক্ষিপ্ত কোনও ঘটনা ঘিরে দেখা দেয় অশান্তি।উত্তপ্ত হয়ে উঠে মণিপুর। মাঝে মাঝে মহিলাদের নগ্ন প্যারেড, যুবকদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড -এই সব ভিডিও প্রচার ঘিরে মৈতেই ও কুকি-দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে হিংসার দাবানল।এই জাতি সংঘাতের সূত্র ধরেই মণিপুরে কুকি জনজাতিদের জন্য পৃথক প্রশাসনিক ব্যবস্থার দাবি উঠে। চলতি অশান্তিতে কুকিদের পক্ষ থেকে বারবার মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং তথা রাজ্য সরকারের প্রতি অনাস্হা প্রকাশ করে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ দাবি করা হয়েছে।পক্ষান্তরে রাজ্যে অশান্তির জন্য মায়ানমার থেকে মণিপুরে অনুপ্রবেশ, বেআইনি ভাবে আফিম চাষ সহ নেশা কারবারিদের দৌরাত্ম্যকে দায়ী করছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেছেন,বেআইনি মাদক কারবারের বিরুদ্ধে তাঁর সরকার চরম ব্যবস্থা নেয়ায় অনুপ্রবেশকারীরা চক্রান্ত করছে।তারাই অশান্তি ছড়াচ্ছে।তিনি আরও বলেছেন,মণিপুর মাদকের বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে আছে।ত্রিশ লক্ষ জনসংখ্যার রাজ্যের দেড় লক্ষই মাদকের শিকার। কিন্তু অবৈধ অনুপ্রবেশ, আফিম চাষ, মাদকের জাল বিস্তার ইত্যাদি রাতারাতি ঘটেনি।দীর্ঘদিন যাবতই এটা চলছে বলে ধারণা করা যায়।যাইহোক, যেভাবেই মণিপুরে বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হোকনা কেন,তার পরিণতিতে কিন্তু জাতি বিদ্বেষের তীব্রতা চরম আকার ধারণ করেছে।কুকিদের জন্য পৃথক প্রশাসনিক ব্যবস্থার দাবিও দিনকে দিন জোরদার হচ্ছে।মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য আগেই এই দাবি নাকচ করে দিয়েছেন।আর মুখ্যমন্ত্রী তথা তাঁর সরকারের উপর যে কেন্দ্রের আস্হা অটুট তারও ইঙ্গিত মিলছে বীরেন সিং এখন পর্যন্ত কুর্সিতে থাকার মাধ্যমেই।

এদিকে মণিপুরে মৈতেইদের সঙ্গে কুকিদের সহাবস্থানের বিষয়টি যেন দিনকে দিন প্রশ্ন কন্টকিত হয়ে উঠছে।মণিপুরের কুকি সংগঠন আইটিএলএফ অর্থাৎ ইন্ডিজেনাস ট্রাইবেল লিডারস ফোরাম স্বশাসনের পথে হাঁটার হুমকি দিয়ে বলেছে মৈতেইদের সঙ্গে আর সহাবস্থান নয়।মণিপুরের কুকি অধ্যুষিত এলাকাতে স্বশাসিত পৃথক অঞ্চল গঠনের ডাক দিয়েছে তারা।সম্প্রতি রাজ্যের কুকি অধ্যুষিত চূড়াচাঁদপুর জেলায় বিক্ষোভ সমাবেশ করে আইটিএলএফ কুকিদের জন্য এই পৃথক স্বশাসিত অঞ্চল গঠনের ডাক দেয়।তাদের অভিযোগ রাজ্যে কুকি-জোরা অবহেলার শিকার।আইটিএলএফ'র সাধারণ সম্পাদক মউন টম্বিং বলেন গত ছয় মাস ধরে আমরা মণিপুরে পৃথক স্বশাসন ব্যবস্থা চাইছি।কিন্তু আমাদের দাবিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছেনা।তিনি বলেন,যদি দুই সপ্তাহের মধ্যে আমাদের দাবিতে সাড়া দেয়া না হয় তাহলে আমরা নিজেরাই স্বশাসিত অঞ্চল তৈরি করব।কুকি অধ্যুষিত এলাকা সমূহের সমস্যা সমাধানের স্বার্থে আমরা তা গঠন করব-কেন্দ্র আমাদের স্বীকৃতি দিক বা না দিক।এদিকে আইটিএলএফ 'র পৃথক স্বশাসিত অঞ্চল গঠনের এই হুমকিকে বেআইনি বলে উল্লেখ করে মণিপুর সরকার এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করেছে।শাসকদলের বিধায়কদের এক বৈঠকে আইটিএলএফ'র বিবৃতির তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে।মৈতেইদের সংগঠন কো-অর্ডিনেটিং কমিটি অন মণিপুর ইন্টেগ্রিটি পৃথক প্রশাসনিক ব্যবস্থার দাবির কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে,রাজ্যে উত্তেজনা ছড়াতেই এরকম দাবি জানানো হচ্ছে।আইটিএলএফ সম্পাদক মউন টম্বিং-এর বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে চূড়াচাঁদপুর জেলায় এফআইআর দায়ের করা হয়েছে।ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অভিযোগ আনা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।উল্লেখ করা যায় যে,মণিপুরে কুকি-জোদের জন্য দীর্ঘদিন যাবতই পৃথক প্রশাসনিক ব্যবস্থার দাবি জানানো হচ্ছে।কিন্তু সম্প্রতি দুই সপ্তাহের সময় সীমা বেধে দিয়ে পৃথক প্রশাসনিক ব্যবস্থা সরকার গঠন না করলে তারা নিজেরাই তা গঠন করব বলে কুকিদের সংগঠন আইটিএলএফ ঘোষণা দেয়ার পর মণিপুর সরকার এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।সব মিলিয়ে মণিপুরে যে অশান্তি দীর্ঘস্হায়ী হতে চলেছে তার ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।মণিপুরে জাতি বিদ্বেষজনিত জাতি সংঘাতে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের জড়িয়ে পড়ায় পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করেছে ইতিমধ্যেই। এবার কুকি সংগঠনের পৃথক স্বশাসন সংশ্লিষ্ট হুমকি ও রাজ্য সরকারের ভূমিকা ঘিরে শেষপর্যন্ত পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নেয় সেটাই দেখার বিষয়।এদিকে নতুন করে নানা ঘটনা ঘিরে মণিপুরে ছড়িয়ে পড়ছে অশান্তির দাবানল।সম্প্রতি রাজ্যের কাংপোকপি জেলায় দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে দুই কুকি যুবকের মৃত্যু ঘটেছে।হয়েছে সড়ক অবরোধ।

এদিকে মণিপুরের জাতিবিদ্বেষের প্রভাব পড়েছে পূর্বোত্তরের অন্য রাজ্যেও। জাতি সংঘাতের জেরে মণিপুর ছেড়ে কুকি-জো জনজাতিদের হাজার হাজার মানুষ মাস কয়েক আগেই মিজোরামে আশ্রয় নিয়েছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই মণিপুরের ঘটনা প্রবাহ প্রভাব ফেলেছে মিজোরামে।মণিপুরে শান্তি ফেরানোর দাবিতে মিজোরামে মিছিল মিটিং হয়েছে।মিজোরামে নগণ্য সংখ্যক মৈতেই সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস রয়েছে।অশান্তির আঁচ পেয়ে তাদেরই একটি অংশ পালিয়ে এসেছিলেন অসমের বরাক উপত্যকায়।বরাকেও এ নিয়ে উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। এমনকি মণিপুরে কুকি-জোদের পৃথক প্রশাসনিক ব্যবস্থার দাবিকে মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী সমর্থন জানালে মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এর তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন।

এবার আসা যাক মায়ানমারের প্রসঙ্গে।সেখানে সরকারি বাহিনীর সেনাদের সঙ্গে বিদ্রোহীদের সংঘর্ষে এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।ভারত এজন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি বলেছেন,ভারত চায় মায়ানমারে হিংসা বন্ধ হোক।আলোচনার মাধ্যমে সেখানে মত পার্থক্যের সমাধান হোক।এদিকে মায়ানমারের গৃহযুদ্ধের প্রভাব পড়ছে মিজোরামে।মায়ানমার থেকে পাঁচ হাজারের বেশি শরণার্থী এসে আশ্রয় নিয়েছেন মিজোরামে।বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র বলেছেন,মায়ানমারের পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ভারত শরণার্থীদের চাপ বাড়বে।উল্লেখ করা যায় যে,মায়ানমারের চিন প্রদেশে সরকারি সেনা ও বিদ্রোহীদের মধ্যে প্রবল সংঘর্ষ চলছে। পশ্চম মায়ানমারের এই অঞ্চলটি ভারতের মিজোরাম ও মণিপুরের লাগোয়া।মায়ানমার থেকে পালিয়ে আসা পাঁচ/ছয় হাজার মানুষ মিজোরামের চম্পাই জেলায় আশ্রয় নিয়েছেন।কয়েকটি শিবিরে তাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে।সাধারণ মানুষের পাশাপাশি মায়ানমারের কিছু সেনাও আতঙ্কে মিজোরাম ও মণিপুরে আশ্রয় নিয়েছিল।তাদের অবশ্য বিমানযোগে ফেরত পাঠানো হয়েছে।মায়ানমারে অশান্তির জেরে মিজোরামে শরণার্থী আগমনের পাশাপাশি মণিপুরেও অনুপ্রবেশ বাড়ছে।উল্লেখ করা যায় যে,মণিপুরের চলতি অশান্তির পেছনেও আগে থেকেই এই অনুপ্রবেশকে দায়ী করা হচ্ছে।এদিকে মায়ানমারের বর্তমান অশান্তি প্রসঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কথা উল্লেখ করা যায়।কয়েক বছর আগে মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের নিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল তা কাটিয়ে ওঠার আগেই যেন আবার এক আশঙ্কার কালো মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.