ভট্টসঙ্গীতঃ এক লুপ্তপ্রায় সংবাদ সাহিত্য ধারা
পান্নালাল রায়
ছোটবেলার স্মৃতি মাঝে মাঝে নাড়া দিয়ে যায়।হাট বাজারে দেখতাম একটি লোক চোঙা মুখে দিয়ে সুর করে কবিতা পড়ছে।আর তাকে ঘিরে মানুষের জটলা।পড়া শেষ হলে সেই কবিতার চটি পুস্তিকা ভিড়ের মানুষের কাছে বিক্রি করতো লোকটি।আর তা কেনার জন্য সে কী হুড়োহুড়ি!সুর করে কবিতা পড়া শুনতে ভালো লাগতো।ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। কিন্তু কি থাকতো সেই কবিতায়? কোনো গৃহবধূর আত্মহত্যার সকরুণ কাহিনি,কোনো নৃশংস হত্যাকাণ্ড কিংবা বন্যার ধ্বংসলীলা ইত্যাদি।পরবর্তী সময়ে জেনেছি সেই কবিতা গুলোই ছিল 'ভট্টসঙ্গীত'।মধ্যযুগের এই জনপ্রিয় সাহিত্য ধারা আজ লুপ্তপ্রায়!শুধু সাহিত্য কেন,একে সংবাদ সাহিত্যও বলা যায়।কারণ এই 'ভট্টসঙ্গীত' বা 'ভট্টকাব্য' কিংবা 'ভাটের গান'-এর মাধ্যমে সে যুগে সংশ্লিষ্ট কবিরা এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পৌঁছে দিতেন নানা সংবাদ।
'ভট্টসঙ্গীত' অবশ্য এক সুপ্রাচীন সাহিত্য ধারা।বংশানুক্রমিক ভাবে যারা স্তুতি পাঠক তাদের বলা হতো 'ভট্ট'।আর তাদের দ্বারা গীত সঙ্গীত হচ্ছে 'ভট্টসঙ্গীত'। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে ভট্টদের উদ্ভবের বিবরণের কথা উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্ট পণ্ডিতগণ। পৌরাণিক যুগের সমাজ ব্যবস্থায়ও স্তুতিপাঠক ভট্টদের সম্মানজনক অবস্থান ছিল।ভট্টরা দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়িয়ে সঙ্গীতের মাধ্যমে নানা সংবাদ প্রচার করতেন।মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে 'ভট্ট' বা 'ভাট'দের উল্লেখ রয়েছে।মনসামঙ্গল কাব্যে রয়েছে-
" দেখিয়া বাপের বড় রঙ্গ হইল মনে।
উদ্যোগ করে সত্বর বিয়ার কারণে।।
দেশে দেশে ভট্ট পাঠাইয়া অনুচরে।
চান্দের বিয়ার সজ্জা করে কোটীশ্বরে।।"
অনুরূপ ভাবে চন্ডীমঙ্গল কাব্যে রয়েছে-
" আসি পুর গুজরাটে নিবাস করিল ভাটে
অবিরত পড়য়ে পিঙ্গল।"
মধ্যযুগের পর অপেক্ষাকৃত আধুনিক সাহিত্যেও 'ভাট'দের উপস্হিতি অনুল্লেখ্য নয়।বিবাহ অনুষ্ঠানে ভাটদের উপস্হিতির উল্লেখ পাওয়া যায়।
'ভট্টসঙ্গীত' বা 'ভাটের গান' লোকসঙ্গীতের এক শক্তিশালী ধারা।বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল সহ অসমের বরাক উপত্যকা ও ত্রিপুরা রাজ্যে একদা এটি প্রচলিত ছিল।বর্তমানে এই সঙ্গীত ধারা বিস্মৃত হতে চলেছে।বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের কাছাড় জেলা সমিতি এই লুপ্তপ্রায় ভট্টসঙ্গীতের একটি সংকলন প্রকাশ করেছে। 'বরাক উপত্যকার ভট্টসঙ্গীত' নামে এই গ্রন্হটির সম্পাদনা করেছেন এই অঞ্চলের বিশিষ্ট লোক সাহিত্য-সংস্কৃতি গবেষক অমলেন্দু ভট্টাচার্য। ১৯৬১ সালে কাছাড়ের বাংলা ভাষা আন্দোলন,জওহরলাল নেহরুর মৃত্যু,অসমের ভূমিকম্প, বন্যার তান্ডব ইত্যাদি নানা বিষয়ে রচিত ভট্টসঙ্গীতের দুর্লভ সংগ্রহ রয়েছে বইটিতে।১৯৬১ সালের ভাষা আন্দোলনের উপর মোঃআলাউদ্দিন খাঁ রচনা করেছেন-
"প্রভু নাম স্মরি,কলম ধরি করিয়ে ভাবনা
সত্যাগ্রহীর কবিতা এখন করিব রচনা।
ইংরেজি ৬১সনে ২,দুঃখ মনে শুনেন বন্ধুগণ
মে মাসেরি ১৯ তারিখে ভাষার আন্দোলন।
দিন শুক্রবার ২, হাহাকার শিলচরেতে ভাই
১১ জন মৃত্যুর ফলে জাগিল সবাই।..."
'ভট্টসঙ্গীত' এক অসাম্প্রদায়িক চেতনার আলোয় উদ্ভাসিত ছিল। কবি এবং শোতৃবর্গ কেউই কোনো ধর্মীয় গন্ডীতে আবদ্ধ ছিলেন না।কাছাড়ের ভাষা আন্দোলনের উপর কবি তাই লেখেন-
"...কত শত শত ২,বলব কত সত্যাগ্রহী হল
রবীন্দ্র নজরুলের ভাষা রক্ষা করতে হিন্দু মুসলিম চল।..."
কবি তাঁর কবিতা শেষ করেন এই ভাবে-
"...এখন এই পর্য্যন্ত ২, করি ক্ষান্ত আমিও অজ্ঞান
মুসলিমকে ছালাম বলি হিন্দুকে প্রণাম।..."
পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর মৃত্যুর পর মোঃমসাইদ আলী রচনা করেন-
"...কি লিখিব কি বলিব কেঁদে উঠে প্রাণ।
কলম নাহি চলে ২,চোখের জলে বুক ভেসে যায়
প্রধানমন্ত্রীর মরণ বাণী শুনেনও সভায়।
শুন ভারতবাসী ২, কই প্রকাশি সকল বিবরণ
বাসভবনে নেহেরুজীর হইল মরণ।
...........
শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ২,কান্দি কান্দি চিতার ধারে গিয়া
অজ্ঞান হইল মেয়ে পিতার মুখ দেখিয়া।।
দিল্লীর রাজঘাটেতে ২,শ্মশানেতে শেষ দেখা দেখাইয়া
বিজয়লক্ষ্মী ইন্দিরাকে নিলেন সরাইয়া।..."
ভট্টকবিরা দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নানা ঘটনা অবলম্বন করেও রচনা করেছিলেন ভট্টসঙ্গীত। সেসব অমূল্য সম্পদ হারিয়ে গেছে আজ।স্বাধীনতা আন্দোলন চলাকালীন সময়ে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে করিমগঞ্জের চরগোলা উপত্যকার চা বাগানের শ্রমিকরা ব্রিটিশ বাগান মালিকদের অকথ্য নির্যাতন আর নিষ্পেশনের প্রতিবাদে দলে দলে বাগান ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। 'মুলুক' যাবার পথে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ,রোগ শোক আর পুলিশী অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন তারা।অনেকের মৃত্যুও ঘটেছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে 'চরগোলা এক্সোডাস' নামে চিহ্নিত হয়ে আছে এই ঘটনা।তা নিয়েও রচিত হয়েছিল ভট্টসঙ্গীত। এরকম একটি ভট্টসঙ্গীতের অংশ বিশেষ হচ্ছে-
" এ কি করলে ভগবান ২,
জাগাতে ভারত প্রাণ পুত্র কন্যা দিলে বলিদান।
চা বাগানের অত্যাচারে ২,কুলিরা ধর্মঘট করে
একদিনে ছাড়িল বাগান।
ইংরেজ তোমার যে বীরত্ব ২
চাঁদপুরে দেখালে সত্য গোর্খা সৈন্য করিয়ে স্হাপন।"
ভট্টসঙ্গীতে যে কোনো করুণ কাহিনির বর্ণনায় উপস্থিত শোতৃবর্গের মধ্যেও এক শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হতো।হাট বাজারে মানুষ অশ্রুসজল নয়নে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা শ্রবণ করতো।প্রায় শতবর্ষ আগের প্রলয়ঙ্করী বন্যা সহ নানা প্রেম কাহিনি,সর্প দংশনে কারও মৃত্যু,রূপবানের কবিতা ইত্যাদিও সংকলিত হয়েছে গ্রন্হটিতে।সাত/আট দশক আগেকার অসমের ভূমিকম্প সম্পর্কে কামিনী মোহন দাশ লিখেছিলেন-
"...ওহে নিরঞ্জন ২,একি ঘটন ঘটালে এবার
এত বড় ভূমিকম্প দেখি নাহি আর।
১৩৫৭ সালে২,শ্রাবণ মাসের ৩০শে তারিখে
অপূর্ব্ব কম্পন হয় মঙ্গলবার রাতে।
মঙ্গলবার রাতে২,পৃথিবীতে অপূর্ব্ব কম্পন
আল্লা হরি দুই শব্দ বলে লোকজন।...."
১৩৬৬ বঙ্গাব্দে করিমগঞ্জ এলাকায় বন্যার কবিতায় কবি শচীন্দ্র মোহন দাস মানুষের দুঃখ দুর্দশার চিত্র এঁকেছেন এই ভাবে-
"...জলে দাড়াইয়া অভাগীরা স্বামীর পানে চায়।
ঘোর বিপদে বল নাথ করি কি উপায়।।
তৈজসপত্র লইয়া-
তৈজসপত্র লইয়া সাঁতার দিয়া বান্দের উপর উঠে।
ঘরবাড়ী ভাসাইয়া জল দারুণ বেগে ছুটে।।
.............
চান্নিঘাট বাজারেতে চাউলের মণ ৩০ টাকা কয়।
কত অন্ধ আতুর গরীব দুঃখী উপবাস রয়।।....."
আজকের মতো শক্তিশালী সংবাদ মাধ্যম যখন ছিল না তখন এই ভট্টসঙ্গীতের মাধ্যমেই ভট্ট কবিরা নানা সংবাদ পৌঁছে দিতেন বিভিন্ন জায়গায়।বন্যা,ভূমিকম্প, মহামারী ইত্যাদির পাশাপাশি সমাজের নানা করুণ কাহিনিও গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপিত হতো তাদের কবিতায়।প্রায় শতাব্দী কালের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ের উপর রচিত বেশ কিছু ভট্টসঙ্গীত সন্নিবিষ্ট হয়েছে গ্রন্হটিতে।সম্পাদক অমলেন্দু ভট্টাচার্যের দীর্ঘ ভূমিকা এবং পরিশিষ্ট অংশে সংযোজিত কয়েকটি মূল্যবান পুরনো রচনা গ্রন্হটির গুরুত্ব বাড়িয়েছে নিঃসন্দেহে।সংকলনটির মাধ্যমে লুপ্তপ্রায় এই সংবাদ সাহিত্য ধারাকে দুই মলাটে ধরে রাখা হয়েছে-যা লোকসাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আগামী দিনের জন্যও এক দলিল হয়ে থাকবে।