।। চন্দন গাছের সুবাস ।।

অরিন্দম নাথ

বিমল সিনহাকে নিয়ে লিখছি ৷ বিশেষতঃ আমার ফেসবুকের সর্বজ্যেষ্ঠ মিতা জীবন কুমার ভট্টাচার্যের অনুরোধে ৷ সময়টা সম্ভবত ১৯৯৬ সাল ৷ মে মাস ৷ আমি ডিএসপি সেন্ট্রাল আগরতলা হিসেবে পোস্টেড ৷ নৃপেন চক্রবর্তী তখন জীবিত ৷ ২ নং এমএলএ হোস্টেলের একটি কামরায় থাকেন ৷ তাঁর সঙ্গে একটি দুইটি পাখি ৷ চড়াই ৷ শালিক ৷ একজন বা দুইজন কনস্টেবল৷ একজন নার্স ৷ দেখতে খুবই সুন্দর ৷ তাঁকে তিনি মেয়ের মত দেখেন ৷ আর একজন উপজাতি মহিলা ৷ মাঝবয়সী ৷ তাঁকে তিনি মা বলে ডাকেন৷ এক পাতে খাবার খান ৷ দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় লেখেন ৷ কাঁপা কাঁপা হাতের লেখায় দস্তখত ৷ অরুপ রায় ছদ্মনামে তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম ৷ এই লেখায় সেই ধার দেখতে পাই না ৷ অনেক সময় ভাবতাম এসব কথা কি অন্য কেহ লিখে দেন ৷ একজনকে তিনি টার্গেট করেছিলেন ৷ বিমল সিনহাকে ৷ সেই সময় তিনি বিধানসভার অধ্যক্ষ ৷ তাঁর বিরুদ্ধে নৃপেন চক্রবর্তীর অভিযোগ ছিল যে উগ্রপন্থীর সঙ্গে মেলামেশা করেন ৷ বিশেষকরে এটিটিএফ বৈরীদের সঙ্গে ৷

এমনি এক পরিস্থিতিতে একদিন একটি খবর পাই ৷ গোপন সূত্র মারফত ৷ বর্ডার গোল চক্করের কাছাকাছি পশ্চিম জয়নগরে বাড়ি ছিল ওসমান মিঞার ৷ পুলিশ খাতায় সে একজন ক্রিমিন্যাল ৷ পাচার বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ৷ একবার বন্দুকের গুলি খেয়েছিল৷ একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠি নাকি ওসমানকে ফিট করেছে নৃপেন চক্রবর্তীকে খুন করার জন্য৷ আবার তাদেরই একটি দল থাকবে জনরোষ দেখিয়ে ওসমানকে মেরে ফেলবে ৷ সবশেষে দোষ গিয়ে পড়বে বিমল সিনহার উপর ৷এই খবরের পর বসে থাকা যায় না ৷ ২ নং এমএলএ হোস্টেলের একপাশে শিশুবিহার স্কুল ৷অন্যপাশে কুমারী – মধুতি - রূপশ্রী ট্রাইবেল গেস্ট হাউস ৷ এলাকার নিরাপত্তা বৃদ্ধি করলাম ৷ হকারদের, বিশেষকরে উপজাতি গেস্ট হাউসের সামনে থেকে সরিয়ে দিলাম ৷ একটি গ্রুপ সবসময় সখানে আড্ডা দিত ৷ তাদের উপর নজর রাখার ব্যবস্থা করলাম ৷ ওসমানের বাড়িতেও রেইড হল ৷ দুপুরবেলায় ৷ তবু সে বাংলাদেশের দিকে পালিয়ে গেল ৷ তার বাড়ির অবস্থানই ছিল দূর থেকে দেখে ফেলার মত ৷ ঘর থেকে আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া গেল ৷ একটি ফেক্টরি মেইড পিস্তল ৷ বেশ কিছু বন্দুকের গুলি ৷ এরমধ্যে কয়েকটি ছিল একে ৪৭ রাইফেলের ৷ ত্রিপুরা পুলিশে তনও একে রাইফেল আসেনি ৷ বিএসএফের ট্রেনিং সেন্টারে এই হাতিয়ারের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম ৷ পশ্চিম আগরতলা থানায় একটি মামলা নেওয়া হয় ৷ যতদূর মনে আছে সেই মামলার নম্বর ১৩৩/১৯৯৬ ৷ ওসমানকে ধরতে পেরেছিলাম কিনা মনে নেই ৷ পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে স্মৃতির অতলে চলে যায় ৷

তারপর বিমল সিনহা স্বাস্থ্যমন্ত্রী হলেন ৷ আমাদের এক সহকর্মী ছিলেন এসআই মনিন্দ্র ঘোষ ৷ তাঁর স্ত্রীর ওপেন হার্ট সার্জারি করাতে হবে ৷ প্রচুর টাকা লাগবে ৷ গ্রুপ সি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে স্ত্রীর চিকিৎসা খরচ সরকারীভাবে পাওয়া যায় না ৷ তবে রাজ্য মন্ত্রীসভার কেবিনেট অনুমোদন করলে সম্ভব ৷ মনিন্দ্রবাবুকে নিয়ে প্রথমে গেলাম তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সমর চৌধুরীর কাছে ৷ তিনি ভাববাচ্যে উত্তর দিলেন, “রাজার চিকিৎসা হবে রাজার মত, ফকিরের চিকিৎসা ফকিরের মত !”

অর্থাৎ সামর্থ্য অনুযায়ী চিকিৎসা করাতে হবে ৷ আইনের বাইরে কিছু রিকমেন্ড করবেন না ৷ এবার আমরা গেলাম বিমল সিনহার কাছে ৷ সকালবেলা তাঁর সরকারী আবাসনে ৷ তিনি একটি মনিপুরী গামছা পরে বসেছিলেন ৷ চা-মুড়ি খাচ্ছিলেন ৷ আমাকে দেখেই বললেন, “মাস্টারের পুলা মাস্টর, আও চা খাও ৷”

আমার কমলপুরে শিক্ষকতার সময় থেকে তাঁর সঙ্গে পরিচয় ৷ সেই সূত্র ধরেই সম্বোধন ৷ আমার বাবার স্বাস্থ্যের খবর নিলেন ৷ মনিন্দ্রবাবু তাঁর সমস্যা ব্যক্ত করলেন ৷ তিনি বললেন যে টাকা পয়সা ব্যবস্থা করে অপারেশন করিয়ে আনতে ৷ পরে কেবিনেটে পাশ করিয়ে আনবেন ৷ তিনি অবশ্য তাঁর কথা রাখার আগেই খুন হয়ে যান ৷ পরে কেশব মজুমদার সেই অঙ্গীকার রক্ষা করেছিলেন ৷

১৯৯৮ নির্বাচনের পর বামফ্রন্ট আবার ত্রিপুরায় ক্ষমতায় ফিরে আসে ৷ বিমল সিনহা আবারও স্বাস্থ্যমন্ত্রী হন ৷ তাঁদের কমলুরের বাড়িতে কলিগ শিক্ষক রবি সিনহার সঙ্গে কয়েক বার গিয়েছি ৷ সবাইকে চিনতাম ৷ বিমল সিনহার বাবা লক্ষ্মী সিনহা ছিলেন ঠিকেদার ৷ ছয় ফুটের উপর লম্বা ৷ বেঁতের মত শরীর ৷ পত্রপত্রিকায় খবর দেখলাম তাঁর ভাই বিক্রম সিনহা অপহৃত হয়েছেন ৷ সে বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে ৷ ইলেকশনের আগে ৷ তিনি ছিলেন লক্ষ্মী সিনহার পালিত পুত্র ৷ বিক্রমবাবু ঠিকেদারী কাজ দেখতে সাইকার বস্তির দিকে গিয়েছিলেন ৷ সেখান থেকে এনএলএফটি বৈরীদের একটি দল তাঁকে অপহরণ করে ৷ পাশেই বাংলাদেশ ৷ সোনারাই এলাকায় নেমে যায় ৷ নেতৃত্ব ছিল ধর্মচরণ জমাতিয়া ওরফে দাফুং ৷ বাড়ি বীরগঞ্জ থানা এলাকার সরবং ৷ এখন মৃত ৷ তখন এসপি ধলাই ছিলেন বি কে রায় স্যার ৷ কমলপুরের এসডিপিও ছিলেন হিমাংশু গুপ্তা ৷

তারপর ৩১শে মার্চ ১৯৯৮ তারিখে আভাঙ্গাতে ধলাই নদীর পাড়ে খুন হন বিমল সিনহা ৷ তখন তাঁর দেহরক্ষী ছিল রঞ্জিত দেববর্মা ৷ ডিএআর কনস্টেবল ৷ আমার উপর দায়িত্ব পড়েছিল সে কর্তব্য গাফিলতি করেছে কি না প্রাথমিকভাবে তদন্ত করে দেখার জন্য ৷ সেই অনুযায়ী আমি ঘটনার সংস্রবে অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করি ৷ বয়ান রেকর্ড করি ৷ সেখানে গিয়েছিলাম কিনা ভুলে গেছি ৷ আমার বন্ধু মানস পাল তাঁর লেখা ‘The Eyewitness’ বইতে বিমল সিনহার হত্যার উপর বিস্তৃত লিখেছে ৷ পরবর্তীতে আমি এসপি ধলাই হিসেবে যোগ দেই ৷ তখন ঘটনাস্থলে একবার গিয়েছিলাম ৷ এইসব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কিছু কথা লিখছি ৷ আমি যেহেতু তদন্তকার্যে যুক্ত ছিলাম না, আমর সবকিছুই অনুমান নির্ভর ৷

তখন ধলাই জেলা কিংবা উনকোটি জেলা হয়নি ৷ বিমল সিনহা ছিলেন অবিভক্ত উত্তর জেলার অবিসংবাদিত নেতা ৷ মশীহা ৷ আমি বিশ্বাস করি তাঁর মৃত্যুতে এই তিনটি জেলার প্রভূত ক্ষতি হয়েছে ৷ উন্নতিতে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে ৷ সত্যিকার অর্থে এই এলাকার লোকজনের কথা বিধানসভায় বলার মত কোন জনদরদী নেতা নেই ৷ আমার বন্ধু রবি সিনহাদের জামথুঙ্গের বাড়িতে গিয়ে আমি থেকেছি ৷ তিনি বলতেন যে বিমল সিনহা অনেকসময় উগ্রপন্থীদের বন্দুকের সামনে পড়েছেন ৷ কোনদিন কোন উগ্রবাদী সাহস করেনি তাঁকে গুলি করার ৷ তারা জানত তাদেরই ক্ষতি হবে ৷ তাদের দুঃখ কেউ যদি বুঝতে পারেন তিনি বিমল সিনহা ৷

নৃপেন চক্রবর্তী উগ্রবাদীদের সঙ্গে বিমল সিনহার সখ্যতার কথা বলেছেন ৷ কমলপুর মহকুমায় তখন চারটি বিধানসভা কেন্দ্র ছিল ৷ কমলপুর, সুরমা, সালেমা এবং আমবাসা ৷ এরমধ্যে সাধারণ কেন্দ্র কমলপুর ৷ বাকিগুলি সংরক্ষিত ৷ রাজনীতিতে অবসরের বয়স নেই ৷ আমেরিকার রাষ্ট্রপতির মত যদি দুই টার্মের বেশী মন্ত্রী হবার সুযোগ না থাকত, অনেক হানাহানি কমে যেত ৷ রাজনীতিতে ফ্রেশ ব্লাড আসত ৷ কমলপুর আসনের জন্য সিপিএমের তিনজন প্রত্যাশী থাকতেন ৷ রঞ্জিত ঘোষ, জগদীশ ঘোষ আর বিমল সিনহা ৷ নির্বাচনের কয়েকমাস আগে এটিটিএফ উগ্রবাদীরা রঞ্জিত ঘোষকে অপহরণ করে ৷ তারপর ফিরে আসেন ৷ বিমল সিনহা তাঁকে জীবিত ফিরিয়ে আনার মুখ্য ভূমিকা পালন করেন ৷ অনেকে আবার তাঁর দিকে সন্দেহের তির নিক্ষেপ করতে পিছপা হন না ৷ তবে রঞ্জিতবাবু কোনদিন মুখ খুলেননি ৷ জগদীশ ঘোষ ছিলেন বামপন্থী শিক্ষক ৷ তিনি ভোটে দাঁড়ানোর জন্য রেজিগনেশন দিয়েছিলেন ৷ যথা সময়ে রেজিগনেশন অনুমোদিত হয়নি ৷ ফলে ভোটে দাঁড়াতে পারেননি ৷ তিনি এর পেছনে বিমল সিনহাকে সন্দেহ করতেন ৷ পরে তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন ৷ তার সঙ্গে উগ্রবাদীদের খুব যোগাযোগ ছিল ৷ বিমল সিনহা যেদিন খুন হন, সেদিন সকালেই পরিবারসহ গা ঢাকা দিয়েছিলেন ৷ বিমল সিনহা আবার ভোটে দাঁড়ান ৷ জয়ী হন ৷ মন্ত্রী হন ৷ আমি দক্ষিণ জেলায় আমার অভিজ্ঞতার কথা বলেছি ৷ বাঙালি টাউটদের কথা উল্লেখ করেছি ৷ এখানেও প্রচুর টাউট ছিল ৷ মেচুরিয়াতে বাড়ি ৷ কংগ্রেস সমর্থক ৷ হিমাংশু দাস, সত্যরঞ্জন দাস, প্রেমানন্দ নমঃশূ্দ্র, পরিমল দাস এমনি কিছু টাউট ৷ উগ্রবাদীদের ওভার ৷ এদের মাধ্যমেই চিঠিপত্র, টাকাপয়সা, জিনিসপত্র লেনদেন হত ৷ ২৬ শে মার্চ, ১৯৯৮ তারিখে একলক্ষ সত্তর হাজার টাকা উগ্রবাদীদের দেওয়া হয় বলে প্রকাশ ৷ প্রথমে ডিমান্ড নাকি ছিল পঞ্চাশ লক্ষ টাকা ৷ পরে সেটা দশ লক্ষ টাকায় নেমে আসে ৷ প্রেমানন্দ নমঃশূ্দ্রের মাধ্যমে এনএলএফটি খবর পাঠায় যে বিক্রম সিনহাকে মুক্তি দেওয়ার আগে একবার মন্ত্রী বিমল সিনহার সঙ্গে কথা বলতে চায় ৷

সেই মিটিং ঠিক হয় ৩১শে মার্চ, ১৯৯৮ তারিখ সকাল দশটার দিকে ৷ আভাঙ্গায় ধলাই নদীর ঘাটে ৷ সেই অনুযায়ী সকাল দশটার দিকে বিমল সিনহা পৌঁছান । আভাঙ্গায় ধলাই নদীর পশ্চিম পাড়ের ঘাট । তাঁর সঙ্গে ছিলেন ভাই বিদ্যুৎ সিনহা ওরফে রকেট, সিএ সুখরঞ্জন সিনহা আর দেহরক্ষী রঞ্জিত দেববর্মা । সেখানে তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছিল বৈরীদের ওভার সত্যরঞ্জন দাস ৷ তাঁরা প্রথমে স্থানীয় এক ভদ্রলোক মনিলাল সিনহার ঘরে অপেক্ষা করেন ৷ সিআরপিএফ এসকর্ট সাথে নেননি । অনেকটা দূরে রাখেন । অল্প পরে সুখরঞ্জন সিনহার ভাই নিহার সিনহা এবং বিমল সিনহার ভাতিজা বিকাশ সিনহাও সেখানে আসেন ৷ ইতিমধ্যে খবর আসে বৈরীরা ধলাই নদীর পূর্ব পাড় বরাবর এসে গেছে । তাদের সঙ্গে আছে সুখরঞ্জন দাস । অপর পাড়ে দেখা যায় । অপহৃতকে ফিরিয়ে দেবে । সবমিলিয়ে একটি ফয়সালা হবে । দেহরক্ষী রঞ্জিত দেববর্মা এবং অন্যান্যদের মনিলাল সিনহার ঘরে বসতে বলে, ভাই বিদ্যুৎ সিনহা ও সুখরঞ্জন সিনহাকে নিয়ে বিমল সিনহা এগিয়ে যান ৷ বৈরীদের সঙ্গে কথা বলার জন্য ওয়াকিটকি নিয়ে এসেছিলেন । সত্যরঞ্জন দাসের হাত দিয়ে একটি সেট উগ্রপন্থীদের জন্য পাঠান ৷ কিন্তু বৈরীরা ওয়াকিটকিতে কথা বলতে অস্বীকার করে ৷ নদীর পাড়ে এসে বিমল সিনহাকে সরাসরি কথা বলতে বলে ৷ তখন ছোটভাই বিদ্যুৎ সিনহা ওরফে রকেটকে নিয়ে বিমল সিনহা ঘাটের দিকে এগিয়ে যান ৷ সুখরঞ্জন সিনহা পিছিয়ে পড়েন ৷

নদীর পাড়ের কাছাকাছি হিমাংশু দাস অপেক্ষা করছিল ৷ সে তাঁদের নদীর জলের কাছাকাছি পাড়ের ঢালান বরাবর নিয়ে যায় ৷ গামছা দিয়ে মুখ ঢেকে দুজন বৈরী এগিয়ে আসে ৷ পরে তারা নবকুমার দেববর্মা এবং বিশ্বদয়াল জমাতিয়া বলে শনাক্ত হয় ৷ উগ্রবাদীরা নদীর মাঝামাঝি পর্যন্ত এসে একে ৪৭ হাতিয়ার বের করে ৷ তাদের একজন বলে, “মজাক লাগিয়ে রাখছনি ...!” প্রথমে রকেটের সঙ্গে কিছু তর্কাতর্কি হয় ৷ এরইমধ্যে বৈরীরা রকেটকে গুলি করে ৷ সে লুটিয়ে পড়ে ৷ বিমল সিনহা ভাইকে বাঁচাতে যান ৷ কিন্তু তাঁকেও তারা গুলিতে ঝাঝরা করে দেয় ৷ বৈরীরা সুখরঞ্জনের দিকেও গুলি করে ৷ তিনি পালিয়ে আসেন ৷ গুলির শব্দে কন্সটেবল রঞ্জিত দেববর্মা বেরিয়ে আসে ৷ বৈরীরা তখন নদীর পূর্ব পাড়ের দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল ৷ পেছনে হিমাংশু দাস ৷ রঞ্জিত এগিয়ে গিয়ে গুলি করে ৷ একটি গুলি হিমাংশুর পায়ে লাগে ৷ ইতিমধ্যে সিআরপিএফরাও দৌঁড়ে এসেছে ৷ কিন্তু ততক্ষণে হিমাংশুকে নিয়ে বৈরীরা দৃষ্টির অদূরে চলে গেছে ৷ বিশেষকরে ওদিকটায় জঙ্গল এবং কাছেই পাহাড় ৷ গুলিবিদ্ধ বিমল সিনহা এবং বিদ্যুৎ সিনহা ওরফে রকেটকে কমলপুর হাসপাতালে নিয়ে গেলে মৃত বলে ঘোষণা করা হয় ৷ বিক্রম সিনহাকে বৈরীরা ১৫ই মে, ১৯৯৮ মু্ক্তি দেয় ৷

এই ঘটনার তদন্ত করে সিআইডি ৷ নবকুমার দেববর্মা, বিশ্বদয়াল জমাতিয়া এবং প্রেমানন্দ নমঃশূ্দ্রের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় ৷ বাকিরা মুক্তি পায় ৷ এক দুইজনকে রাজসাক্ষী বানানো হয়েছিল ৷ তদন্তের অনেক সমালোচনা হয় ৷ সবচাইতে বেশি সমালোনা হয়েছিল জগদীশ ঘোষকে আসামী না করায় ৷ এই তদন্তের বিষয়ে আমি অবগত নই ৷ তাই মন্তব্য করা অনুচিত ৷

আমার একসময়ের কলিগ ছিলেন মনিময় রাজকুমার ৷ বছর সাতেক আগে অবসরে এসেছেন ৷ তিনি একসময় প্রয়াত বিমল সিনহার দেহরক্ষী ছিলেন ৷ তাঁর ভাষ্যের উপর ভিত্তি করে একটি গল্প লিখেছিলাম ৷ গল্পের কিছু অংশ দিয়ে লেখাটি শেষ করছি ৷ সত্তরের দশকের শেষ থেকে আশির দশকের প্রথম অবধি আমি পুলিশের বেতার বিভাগে ছিলাম ৷ ইতিমধ্যে আমার সেই দাদা জন-প্রতিনিধি হয়েছেন ৷ তিনি আমাকে তাঁর দেহরক্ষী হিসাবে বেছে নেন ৷ প্রায় দশ বছর আমি তাঁর সাথে ছিলাম ৷ এই সুবাদে অনেক উত্থান-পতন দেখেছি ৷ তখন আমার বাবা বৃদ্ধ ৷ আমাদের সংসার চলত আমার বেতনে ৷ খুব কষ্ট হত ৷ চুলার সংখ্যা কমাতে আমি আমাদের গ্রামের কাছাকাছি পোস্টিং নিই ৷ আমি তখন সাদা-পোশাকের পুলিশের কর্মী ৷ দাদা মদত করেছিলেন ৷ আমার এলাকায় তিনি এলে প্রায়ই আমার খোঁজ করতেন ৷ তাঁর গাড়িতে সফর-সঙ্গী হতে হত ৷

পুলিশের চাকুরীতে প্রতিনিয়ত উৎকোচের প্রলোভন থাকে ৷ এই প্রলোভন থেকে আমিও দূরে থাকতে পারি না ৷ একবার আমাদের এলাকায় একটি চুরির ঘটনা ঘটল ৷ আমি একজন চোরকে শনাক্ত করতে সক্ষম হলাম ৷ স্থানীয় থানার বড়বাবুকে এইকথা বললাম ৷ তিনি আমাকে অন্য পরামর্শ দিলেন ৷ ছেলেটির সাথে গোপনে রফা করতে বললেন ৷ আমি প্রলোভনে পড়লাম ৷ ছেলেটির সাথে যোগাযোগ করলাম ৷ সে ত্রিশ হাজার টাকা দিতে রাজি হল ৷ তখন ত্রিশ হাজার টাকা, প্রচুর টাকা । নির্দিষ্ট দিনে সেই টাকা বড়বাবুর কাছে সে পৌঁছেও দিল ৷ এর অর্ধেক হিস্যা ছিল আমার ৷

যেদিন ছেলেটি বড়বাবুর কাছে টাকা পৌঁছে দিয়েছে, সেদিন দাদাও এসেছেন আমাদের এলাকায় ৷ সফর করতে ৷ যথারীতি আমি তাঁর সফরসঙ্গী ৷ সেদিন আমি উসখুস করছিলাম ৷ কখন মুক্তি পাব ৷ আর থানায় গিয়ে আমার অংশের টাকা নেব ৷ আমার এই অশান্ত ভাব দাদার নজর এড়ায় না ৷ তিনি আমার কাছে এই উচাটনের কারণ জানতে চাইলেন ৷ আমি তাঁর কাছে কিছুই লুকোতাম না ৷ সবকিছু বললাম । শোনে, তিনি কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইলেন ৷ তারপর হাতজোড় করে আমাকে উপদেশ দিলেন যে আমি যেন ভুল পথে পা না দিই ৷ আমি তাঁর কাছে সেদিন শপথ কাটলাম ৷ জীবনে ঘুসের টাকা স্পর্শ করব না ৷ চাকুরীর শেষদিন পর্যন্ত আমি কথা রেখে এসেছি ৷ এইজন্য আমাকে জীবনে অনেক ভোগান্তি সহ্য করতে হয়েছে ৷ শুনেছি চন্দন গাছের নিচে অন্য গাছ থাকলে সে গাছেও সুগন্ধ ছড়ায় ৷ বহু বছর পেরিয়ে এসে আজ মনে হয় মানুষ হিসাবে আমি ততটা খারাপ নই ৷




You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.