থাঙ্গা ডার্লং : আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ

শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ

২০১১-১২' র কথা। দৈনিক সংবাদ পত্রিকার ভেতরের পাতায় সেবার একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন বেরিয়েছিল। সংবাদদাতা রোসেম নামক ত্রিপুরার একটি প্রাচীন বাদ্যযন্ত্রের কথা উল্লেখ করেছিলেন। খুবই ইন্টারেস্টিং ... চিত্তাকর্ষক লেগেছিল প্রতিবেদনটি । তারপর শারদীয়া দৈনিক সংবাদে "রোসেম" শিরোনামে একটি গল্প লিখে ফেলি। রোসেম বাদ্যযন্ত্রটি কাহিনী হিসেবে তখন আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই কারণে যে, ত্রিপুরার ক্ষুদ্রতম জনগোষ্ঠী ডার্লং সম্প্রদায়ের শুধু এক বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তিই তখন রোসেম নামক বাদ্যযন্ত্রটি বানাতে পারতেন এবং বাজাতে পারতেন। নতুন আর্থ সামাজিক ব্যবস্থা তথা খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে আসক্ত ডার্লং সম্প্রদায়ের উঠতি প্রজন্ম নিজেদের লোকসঙ্গীত কিম্বা আদিম বাদ্যযন্ত্রের প্রতি আগ্রহহীন বলে সেই বরিষ্ঠ ব্যক্তির আক্ষেপের সীমা ছিল না। শুকনো লাউ'এর খোলা দিয়ে বাদ্যযন্ত্রটি বানানোর কৌশলও শুধু তাঁরই জানা ছিল । তিনি চেয়েছিলেন নতুন প্রজন্ম শিখে নিক এর কৃৎকৌশল। অব্যাহত থাকুক সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। তাঁর অভিমত ছিল ছেলেমেয়েরা গ্যিটার বাজিয়ে কয়্যার সঙ্গীত গা'ক অথবা পাশ্চাত্য গান গা'ক; এতে ক্ষতি কী! কিন্তু নিজেদের কৃষ্টি সংস্কৃতির চর্চা বা ধারা তো ওরা বহন করুক। আরও আশঙ্কা ছিল তাঁর মৃত্যুর সঙ্গেই ডার্লং সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির অঙ্গীভূত রোসেম নামক এই ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্রটির অবলুপ্তি ঘটবে। রোসেম বাজিয়ে গানও তারপর আর কেউ গাইবে না। আমি সেই বরিষ্ঠ ব্যক্তির উদ্বেগের পাশপাশি রোসেম গল্পটিতে তুলে এনেছিলাম পাহাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, রাবার চাষের ফলে জনজাতিদের জীবনে বিভিন্ন পরিবর্তনের অভিঘাতের কথা । গল্পটি লেখার সময় থাঙ্গা ডার্লং'এর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতাম না। কিন্তু ত্রিপুরার জনজাতিদের জীবনে আধুনিকতার নামে যে আজকাল বিবিধ সঙ্কট চারিয়ে উঠেছে - সেটা অনুভব করেছিলাম । শুধু ত্রিপুরা নয় - উত্তরপূর্ব ভারতের সব ক'টি রাজ্যে ঘোরাঘুরির সুবাদে এবং সেসব রাজ্যের জনজাতিদের সংস্পর্শে আসার ফলে বুঝতে পেরেছিলাম শতাব্দী প্রাচীন তাদের অরণ্য সঞ্জাত সমৃদ্ধ সংস্কৃতি তথা জীবনচর্যার মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে। উন্নয়ন দরকার অবশ্যই। কিন্তু উন্নয়নের মানে তো জনজাতি সমাজের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্তর্জলী যাত্রা নয়। ত্রিপুরা, উত্তরপুর্ব ভারতের জনজাতিদের জীবনে এই সময়ে ঘটমান পরিবর্তনগুলি আসলে সঙ্কটের রূপ নিচ্ছে! রোসেম গল্পে আমি সেই ক্রাইসিসের কথাই তুলে ধরেছিলাম। গল্পে উল্লিখিত গাঁয়ের বরিষ্ঠ ব্যক্তিই ছিলেন থাঙ্গা ডার্লং ... গল্পের ক্যাটালিস্ট ! থাঙ্গা ডার্লং পরে ভারত সরকারের পদ্মশ্রী লাভ করেন । খুশি হয়েছিলাম সেই খবরে। ডার্লং গাঁয়ের বরিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে তিনি সত্যি চেয়েছিলেন নতুন প্রজন্মের মধ্যেও অব্যাহত থাকুক স্ব-জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। শারদীয়া দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত আমার গল্পটি ফের আশিস নাথ সম্পাদিত অসমের "প্রবাহ" পত্রিকার বিশেষ সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়। গল্পটির ভালো রিভিউ লিখেছিলেন অসমের সাহিত্য সমালোচক। আজ সন্ধ্যায় (৩ ডিসেম্বর ২০২৩) খবর পেলাম অশীতিপর থাঙ্গা ডার্লং না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন। বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেল মন। তিনি চলে গেলেন । কিন্তু রেখে গেলেন কিছু প্রশ্ন। আমাদের কী নৈতিক দায়িত্ব নেই তাঁর সেইসব অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার! আজ ত্রিপুরা, উত্তরপূর্ব ভারতের বিভিন্ন জনজাতি সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব এবং সত্তা যে তীব্র সঙ্কটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে তার পরিত্রাণ হয়তো সম্ভব থাঙ্গা ডার্লং'এর রেখে যাওয়া অলিখিত প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজার মধ্যেই। আর এটাই হবে তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি আমাদের যথোপযুক্ত শ্রদ্ধার্ঘ।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.