সুপ্রিম কোর্টে আর্জি টিকবে কিনা সন্দেহ, চুড়ান্ত অনিশ্চয়তার মুখে ১০৩২৩ শিক্ষকরা !
জয়ন্ত দেবনাথ
সুপ্রিম কোর্ট ১০৩২৩ শিক্ষকদের অশিক্ষক পদে চাকুরী দিতে অনুমতি দিলে আমরা তাদের চাকুরী দেবো- এধরনের একটি আবেদন নিয়ে ত্রিপুরা সরকার ১০৩২৩ শিক্ষকদের চাকুরীচ্যুতির সমস্যা সমাধানে যে মানবিক দায়িত্ব পালনের উদ্দ্যোগ নিয়েছেন এনিয়ে বিজেপি ছাড়া রাজ্যের সব ক’টি রাকনৈতিক দল, শিক্ষক সংগঠন এমন কি ১০৩২৩ শিক্ষকদের সবক’টি সংগঠন রাজ্য সরকারের সদ ইচ্ছার প্রতি প্রশ্ন তোলেছেন। অভিযোগ রয়েছে, বিগত বাম সরকারও যে পথে সমস্যার সমাধান হবেনা সেই পথে হেটে ১০৩২৩ শিক্ষকদের জীবনে অন্ধকার ডেকে এনেছেন। বর্তমান বিজেপি সরকারও একই পথে হাটছেন।
রাজ্যের বুদ্ধিজীবী মহলে কথা উঠেছে, সংবিধান ও আইনকে তোয়াক্কা না করে যে যার পছন্দ মতো দলীয় নীতি, আদর্শ ও রাজনৈতিক ইচ্ছাকে কায়েম করার অপচেষ্টার প্রেক্ষিতেই আজ ১০৩২৩ জন শিক্ষকের জীবনে একটা কালো অধ্যায়ের সূচনা হলো। ২০১০ ও ২০১৪ সালে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও অস্নাতক মিলিয়ে যে ১০৩২৩ শিক্ষকের চাকুরী হয়েছিল সেখানে আইনের চোখে নিয়োগ নীতি ও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কিছু গলদ ছিল। তাই আদালত নিয়োগনীতিটিকে বাতিল করে যাদের চাকুরী আদালতে চেলেঞ্জ হয়েছিল সেই চাকুরী গুলি বাতিল করেছিল। কিন্তু আদালতের নির্দেশকে কার্যকর করতে গিয়ে তৎকালীন বাম সরকার ভুল পথে সমস্যার সমাধানের অপচেষ্টা করে গেছেন। কেননা, ২০১০ সালে ৪৭০০ জন স্নাতক শিক্ষক ও ১১০০ এর কাছাকাছি স্নাতকোত্তর ও ২০১৪ সালে সাড়ে চার হাজারের মতো অস্নাতক শিক্ষকদের চাকুরী মামালার রায় দান কালে উচ্চ আদালত কখনই কোথাও একথা বলেনি যে ১০৩২৩ প্রাপকের সবার চাকুরী যাবে।
কেননা, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষক মামলায় উচ্চ আদালতে নিয়োগ নীতিটির চ্যালেঞ্জ হয়নি। শুধু ৫৮ জন আবেদনকারীর সবারই দাবী ছিল, যে মেরিট বা মেধা কিংবা সিনিয়রিটি ও নিডি-র কথা উল্লেখ করে তখন শিক্ষক পদে লোক নিয়োগ হয়েছিল, ওই ৫৮ জন আবেদনকারীও সেই অনুযায়ী যোগ্য। ওই ৫৮ জন আবেদনকারী ২০০৩ সালের নিয়োগ নীতিটির চ্যালেঞ্জ করেনি। নিয়োগনীতিটি মেনে নিয়েই তাদের দাবী ছিল- আমরাও যোগ্য, আমাদেরকেও চাকুরী দাও। তাই তখন আদালতের নির্দেশ মেনে তাদের চাকুরীতে নিয়ে নিলেই ল্যাটা চুকে যেতো। কিন্তু তৎকালীন সরকার এটা না করাতেই আজ এই অরাজক অবস্থা তৈরী হয়েছে।
উচ্চ আদালতের বিচারপতি বি কে শর্মা তার প্রথম রায়-এ বলেছিল, যে ৫৮ জন আদালতের দ্বারস্থ হয়ে ২০০৩ সালের নিয়োগ নীতি অনুযায়ী তাদের যোগ্য বলে দাবী করেছিল, তাদের আবেদনটি খতিয়ে দেখে রাজ্য শিক্ষা দপ্তর যেন তাদের ব্যাপারে ন্যায় সঙ্গত সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্যে বি কে শর্মা চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে গোটা বিষয়টির নিষ্পত্তির কথা বলেছিল। অর্থাৎ তখন যদি বাম সরকারের শিক্ষা দপ্তর ওই আবেদন গুলি খতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহনের পথে এগুতো তাহলে আজ হয়তো ১০৩২৩ জন শিক্ষকের জীবনে এমন কালো দিন ঘনিয়ে আসতো না। কিন্তু রাজ্য শিক্ষা দপ্তর বা দপ্তরের মন্ত্রী সেই পথে না গিয়ে বি কে শর্মার রায় –এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের ডিভিশন বেঞ্চের দ্বারস্থ হয়ে উল্টো বিপদ ডেকে আনলেন।
পরবর্তীকালে ২০১৪ সালে অস্নাতক বা আন্ডার গ্র্যাজুয়েট পদে যে সাড়ে চার হাজারের মতো অস্নাতক শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছিল সেখানে সরাসরিই ২০০৩ সালের নিয়োগ নীতিটির চ্যালেঞ্জ হয়েছিল। তাছাড়া নিয়োগ প্রক্রিয়ায়ও গলদ ছিল। কেননা, তখন অবৈতনিক শিক্ষা আইন ২০০৯ দেশে লাগু হয়ে গিয়েছিল। তাই বি এড, ডি এল এড পাশ ছাড়া বেকারদের শিক্ষকতার চাকুরীতে নেওয়ার কথা নয়। কিন্তু রাজ্যে তখন অবৈতনিক শিক্ষা আইন ২০০৯ অনুযায়ী যোগ্যতা সম্পন্ন এত বিশাল সংখ্যক শূন্য পদে বি এড, ডি এল এড পাশ বেকারদের নিয়োগ সম্ভব ছিলনা। কেননা, এতসংখ্যক বি এড, ডি এল এড পাশ বেকার পাওয়া রাজ্যে অসম্ভব ছিল। তাই রাজ্যের দাবি মেনে কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক অস্নাতক শিক্ষক পদে নিয়োগে শিক্ষাগত যোগ্যতার ক্ষেত্রে এককালীন ছাড় দিতে সম্মত হয়। কিন্তু শুধু উচ্চ মাধ্যমিক পাশ বেকারদেরই অস্নাতক শিক্ষক পদে নিয়োগে এককালীন ছাড় দিয়েছিল। বলা হয়েছিলো উচ্চ মাধ্যমিক পাশ বেকারদের বি.এড, ডি.এল.এড না থাকলেও চলবে। কিন্তু তখন শিক্ষা দপ্তর কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের গাইডলাইন অমান্য করে মাধ্যমিক পাশ বেকারদেরও শিক্ষক পদে নিয়োগ করেন। সিনিয়রিটি, নিডি কাম মেরিটের ভিত্তিতে তৈরী করা ২০০৩ সালে তৈরি একটা পলিসির ভিত্তিতে শিক্ষকদের নিযুক্তি দেন। অস্নাতক শিক্ষক পদে নিয়োগে বামফ্রন্ট সরকারের নিডি, সিনিয়রিটি কাম মেরিট-এর ভিত্তিতে তৈরি এই নিয়োগ নীতিটি সরাসরি চ্যালেঞ্জ হয়েছিল উচ্চ আদালতে। ততক্ষনে ত্রিপুরায় নিজস্ব হাইকোর্ট চালু হয়ে যায়। আর প্রথম বিচারপতি হিসাবে দীপক গুপ্তা ঠিক করলেন যেহেতু শিক্ষক পদে চাকুরী নিয়ে প্রচুর মামলা হয়ে গেছে তাই তিনি এক সঙ্গে সব চাকুরী মামলার শুনানির সিদ্ধান্ত নিলেন। আর তখনই রাজ্য শিক্ষা দপ্তরের মেরিট, নিডি কাম সিনিয়ারিটির ভিত্তিতে তৈরি ২০০৩ সালের নিয়োগনীতিটি ত্রিপুরা উচ্চ আদালতের রায়-এ অসাংবিধানিক হিসাবে চিহ্নিত হয়ে যায়। এবং উচ্চ আদালতের ডিভিশন বেঞ্চের রায় সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায়। উচ্চ আদালত জানায়, অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার ভিত্তিতে বামফ্রন্ট সরকারের তৈরী ২০০৩ সালের নিয়োগনীতিটি ছিল অসাংবিধানিক। কিন্তু উচ্চ আদালতের বিচারপতি দীপক গুপ্তা ও এস সি দাস এর ডিভিশন বেঞ্চ নিয়োগনীতিটি বাতিল করে দিলেও সবারই চাকুরী চলে যাবে তাদের রায়ের কোথাও এমন কথা বলেননি। নিয়োগ নীতিটি বাতিল করে দিয়ে বলা হয়েছিল অস্নাতক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষকদের মধ্যে শুধু যাদের চাকুরীগুলি বিপক্ষের আবেদনকারীরা চ্যালেঞ্জ করেছিল শুধু তাদেরই চাকুরী যাবে। স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও অস্নাতক মিলিয়ে ১০৩২৩ জনের মধ্যে যাদের চাকুরী সরাসরি চ্যালেঞ্জে হয়েছিল এই সংখ্যাটা ৪৬১। ২০০৩ সালের নিয়োগনীতিটি অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে উচ্চ আদালতের এই রায়টিই পরবর্তীকালে সুপ্রিম কোর্ট বহাল রাখে। এই অনুযায়ী মামলার রায়টি ব্যাখ্যা করলে ২০১০ সালে ৪৭০০ স্নাতক ও ১১০০ স্নাতকোত্তর শিক্ষকের সবার চাকুরী চলে যাওয়ার কথা নয়। শুধু অস্নাতক শিক্ষক পদে যাদের চাকুরী উচ্চ আদালতে সরাসরি চ্যালঞ্জ হয়েছিল শুধু তাদেরই চাকুরিচ্যুত হওয়ার কথা ছিল। কেননা, দীপক গুপ্তা ও এস সি দাস-এর ডিভিশন বেঞ্চের রায়ের ১২৭ নং প্যারায় স্পষ্ট করেই একথা বলা আছে যে- Since we have set aside the revised employment policy which applies to a large category of post and not merely to teachers we would like to make it clear that our judgment shall be prospective in nature and shall not affect the appointments already made unless the said appointments are already under challenge before the court on the ground that the employment policy is illegal- পরোক্ষে হাইকোর্ট তাদের রায়ের ১২৭ নং ধারায় বর্ণিত মন্তব্যের মাধ্যমে যাদের চাকুরী আদালতে সরাসরি চ্যালেঞ্জ হয়নি তাদের চাকুরীগুলি বহাল রেখেছিলেন।
অর্থাৎ হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট বাতিল হয়ে যাওয়া ২০০৩ সালের নিয়োগনীতি অনুযায়ী যতজন শিক্ষক, অশিক্ষক কর্মচারী চাকরি পেয়েছিল তাদের নিঃসন্দেহে স্বপদে বহাল রাখলেন, বাদ দিলেন শুধু তাদের যাদের চাকরির ‘বৈধতা’ নিয়ে কোর্টে মামলা হয়েছে। ৫৮টি মামলায় এই শিক্ষকদের সংখ্যা ৪৬১ জন যাদের চাকুরী সরাসরি চ্যালঞ্জ হয়েছিল। কোর্টের রায় অনুযায়ী বাকি ৯৮৬২ জন শিক্ষক চাকরিতে বহাল আছেন এবং থাকবেন। কিন্তু পরবর্তীকালে প্রশাসনিক একটি আদেশ জারী করে ১০৩২৩ জন শিক্ষকের চাকুরী বাতিল সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টে দায়ের করা অন্য একটি মামলায় রাজ্য সরকার স্বতপ্রনোদিত হয়ে প্রত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে সবাইকে পক্ষভুক্ত করেন। প্রশাসনিক কোনও আদেশ দিয়ে তাদের চাকরি বাতিল করা শুধু বেআইনিই নয়, আদালতের আদেশ অবমাননার শামিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের চূড়ান্ত রায়-এ প্রকৃত কি বলা হয়েছিল তৎকালীন সরকারের আইনী পরামর্শদাতারা এটা কোন ভাবেই শিক্ষা দপ্তর এবং বামফ্রন্টের মন্ত্রীদের বুঝাতে পারেননি বা মন্ত্রীরা বুঝতে চাননি। এমন অভিযোগও রয়েছে বামফ্রন্ট সরকারের আইনি পরামর্শদাতারা প্রথম দিকে হাইকোর্টের ফুল জাজমেন্টটিই নাকি গুরুত্ব দিয়ে পড়ে দেখেননি।
সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো ২০১৮ সালের বিধানসভা ভোটের প্রাক্কালে যে বিজেপি নেতারা ১০৩২৩ শিক্ষকদের দল ক্ষমতায় এলে মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে গোটা বিষয়টির সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেই বিজেপি নেতৃত্বই এক্ষণে অন্য খেলায় মেতে উঠেছেন। এক্ষণে বলা হচ্ছে, শিক্ষক পদে তাদের রাখা যাবে না। চেষ্টা করা হবে বিভিন্ন দপ্তরের অন্যান্য শূন্যপদে তাদের নিয়োগ করার। এজন্যে নাকি রাজ্য সরকার ১০৬০০ টি শূন্যপদ খোঁজে বের করেছেন। সমাজ শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য, পশুপালন, অডিট দপ্তর, গ্রামোন্নয়ন, পূর্ত ইত্যাদি দপ্তরের যেসব নন টেকনিক্যাল গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি পদ রয়েছে সেই সব পদে নাকি আগামী ৩১শে মার্চ এর পরে চাকুরীচ্যুত এসব শিক্ষকদের নিয়োগের চেষ্টা হবে। তাও সুপ্রিম কোর্টের তরফে যদি সবুজ সংকেত পাওয়া যায় তবেই রাজ্য সরকার অগ্রসর হবে। গত ক’দিন সমানে ১০৩২৩ শিক্ষক সংগঠনগুলির তীব্র আন্দোলনের মুখে গত ১৯শে মার্চ ২০২০ সন্ধ্যায় শিক্ষামন্ত্রী শ্রী রতন লাল নাথ স্বয়ং রাজ্য সরকারের এমন উদ্যোগের বিষয়টি জন সমক্ষে আনেন। শিক্ষামন্ত্রীর এই ঘোষণাটি বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে প্রকাশ্যে আসতেই সংশ্লিষ্ট শিক্ষক মহলে বিভিন্ন প্রশ্নের উদ্রেগ হয়- প্রশ্ন উঠেছেঃ-
১) যদি শিক্ষক পদে তাদের রাখাই না হয় তাহলে চাকুরী চ্যুতির মাত্র ১২ দিন আগে কেন রাজ্য সরকার নতুন করে অশিক্ষক পদে তাদের নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করলেন? কেন তারা চাকুরীতে থাকতে থাকতে তাদের জন্য বিপেপি-র ভিশন ডকুমেন্টে প্রদত্ত নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এই মানবিক উদ্যোগটি সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে নেওয়া হল না?
২) আগামী ৩১শে মার্চ এর পর তাদেরকেও সাধারণ বেকারদের তালিকায় ধরা হবে। তখন কিভাবে তাদের অন্যান্য বেকারদের থেকে পৃথক দেখিয়ে বিনা ইন্টারভিউতে তাদের সরাসরি নিয়োগ করা হবে? সুপ্রিম কোর্ট কেন ও কিভাবে এমন পক্ষপাত দুষ্ট রায় দিতে পারে বা দিতে যাবে?
৩) সুপ্রিম কোর্ট যদি তাদেরকে অন্য কোন অশিক্ষক পদে সরাসরি নিয়োগের অনুমতি না দেন তখন কি হবে?
শিক্ষামন্ত্রী যখন ১৯শে মার্চ ২০২০, সন্ধ্যায় সচিবালয়ে সাংবাদিক সন্মেলনে সুপ্রিম কোর্টের সন্মতি এনে ১০৩২৩ শিক্ষকদের অশিক্ষক পদে নিয়োগের ঘোষণাটি দেন তখন উপস্থিত সাংবাদিকরাও উল্লেখিত তিনটি প্রশ্ন শিক্ষামন্ত্রীকে করেছিলেন। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী ওই সাংবাদিকদের সব সময় ‘পজিটিভ’ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সবকিছু ভাবতে পরামর্শ দিয়ে পাশ কেটে যান। তাই স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, ১০৩২৩ জন শিক্ষক শিক্ষিকা ফের একবার রাজনৈতিক কূটচালের শিকার হবেন না তো? কেননা, পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের সময়েও দেখা গেছে ১৯৯৩ সালে তৎকালীন কংগ্রেস ও ত্রিপুরা উপজাতি যুব সমিতির জোট সরকারের সময়ে বেআইনিভাবে চাকুরী প্রাপ্ত পুরসভা থেকে ৩৮৭ জন ছাঁটাই হয়েছিল। এনিয়েও তখন কম রাজনীতি হয়নি। ৩৮৭ জন পুর ছাঁটাই কর্মচারীর টানা চার বছর সামনে তীব্র আন্দোলনের মুখে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী দশরথ দেব ওই ছাঁটাই পুর কর্মচারীদের ধাপে ধাপে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে নিয়োগের প্রতিশ্রুতিও দেন। এনিয়ে বর্তমান বিজেপি সরকারের মতো তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের তথ্য দপ্তর থেকে প্রেস রিলিজও বের হয়। কিন্তু কোন ফল হয়নি। সরকারী প্রচার দপ্তরের প্রেস রিলিজ আদালতেও মান্যতা পায়নি। পুরসভার ছাঁটাই ৩৮৭ জন কর্মচারী আজও চাকুরী পাননি। বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার আগে তাদের বহু নেতা আশ্বাস দিয়েছিল দল ক্ষমতায় এলে ১৯৯৩ সালে বাম আমলে ছাঁটাই পুর কর্মচারীদের পুনঃনিয়োগের ইস্যুটাও দেখা হবে। তারাও এক্ষণে রাস্তায় নেমে আন্দোলন শুরু করেছেন। কিন্তু কিছু হবে বলে এখনো কোন সবুজ সংকেত পাওয়া যায়নি। অসহায় বেকার কুলকে নিয়ে যে এভাবে রাজনীতি হবে বা হয়ে থাকে শুধু ১০৩২৩ শিক্ষক শিক্ষিকারাই তার একমাত্র উদাহরণ নয়, ত্রিপুরার ইতিহাসে তার আরও বহু নজির রয়েছে। ‘গাং পেরোলে মাঝি শালা’- এই প্রবাদ বাক্যটি এ রাজ্যের বুকে আবারও সত্যে পরিণত হবে না তো (?)। এই প্রশ্নটি ইতিমধ্যেই উঠে গেছে।
রাজ্যের অবসরপ্রাপ্ত এক বিচারপতি এবি পাল সহ একাধিক আইন বিশেষজ্ঞ মনে করেন ১০৩২৩ শিক্ষকদের একই চাকুরীতে বহাল রাখতে বিজেপি সরকারে যদি সৎ বা আন্তরিক উদ্দেশ্য থাকে তাহলে রাজ্য বিধানসভায় একটা ‘ভেলিডেশন অ্যাক্ট’ পাশ করিয়ে নিলেই চলে। এ ধরনের আইনি জটিলতা থেকে বের হতে দেশের বহু রাজ্যে ইতিপূর্বে ভেলিডেশান অ্যাক্ট করে সমস্যার সমাধান হয়েছে। তাই ত্রিপুরা সরকারও অনায়াসেই এটা করতে পারে। অবশ্য এক বাম মন্ত্রী এবং এই অংশের আইনী বিশেষজ্ঞদের দ্বিতীয় অভিমত হলো-সুপ্রীমকোর্টের রায়-এ চাকুরিচ্যুত ১০৩২৩ শিক্ষকদের অন্য দপ্তরে সরাসরি নিয়ুগে বামফ্রন্ট সরকার যে ১৩ হাজার অশিক্ষক পদে তাদের নিযুক্তি দিতে চেয়ে ইন্টারভিউ গ্রহণ করেছিল ওই শুন্যপদ গুলিতেও ইচ্ছা করলে তাদের নিযুক্তি দেওয়া যেতে পারে। কেননা, প্রথম দিকে সুপ্রিম কোর্ট এই পদগুলি পূরণে স্থগিতাদেশ দিলেও পরবর্তীকালে তা প্রত্যাহৃত হয়েছিল। বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী রতনলাল নাথ এর দাবী অনুযায়ী দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা এই শূন্যপদগুলিতে লোক না নেওয়ার কারনে এই ১৩০০০ পদ বাতিল বা অবলুপ্ত হয়ে গেলেও রাজ্য মন্ত্রিসভায় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে তা ফের জ্যান্ত করা যেতে পারে। কিন্তু এটা না করে টানা দশ বছর চাকুরী করার পর ১০৩২৩ জন শিক্ষককে এক্ষণে অশিক্ষক পদে নিযুক্তি দিতে চেয়ে ‘স্পেশাল পারমিশন’ আনতে ‘ইন্টার লোকোটেরী এপ্লিকেশন’ নিয়ে যেভাবে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হচ্ছে রাজ্য সরকার এটা কতটা ধুপে টিকবে তা বলাই বাহুল্য। তাছাড়া সুপ্রিমকোর্টে মামলার প্রক্রিয়াটিও সময় সাপেক্ষ ও অনিশ্চয়তায় ভরা। অশিক্ষক পদে এতগুলি লোককে সরাসরি নিয়োগে সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করবে কিনা সন্দেহ। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন পর্যন্ত দেশে এমন কোন নজীর নেই যে, সরাসরি কোন পদে লোক নিয়োগ করতে সুপ্রিম কোর্ট কোন রাজ্যকে এভাবে বিশেষ কোন মঞ্জুরী দিয়েছেন বা এ ধরনের আবেদন মঞ্জুর করেছেন। আর সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করলেও খুব সহশায় কিছু হবেনা। কেননা, সুপ্রিম কোর্ট এক্ষণে করোনা ভাইরাসের কারনে খুব বেশী গুরুত্বপুর্ন না হলে কোন মামলার শুনানি করছেন না। তাই আগামী ৩১ মার্চ ২০২০ তারিখের পর ১০৩২৩ শিক্ষকদের আর চাকুরী থাকবেনা এটা অন্তত নিশ্চিত করেই বলা যায়।