মধ্যপ্রাচের সংঘাত: ভারতের অবস্থান !
শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ
June 23, 2025
নেট পাড়া এখন ইজরায়েল আর ইরানের দ্বন্দ্বে সরগরম। বিশ্ব মোড়ল অ্যামেরিকার ভূমিকায় কম্প্যুটারের কী-বোর্ড বিপ্লবীরাও ফের সরব। প্রসঙ্গক্রমেই মনে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলির কথা। জেএনইউ'তে এম ফিল করার সময় আমার গবেষণার বিষয় ছিল ইরান। যথারীতি সেই সময় সুপ্রাচীন দেশটিকে নিয়ে বিস্তৃত পড়াশুনা করতে হয়েছিল। তারপর ডেজারটেশন লিখতে গিয়ে বেছে নিয়েছিলাম উপমহাদেশের রাস্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক। আমার গাইড ছিলেন খ্যাত পন্ডিত, ডিপ্লোম্যাট এবং ইরান বিশেষজ্ঞ স্যর এ এইচ এইচ আবিদি (A H H Abidi)। ইরান সহ পশ্চিম এশিয়ার ওপর ডজন খানেক বই লিখেছেন । ইরানের সুপ্রিমো আয়াতোল্লা খোমেইনি'র সঙ্গেও একাধিকবার তাঁর সাক্ষাৎকারও ঘটেছিল । এমন সুপন্ডিত, বহু দেশ ভ্রমণকারী ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এলেও নিজের জীবনের দীক্ষা এবং অভিজ্ঞতা অনেকটাই ঋদ্ধ হয়ে যায় !
আবিদি স্যর ইরানের সঙ্গে উপমহাদেশের সদস্য রাষ্ট্র বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে কাজ করায় খুশি হয়েছিলেন। ইরানের সঙ্গে ভারত সহ উপমহাদেশের বাকি দেশগুলির সম্পর্ক নিয়ে অজস্র গবেষণা, বইপত্তর লেখা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা স্তরে সর্ব প্রথম কাজ সম্ভবত আমারই। এদিকে আবিদি স্যর ছিলেন অতি সজ্জন মুসলিম। মৌলবাদ বিরোধী। সেই আশির দশকের দ্বিতীয়ার্ধেই তিনি আমাদের সচেতন করে দিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশের ক্রম বর্ধমান মৌলবাদী চেতনা একদিন ভারতের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। ঘটনা সত্যি, বাংলাদেশের একটা শক্তি একাত্তরের যুদ্ধে কখনই ভারতের ভূমিকা মেনে নিতে পারে নি। বাংলাদেশের জন্মের অব্যবহিত পরেই মওলানা ভাসানী নামে জনৈক পলিটিশিয়্যান তীব্র ভারত বিরোধী আন্দোলন শুরু করেছিলেন।
শেখ মুজিবর রহমান নিহত হওয়ার পর জুন্টা সরকারের প্রত্যক্ষ সহায়তায় উত্তরপূর্ব ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলি অতি মাত্রায় সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। নাশকতামূলক কাজ সংগঠিত করার পর বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পালিয়ে আশ্রয় নিতো বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। অপরাধীরা ভিন দেশে আশ্রয় নিতো বলে ভারত সরকারও তেমন কিছুই করে উঠতে পারতো না। এর ফলে গোটা উত্তরপূর্ব ভারত জুড়ে কায়েম হয়েছিল এক ধরণের নৈরাজ্য। উন্নয়নের চাকা বসে গিয়েছিল মাটিতে। সে একটা সময় গেছে বটে । আবার রাম মন্দির ইস্যুতে ওই একই সময়ে কিন্তু ভারতে হিন্দু মৌলবাদীদের উত্থান ঘটছিল। একটা বহুজাতিক এবং বিবিধ ভাষাভাষীর দেশে যে মৌলবাদীদের বাড়বাড়ন্ত সোশ্যাল ফ্যাব্রিক্স'কে বিনষ্ট করতে পারে - সে কথাও তখন আলোচিত হতো। ভারতে তখনও কর্পোরেট সংস্থাগুলির প্রবেশ সে ভাবে ঘটেনি। তবে আলোচনা চলছিল । পরে নব্বুই দশকের শুরতেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আর্থিক সংস্কারের মাধ্যমে এ দেশে কর্পোরেট সংস্থাগুলির প্রবেশের পথ সুগম করে দিয়েছিলেন । পাকিস্তান, বাংলাদেশের মৌলবাদীদের সঙ্গে ভারতের মৌলবাদীদের চরিত্রগত তফাৎ অনেকটাই ।
এখন যে হিন্দু মৌলবাদের লম্ফঝম্প দেখা যাচ্ছে তা কিন্তু ইনিশিয়্যাল স্টেজ পর্যন্তই আকীর্ণ। এরপর ভারতের আরও যত অর্থনৈতিক অগ্রগতি ঘটতে থাকবে এবং কর্পোরেটদের ফুট প্রিন্টস বড় হতে থাকবে - দেশে মৌলবাদীদের প্রাসঙ্গিকতা ততই হ্রাস পাবে। হিন্দু ভারতের কনসেপশন বজায় থাকবে - তবে তার প্রাসঙ্গিকতা তেমন আর রইবে না। বরং জাতীয়তাবাদ বাড়তে পারে। জাতীয়তাবাদী, অর্থনৈতিক ভাবে উন্নত ভারতকে নিয়ে উপমহাদেশের বাকি দেশগুলির অস্বস্তি তখন আরও বাড়বে। … ইরান আর বাংলাদেশের সম্পর্কের সমীকরণে এইসব হাইপোথিসিসের কথাও উল্লেখ করেছিলাম। শেখ মুজিবর রহমানের পর বাংলাদেশ ধর্ম নিরপেক্ষতাকে সংবিধান থেকে পরিহার করেছিল। অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তিবৃদ্ধির জন্য পশ্চিম এশিয়ার মুসলিম দেশগুলির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলেছিল। আর পশ্চিম এশিয়ার মধ্যে ইরান ছিল তখন সব চেয়ে প্রভাবশালী দেশ। আবার ভারতের সঙ্গে ইরানের রয়েছে একটা অদ্ভুত নাতিশীতোষ্ণ সম্পর্ক। প্রাচীনতার বিচারে দুই দেশের সভ্যতার বয়স প্রায় এক । ইরানের প্রাচীন সভ্যতার বিকাশ ঘটে ৩২০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে আর ভারতের প্রাচীন সভ্যতার উত্থান হয় ৩৩০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ।
বলা হয় ২০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে সেন্ট্রাল এশিয়া থেকে আর্যদের অভিগমন ঘটেছিল ইরানে। সেখান থেকে তাদের শেষ অভিগমন ঘটে ভারতে । তাই হয়তো ইরানের প্রাচীন উৎসবাদির সঙ্গে উত্তর ভারতের হিন্দু পালা পার্বণের কিছুটা মিল রয়েছে। মিল রয়েছে ভাষা, শিল্প, খাদ্যাভ্যাস সহ বেশ কিছু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে। জিনগত মিলও রয়েছে। উত্তর ভারতের মধ্যে পঞ্জাব অঞ্চলের ভারতীয়দের সঙ্গে ইরানীদের জিনগত মিল বেশি ! এ ছাড়াও ইন্দো - ইরানীয় সম্পর্কে রয়েছে বহু ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্টস । জরাথুস্ট্র ধর্মের কথাই ধরা যাক। ভারতে একে পার্সি ধর্মও বলা হয়। মুসলমানেরা যখন ইরান জয় করে, তখন নিপীড়নের ভয়ে ইরানের অনেক জরথুস্ট্রিয়ান ভারতে চলে আসে এবং পার্সি নামে পরিচিত হয়। উর্দু ভাষার উৎপত্তি মূলত উত্তর ভারতে, বিশেষ করে দিল্লি ও তার আশেপাশের অঞ্চলে, দ্বাদশ শতকে। এটি খারি বলি হিন্দি ভাষার একটি রূপ থেকে বিকশিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পারসি ভাষার সংমিশ্রণ । একাত্তরের যুদ্ধে ইরান ছিল পাকিস্তানের পক্ষে । তবে কাশ্মীর প্রশ্নে দীর্ঘ সময় ইরান দৃঢ় ভাবে ভারতকে সমর্থন যুগিয়েছে। শীত যুদ্ধের পর জিও পলিটিক্স অনেক বদলেছে। চায়নার প্রতিপত্তি অনেক বেড়েছে , পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ভারতের প্রভাব । ভারত এখন চতুর্থ অর্থনৈতিক শক্তি । সামরিক শক্তিতে বিশ্বে তৃতীয়।
ভারতকে ঘিরে ফেলার জন্য এশিয়ার একামেবাদ্বীতিয়ম শক্তি হিসেবে চায়না চালু করেছে "স্ট্রিং অফ পার্লস" কৌশল। এরই প্রেক্ষিতে চায়নাকে রোখার জন্য "নেকলেস অফ ডায়মন্ডস" হল ভারতের একটি পাল্টা কৌশল। ভারত মজবুত করে নিয়েছে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, এবং আসিয়ানের দেশগুলির সঙ্গে সহযোগিতা। মিত্রতা সুদৃঢ় হয়েছে আফগানিস্থান, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, ফিলিপিন্সের সঙ্গে। পাকিস্তানে ক্রমবর্ধমান চাইনিজ প্রভাবের মোকাবিলার জন্য ইরানের চাবাহার বন্দরকে উন্নয়নের দায়িত্ব নিয়েছে ভারত। কাজ চলছে ইন্টারন্যাশনাল নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডোর নামে একটি ব্যয় বহুল প্রকল্পের। এদিকে অ্যামেরিকার নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করেও ইরানের তেল কিনেছে ভারত। এই আবহে ইরানের সঙ্গে ইজরায়েল-অ্যামেরিকার যুদ্ধ ভারতের রাজনৈতিক অবস্থানকে জটিল করে তুলতে পারে।
বাংলাদেশের মতো ভারতের প্রতিবেশী দেশ এই যুদ্ধকে ধর্মের ভিত্তিতে দেখছে । এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় সরব হতে পারে ভারতের হিন্দু মৌলবাদীরা । এরই মধ্যে ওদের গণ মাধ্যমে দেখছি এই যুদ্ধের আলোচনা করতে গিয়ে ওরা অযাচিত ভাবে ভারতকেও টেনে আনছে এবং ভারত আক্রমণ করলে কী ভাবে তা প্রতিহত করবে তা নিয়ে তুমুল আলোচনায় মত্ত হয়ে উঠেছে ! ইসরাইলের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ১৩ জন ভারতীয়সহ ৭৩ জনকে ইরান ফাঁসি দিয়েছে - এমন ফেক নিউজ ছড়িয়ে সমাজ মাধ্যমকে ওরা গরম করে তুলেছে । এমন সব ভুয়ো খবর ভারতের হিন্দু মৌলবাদীদের উত্তেজিত করে তুলতে পারে । এরই মধ্যে অনেক হিন্দু মৌলবাদী এই যুদ্ধে ইজরায়েলের সমর্থনে গলা ফাটাতে শুরু করে দিয়েছে । অশিক্ষিত এই সব মৌলবাদীরা জানেও না - স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হিসেবে ইরান আমাদের কাছে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। একই রকম ভাবে প্যালেস্তাইন এবং ইরানের সমর্থনকারী ভারতের বামপন্থীরাও জানে না ইজরায়েলের সঙ্গে আমাদের দেশের ঐতিহাসিক সম্পর্ক কতখানি গভীর। আমাদের রাজ্যের সীমান্তবর্তী রাজ্য মিজোরামের একটি সম্প্রদায়কে বলা হয় 'বেনে মেনাশে' বা 'ইহুদি সম্প্রদায়ের একটি হারানো জনগোষ্ঠী। ভারতের জনজাতির অন্তর্ভুক্ত এই গোষ্ঠীর প্রচুর লোক আজ ইজরায়েলে বাস করছেন এবং সেদেশের সেনা বাহিনিতে রয়েছেন ।
ভারতের সঙ্গে ইজরায়েলের এই যোগসূত্র নতুন কিছু নয় । ইজরায়েল তার জন্মলগ্ন থেকেই ভারতের প্রতি সলিড সমর্থন যুগিয়ে আসছে । সত্তর থেকে আশির দশক পর্যন্ত এই দেশটির সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না । কিন্তু সেই সত্তর দশকেই ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মোশে দায়ান সংগোপনে ভারত ঘুরে গিয়েছিলেন। পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমা বানানোর পরিকল্পনার কথা ভারতীয় এস্টাব্লিশমেন্টকে অবহিত করেছিলেন। শুধু তাই নয় ইজরায়েল আশির দশকের শুরুতে পাকিস্তানের নিউক্লিয়ার রি-অ্যাক্টরে বিমান হামলার ছক পর্যন্ত করেছিল। এই ব্যাপারে ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা চেয়েছিল । তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রাজীও হয়েছিলেন । কিন্তু অপারেশনের ঠিক দিন সাতেক আগে অ্যামেরিকান প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে তিনি পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন । সে সব এখন অতীত । ইজরায়েলের সঙ্গে ভারতের সামরিক সম্পর্কও মজবুত হয়েছে। সে দেশের বিভিন্ন প্রকল্পে এখন প্রচুর ভারতীয় কাজ করছে । রেমিট্যান্স হিসেবে সে অর্থ আসছে আমাদের দেশে । এমন সব ঘটনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, ইজরায়েল এবং ইরান - দু'টি দেশই ভারতের বিশ্বস্ত বন্ধু । দুই দেশের সঙ্গেই রয়েছে ভারতের বিশাল অঙ্কের অর্থনৈতিক সম্পর্ক। তাই এই যুদ্ধে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করা ছাড়া উপায় নেই। তবে শুধু নিরপেক্ষতা নয় - ভারত যদি এই যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেয় এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের সুত্র বের করতে পারে তবে পশ্চিম এশিয়ায় আমাদের দেশের প্রভাব প্রতিপত্তি আরও বৃদ্ধি পাবে।
আরও পড়ুন...