হো চি মিন সিটি সফর!

সুভাষ দাস

হো চি মিন সিটিতে কাটিয়েছি তিন দিন। প্রকৃতপক্ষে আড়াই দিন। অল্প সময়ে যতটুকু ঘুরে দেখা সম্ভব ততটুকুই দেখার একটা সনিষ্ঠ চেষ্টা ছিল। একদিন লাঞ্চের পরে তরুণ গাইড থুয়ান আমাদের নিয়ে গেলেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্যালেসে, যাকে প্রেসিডেন্ট প্যালেস বা রিউনিফিকেশন প্যালেস বলেও লোকে জানে। সরকারি ভাবে পরিচিত রি-ইউনিফিকেশন কনভেনশন সেন্টার নামেও। বিশাল সুসজ্জিত চত্তরের মাঝখানে বহুতল প্যালেসের শীর্ষে পতপত করে উড়ছে রক্ত পতাকা , সামনের লনে রক্ত পতাকার সারি।

গাইড বলছিলেন, এই প্যালেসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভিয়েতনাম ইতিহাসের বহু আলোড়িত ঘটনাপ্রবাহ। এক সময় দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী ছিল সায়গন। তারই পরিবর্তিত বর্তমান নাম হো চি মিন সিটি। দক্ষিণ ভিয়েতনামের তৎকালীন তাবেদার রাষ্ট্রপতি নগুয়েন ভান থিউর দপ্তর এবং আবাসন ছিল এই 'প্যালেসে', যেখানকার ওয়ার রুম থেকেই পেন্টাগণের অঙ্গুলিহেলনে নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল বিশ্বের অন্যতম নৃশংস যুদ্ধ বা বলা যায় মানবতাবিরোধী হত্যাকান্ড।

মার্কিন সামরিক জোট ন্যাটো আর সমাজতান্ত্রিক শিবিরের মধ্যে নানা অছিলায় বিশ্বজুড়েই ষাট সত্তরের দশকে চলছিল ঠান্ডা যুদ্ধ বা বেনামী যুদ্ধ। মার্কিনীদের লক্ষ্য ছিল বিশ্বে কমিউনিজমের ক্রমপ্রসারকে ছলে বলে কৌশলে যে কোনো উপায়ে প্রতিহত করা। তারা দক্ষিণ ভিয়েতনামের কমিউনিষ্ট বিরোধী শক্তিকে শিখন্ডি খাড়া করে ষাটের দশক থেকেই সরাসরি মার্কিন সেনা নামিয়ে দিয়েছিল ভিয়েতনামের মাটিতে। সায়গন শহর তখন মার্কিনী চর, সৈন্যবাহিনীর সদস্য আর দালালে গিজগিজ করতো।

১৯৬৭ সালে নগুয়েন ভান থিও প্রেসিডেন্ট হয়ে এই প্রাসাদে এসেছিলেন। আমদের গাইড খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এক এক করে দেখাচ্ছিলেন বহুতল-বিস্তৃত লাক্সারি অট্রালিকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা---- প্রেসিডেন্টের অফিস কক্ষ, সভা কক্ষ, সামরিক কমান্ডারদের সঙ্গে আলোচনা কক্ষ, বিদেশী কূটনীতিকদের আপ্যায়ন কক্ষ, শোবার ঘর, স্নান ঘর, থাকার ঘর , বিশ্রাম কক্ষ, সুরা পান এবং গ্যাম্বলিং সহ আনন্দ স্ফূর্তি ইত্যাদি নানা আয়োজনের জন্য নির্ধারিত অসংখ্য কক্ষ সমূহ।

এর মধ্যেই চলতে চলতে যুদ্ধকালীন সময়ের নানা ঘটনার কথাও থুয়ান বলছিলেন প্রসঙ্গক্রমে। বলছিলেন, ১৯৬৮ সালের ৩১ জানুয়ারির কথা। সেদিন সকালবেলা , যখন ভিয়েতনামের মানুষ তাদের চান্দ্র নববর্ষের উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজনে মগ্ন, ভিয়েতকঙ যোদ্ধারা একযোগে অতর্কিতে সারা দেশজুড়ে পরিকল্পিত প্রত্যাঘাত হেনেছিল একাধিক প্রতিক্রিয়ার ঘাঁটিতে। তার মধ্যে একটি টার্গেট ছিল আমেরিকান দূতাবাস। ১৯ জন গেরিলার একটি দুঃসাহসী সুইসাইড স্কোয়াড সেদিন দখলদার মার্কিনীদের দূতাবাসে হামলার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিল। তথাকথিত পরাক্রমী আমেরিকার অতি সুরক্ষিত দূতাবাসের প্রাচীরে সুড়ঙ্গ তৈরি করে দুর্দমনীয় গেরিলারা ঢুকে পড়েছিল দূতাবাসের অভ্যন্তরে। নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে গেরিলারা প্রায় ছয় ঘন্টা দখলে রেখে দিয়েছিল পুরো দূতাবাস। প্রকাশ্য রাস্তায় একজন বন্দি ভিয়েতকঙ গেরিলার নিষ্ঠুর হত্যার ভিডিও চিত্রও নাকি প্রচারিত হয়েছিল সেই সময়।

মার্কিন দূতাবাসে সেদিনের দুঃসাহসিক গেরিলা হামলার ঘটনা এবং তাকে কেন্দ্র করে দিনভর মার্কিন সেনাবাহিনীর অসহায়ত্বের চিত্র সাধারণ আমেরিকাবাসী, যারা বিশ্বাস করতেন যে ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকারই জয় হবে, তাদের মনে পেন্টাগন-সৃষ্ট দীর্ঘলালিত বিশ্বাস ও প্রত্যয়ের প্রাচীরে গুরুতর ফাটল ধরিয়ে দিয়েছিল।

তার মাত্র কয়েক বছর পরই, ১৯৭৫ এর ৩০ এপ্রিল উত্তর ও দক্ষিন ভিয়েতনামের মুক্তিকামী যৌথ বাহিনীর কাছে সায়গনের পতন ঘটে। সেদিনও সকালে সায়গনের জনশূন্য পথঘাট মাড়িয়ে দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে গিয়েছিল ৭ টি ট্যাঙ্কের একটি দুর্জয় কলাম। তারা ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছিল প্রেসিডেন্ট নগুয়েন ভান থিউর সাধের প্রাসাদ তোরণদ্বার এবং শীর্ষে উড়িয়ে দিয়েছিল প্রিয় রক্তপতাকা। জনবিরোধী প্রতিক্রিয়ার শক্তির উদ্ধত ফনা দুমড়ে মুছড়ে সায়গন সহ সারা দেশের দখল নিয়ে নিয়েছিল বীর মুক্তিযোদ্ধারা। থুয়ান বললেন, প্রেসিডেন্ট থিউ পালিয়ে গিয়েছিলেন প্রাসাদের ছাদে অপেক্ষমান মার্কিন হেলিকপ্টারে চড়ে। সেদিন থেকেই জন্ম হল এক ঐক্যবদ্ধ মুক্ত ভিয়েতনামের। ( লেখক এখন চিন সফরে আছেন)


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.