দানবীয় শক্তির বিরুদ্ধে মানবতার জয়
ড. মোহন ভাগবৎ
দানবীয় শক্তির বিরুদ্ধে মানবতার বিজয়কে চিহ্নিত করতে আমরা প্রতি বছর বিজয়া দশমী উদযাপন করি। এই বছর এই উৎসব গর্ব, আনন্দ এবং দেশবাসীর মনে উদ্দীপনা সঞ্চারকারী ঘটনাবলি নিয়ে উপস্থিত হয়েছে।
গত এক বছর ধরে বিভিন্ন বৃহৎ রাষ্ট্রের সংগঠন জি-২০র সভাপতিত্বের ভূমিকায় ছিল আমাদের দেশ। সারা বছর ধরে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী, প্রশাসকবৃন্দ এবং রাজনীতিবিদদের উপস্থিতিতে বহু অনুষ্ঠাन আয়োজিত হয়। ভারতীয়দের উষ্ণ আতিথেয়তার অভিজ্ঞতা, ভারতের গৌরবময় অতীত এবং বর্তমানের উৎসাহপূর্ণ উত্থান সমস্ত দেশের অংশগ্রহণকারীদের মুগ্ধ করেছে। আফ্রিকান ইউনিয়নকে সদস্য হিসাবে গ্রহণ করা এবং সেই সংক্রান্ত প্রস্তাব প্রথমদিনেই পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের প্রকৃত সদিচ্ছা এবং কূটনৈতিক দক্ষতার অভিজ্ঞতা সকলেই অনুভব করেছেন। ভারতের অনন্য চিন্তাভাবনা এবং দৃষ্টিভঙ্গির কারণে 'বসুধৈব কুটুম্বকম্' -এর দর্শন সমগ্র বিশ্ব এক নতুন দিশা হিসাবে গ্রহণ করেছে। জি-২० এর অর্থনীতিকেন্দ্রিক ধারণা এখন মানবকেন্দ্রিক উদ্যোগ হয়ে উঠেছে। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের দেশের বর্তমান নেতৃত্ব বিশ্ব মঞ্চে ভারতকে অন্যতম প্রধান এবং প্রভাবশালী রাষ্ট্ররূপে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রশংসনীয় কাজ করেছেন।
এবারে, আমাদের দেশের ক্রীড়াবিদরা 'এশিয়ান গেমস'-এ ১০৭টি পদক ( ২৮টি স্বর্ণ, ৩৮টি রৌপ্য এবং ৪১টি ব্রোঞ্জ) জয় করে আমাদের সকলের আনন্দ-উৎসাহ বৃদ্ধি করেছেন। আমরা তাদের অভিনন্দন জানাই। চন্দ্র অভিযানের ক্ষেত্রে বিশ্ব মানচিত্রে উদীয়মान ভারতের শক্তি, বুদ্ধিমত্তা এবং কারিগরি কৌশল আজ স্বীকৃত। দেশের বর্তমান নেতৃত্বের আগ্রহ আমাদের বিজ্ঞানীদের জ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার সাথে যুক্ত হয়েছিল। মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে এই প্রথম ভারতের বিক্রম ল্যান্ডার চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করেছে। যে সমস্ত বিজ্ঞানীরা এই কাজটি সম্পন্ন করেছেন, তারা সমস্ত ভারতীয়কে গর্বিত করেছেন এবং দেশের মানুষের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলেছেন। তাদের সমগ্র দেশ সম্মান জানাচ্ছে।
সমগ্র জাতির প্রেরণার উৎস হলো জাতীয় আদর্শ এবং এই আদর্শ সেই জাতির বৈশ্বিক উদ্দেশ্য অর্জনে দিশা দেখায়। তাই আমাদের সংবিধানের মূল প্রতিকৃতির পাতায় যে ভগবান শ্রীরামের চিত্র রয়েছে তাঁরই শ্রীমন্দির অযোধ্যায় নির্মিত হচ্ছে। ঘোষণা করা হয়েছে যে ২২ জানুয়ারী মন্দিরের গর্ভগৃহে শ্রী রামলালার শুভ অভিষেক অনুষ্ঠিত হবে। ব্যবস্থার সুবিধার জন্য এবং নিরাপত্তাজনিত কারণে খুব সীমিত সংখ্যক মানুষ সেই শুভ অনুষ্ঠানে অযোধ্যায় উপস্থিত থাকতে পারবেন। শ্রীরাম আমাদের দেশে মানবিক আচরণের, মর্যাদার, কর্তব্য পালনের, স্নেহ ও করুণার প্রতীক। আমাদের মননে যে অযোধ্যা বিরাজিত সেখানে ভালোবাসা, প্রচেষ্টা এবং শুভেচ্ছার ভাব জাগ্রত হোক।
যিনি তাঁর জীবন দিয়ে সমগ্র বিশ্বকে অহিংসা দয়া এবং নৈতিকতার পথ দিয়েছিলেন সেই শী মহাবীর স্বামীর ২৫৫০তম নির্বাণ বৰ্ষ, হিন্দু স্বরাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিদেশিদের চাপিয়ে দেওয়া একনায়কত্ব থেকে মুক্তির পথ প্রদর্শনকারী শিবাজি মহারাজের রাজ্যাভিষেকের ৩৫০ বছর, ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের ৭৫ বর্ষপূর্তি এবং মহর্ষি দয়ানন্দ স্বামীর ২০০তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করেছি এই বছরে। আগামী বছরটি এমন দুই ব্যক্তিত্বের স্মরণের বছর, যারা জাতীয় জীবনে চিরকালের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন। আগামী বছর রাণী দুর্গাবতী যিনি আত্মসম্মান এবং স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগ করেছিলেন এবং উদ্যম, সাহস, ধৈর্য, বুদ্ধিমত্তা, শক্তি এবং সাহসিকতার পাশাপাশি তার প্রশাসনিক দক্ষতা এবং জনচেতনার জন্য আদর্শ হয়ে উঠেছিলেন – তার ৫০০তম জন্ম- মবার্ষিকী। তিনি ছিলেন ভারতীয় নারীদের সামনে সর্বাত্মক প্রতিশ্রুতি, নেতৃত্বের ক্ষমতা, উজ্জ্বল বিনয় এবং জ্বলন্ত দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
তামিল সাধক শ্রীমৎ রামালিঙ্গ ওয়ান্নালারের ২০০তম জন্মবার্ষিকী সম্পন্ন হয়েছে। তিনি তার যৌবনকাল থেকে দেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে ঝাপ দিয়েছিলেন। দরিদ্রদের মধ্যে অন্নদানের যে কর্মসূচি তিনি আরম্ভ করেছিলেন তা এখনও তামিলনাড়ুতে চলছে।
এসব অনুপ্রেরণাদায়ী ব্যক্তিত্বদের জীবনকে। স্মরণ করে আমরা সবাই আমাদের স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের পূর্ণতার দিনে সামাজিক সাম্য, ঐক্য ও আত্মরক্ষার বার্তা পাই।
এসব অনুপ্রেরণাদায়ী ব্যক্তিত্বদের জীবনকে। স্মরণ করে আমরা সবাই আমাদের স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের পূর্ণতার দিনে সামাজিক সাম্য, ঐক্য ও আত্মরক্ষার বার্তা পাই।
সমগ্র বিশ্বকে একই রঙে রাঙানোর বা অভিন্নতা অর্জনের কোনো প্রচেষ্টা আজ পর্যন্ত সফল হয়নি, ভবিষ্যতেও সফল হবে না। ভারতের পরিচয় এবং হিন্দু সমাজের পরিচয় বজায় রাখার চিন্তা স্বাভাবিক। আজকের বিশ্বের সমসাময়িক চাহিদা মেটাতে, নিজস্ব মূল্যবোধের ভিত্তিতে, সময়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ভূমিকা পালন করে ভারত অগ্রসর। আজকের বিশ্ব ভারতের কাছে এই আশা করে।
সমগ্র বিশ্ব আজ উপাসনাভিত্তিক সম্প্রদায় থেকে উদ্ভুত মতান্ধতা, ঔদ্ধত্য ও উন্মাদনার মুখোমুখি। স্বার্থের সংঘাত ও চরমপন্থার কারণে উদ্ভূত ইউক্রেন বা গাজা উপত্যকার যুদ্ধের মতো সংঘাতের কোনো সমাধান নেই। প্রকৃতিবিরুদ্ধ জীবনযাপন, স্বার্থপরতা এবং লাগামছাড়া ভোগবাদ নতুন নতুন শারীরিক ও মানসিক রোগের জন্ম দিচ্ছে।
মানসিক বিকার, বিশৃঙ্খলতা ও অপরাধ প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে। চরম স্বার্থপরতার কারণে পরিবারগুলি ভেঙে যাচ্ছে। প্রকৃতির সীমাহীন শোষণের কারণে দূষণ, উষ্ণতা বৃদ্ধি, ঋতুগত ভারসাম্যহীনতা এবং এর ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতি বছরই বাড়ছে। সন্ত্রাস, শোষণ ও আগ্রাসন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে অবশিষ্ট বিশ্ব তার অসম্পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে এই সঙ্কট মোকাবিলা করতে পারে না। তাই চিরন্তন মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের ভিত্তিতে ভারত নিজে উদাহরণ হয়ে বিশ্বকে প্রকৃত সুখ ও শাস্তির নতুন পথ দেখাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
এই বিরূপ পরিস্থিতিগুলি ততটা ব্যাপক আকারে না হলেও আমাদের ভারতেও প্রকট।উদাহরণস্বরূপ, সম্প্রতি আমরা হিমাচল প্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ড থেকে সিকিম পর্যন্ত হিমালয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটা প্রত্যক্ষ করছি। এসব ঘটনা ভবিষ্যতে আরও গুরুতর ও ব্যাপক সঙ্কটের পূর্বাভাস দিচ্ছে বলে আশঙ্কা
করা হচ্ছে।
দেশের সীমান্ত নিরাপত্তা, জল সুরক্ষা এবং পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য ভারতের উত্তর সীমান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং যেকোনও মূল্যে এটিকে সুরক্ষিত করতে হবে। নিরাপত্তা, পরিবেশ, জনসংখ্যা ও উন্নয়নের দৃষ্টিকোণ থেকে এই সমগ্র অঞ্চলকে একক হিমালয় অঞ্চল হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। বহু বছর ধরে ভারতের উত্তর সীমান্তে চিনের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তাই এই এলাকার বিশেষ ভূতাত্ত্বিক, কৌশলগত এবং ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। এই কথা মাথায় রেখে এই এলাকাটিকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে হবে।
যদিও এই ঘটনাগুলি হিমালয় অঞ্চলে বেশি ঘটছে, তবুও দেশের বাকি অংশের জন্য এগুলি সতর্কতার বার্তা। অপরিণামদর্শী, বস্তুবাদী ও চরম ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর উপর ভিত্তি করে উন্নয়নের পথে এগোনোর ফলে মানবতা ও প্রকৃতি ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এসব ব্যর্থতার পথ পরিত্যাগ করে অথবা ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়িয়ে, ভারতীয় মূল্যবোধ তথা ভারতের সামগ্রিক একাত্মতার দৃষ্টিভঙ্গীর ভিত্তিতে, কালানুগ ও আধুনিক প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তিত নিজস্ব স্বতন্ত্র উন্নয়নের পথ এই দেশকেই তৈরি করতে হবে। এটি বিশ্বের জন্য একটি অনুকরণীয় মডেল হতে পারে। আমাদেরকে অন্ধ অনুকরণ, জড়তা ও গোঁড়ামি, ভুল পথে চলার প্রবণতা ত্যাগ করতে হবে।
আমাদের ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে মুক্ত হতে হবে এবং আমাদের দেশের জন্য যা উপযোগী তা বিশ্বের অন্য অংশ থেকে গ্রহণ করতে হবে। আমাদের দেশে যা আছে তা সময়ের উপযোগী করে আমরা আমাদের নিজস্ব স্বআধারিত উন্নয়নের স্বদেশী বিকাশের পথ গ্রহণ করতে পারি, এটাই সময়ের আবশ্যকতা।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে সাম্প্রতিক কিছু নীতির পরিবর্তন হয়েছে এমনটা দৃষ্টিগোচর হয়। সমাজেও কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, পরিষেবা, সমবায় ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নিত্য নতুন সফল পরীক্ষার সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। কিন্তু প্রশাসনের ক্ষেত্রে এবং বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যারা সব ক্ষেত্রে চিন্তাভাবনা করেন এবং দিকনির্দেশনা দেন তাদের মধ্যে এ ধরনের সচেতনতা বেশি প্রয়োজন। সরকারের স্বনির্ভর সুযোগ- সুবিধা, প্রশাসনের তৎপরতা, ধারাবাহিক ও জনমুখী কাজ এবং উন্নয়নমূলক কাজে সমাজের সহযোগিতা ও সমর্থনই দেশকে পরিবর্তনের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। মণিপুরের বর্তমান অবস্থার দিকে তাকালে এই বিষয়টি মাথায় আসে। প্রায় এক দশক ধরে শান্তিপূর্ণ অবস্থানে থাকা মণিপুরে হঠাৎ করে এই পারস্পরিক বিরোধ কীভাবে শুরু হলো? যারা হিংসা করেছে তাদের মধ্যে কি সীমান্তের ওপারের চরমপন্থীরাও ছিল?
কেন এবং কাদের দ্বারা নিজেদের অস্তিত্বের ও ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত মণিপুরী মেইতেই সম্প্রদায় এবং কৃকি সম্প্রদায়ের মধ্যে এই পারস্পরিক দ্বন্দ্বকে একটি সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। বছরের পর বছ ধরে সমান দৃষ্টি দিয়ে সকলের সেবায় নিয়োজিত সংঘের মতো একটি সংগঠনকে বিনা কারণেই এর মধ্যে টেনে আনায় কাদের গোপন স্বার্থ আছে। এই সীমান্ত এলাকায় নাগ-ভূমি ও মিজোরামের মধ্যে অবস্থিত মণিপুরে এমন অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিতে কোনও বিদেশি শক্তি আগ্রহী হতে পারে। গত ৯ বছর ধরে চলমান শান্তি বজায় রাখতে চেয়েছিল এমন একটি রাজ্য সরকার থাকা সত্ত্বেও কেন এই হিংসা ছড়িয়ে পড়ে এবং চলতে থাকে। এই সমস্যা সমাধানে বহুমাত্রিক প্রচেষ্টার প্রয়োজন আছে। সংঘের স্বয়ংসেবকরা সামাজিক স্তরে নিরন্তর সকলের সেবা ও ত্রাণকার্যে নিরত থেকে সমাজের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন শক্তির কাছে শাস্তির জন্য আবেদন করছে।
সমাজের স্থায়ী ঐক্য হয় আত্মীয়তা থেকে, স্বার্থপর চুক্তি থেকে নয়। আমাদের সমাজ অনেক বড়। খুব বৈচিত্র্যপূর্ণ, সময়ের সাথে সাথে, বিদেশ থেকেও কিছু আগ্রাসী ঐতিহ্য আমাদের দেশে প্রবেশ করে, তবুও আমাদের সমাজ এই তিনটি জিনিসের উপর ভিত্তি করে। একটি অনন্য সমাজ হিসাবে থেকে যায়। বর্তমান পরিবেশে সমাজে অনৈক্য ছড়ানোর চলমান প্রচেষ্টা দেখে স্বভাবতই অনেকেই চিন্তিত। নিজেদেরকে হিন্দু বলে এমন অনেক ভদ্রলোকও খুঁজে পাই, উপাসনা পদ্ধতি অনুযায়ী যাদের মুসলমান বা খ্রিস্টান বলা হয়, এমন লোকও পাওয়া যায়। তারা বিশ্বাস করেন যে, অবরোধ, বিবাদ ও বিদ্বেষ ত্যাগ করে মিলন, নিরাপত্তা ও শান্তির পথে চলাই সর্বোত্তম।
যারা সমাজে সম্প্রীতি চায় তাদের সবাইকে এই মারণ খেলার ছলনা থেকে বাঁচতে হবে। এসব সমস্যার সমাধান ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসবে। সেজন্য দেশে আস্থা ও সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি পূর্বশর্ত। নিজের মনকে স্থির রেখে আত্মবিশ্বাসী হয়ে পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে, পারস্পরিক বোঝাপড়া বাড়াতে হবে, পারস্পরিক বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হতে হবে এবং সবার মধ্যে সম্প্রীতি বৃদ্ধি পেতে হবে, এভাবেই মন, বচন ও কাজে চলতে হবে।
প্রচার বা অনুমান নিয়ে নয়, বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে কাজ করতে হবে। ধৈর্য, সংযম ও সহিষ্ণুতার সাথে, নিজের কথা ও কাজে উগ্রতা, ক্রোধ ও ভয় পরিহার করে, দৃঢ়তার সাথে, সংকল্পবদ্ধ হয়ে দীর্ঘ সময় ধরে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া অপরিহার্য। বিশুদ্ধ চিত্তে করা সৎ সংকল্প তখনই পূর্ণ হয়। প্রতিটি পরিস্থিতিতে যতই উসকানি থাকুক না কেন, আইন-শৃঙ্খলা, নাগরিক শৃঙ্খলা ও সংবিধান মেনে চলা বাধ্যতামূলক। একটি স্বাধীন দেশে এই আচরণকে দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মিডিয়াকে ব্যবহার করে করা উস্কানিমূলক অপপ্রচার এবং এর ফলে যে অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের প্রতিযোগিতা হয় তাতে ফেঁসে যাবেন না। সমাজে সত্য ও অন্তরঙ্গতা ছড়িয়ে দিতে মিডিয়াকে ব্যবহার করতে হবে। হিংসা এবং গুণ্ডামির সমাধান হলো সংগঠিত শক্তিসম্পন্ন সমাজের আইন- শৃঙ্খলা সুব্যবস্থা রক্ষায় উদ্যোগ নেওয়ার সাথে সরকার ও প্রশাসনকে যথাযথ সহায়তা দেওয়া।
২০২০ থেকে ২০২৩ সাল হলো সংঘের শতবর্ষ পূর্তির বছর। পূর্বোক্ত সমস্ত বিষয়ে ও দেশের প্রয়োজনে সংঘের স্বয়ংসেবকরা এগিয়ে যাবে, সে বিষয়ে তারা প্রস্তুতি নিয়ে চলেছে। সামাজিক আচার-আচরণ ও কথাবার্তায় দেশের প্রতি সমগ্র সমাজের আনুগত্যের অনুভূতি প্রকাশ পাক। মন্দির, জলাশয়, শ্মশ্মশানে প্রবেশে কোনো বৈষম্য থাকলে তার অবসান ঘটাতে হবে। পরিবারের সকল সদস্যের মধ্যে প্রতিদিন আলাপ আলোচনা, সংস্কারিত আচরণ এবং সংবেদনশীলতা অব্যাহত রাখা এবং সেসব গুণের বিকাশ অব্যাহত রাখা উচিত। এরকম আদর্শ পরিবারের দ্বারা সমাজের সেবা অব্যাহত রাখা উচিত।
অনর্থক ব্যয় বন্ধ করতে হবে। দেশের কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে এবং দেশের অর্থ দেশের মধ্যেই ব্যবহার করতে হবে। তাই স্বদেশীর আচার-আচরণও পরিবার থেকেই শুরু করা উচিত। আইন-শৃঙ্খলা ও নাগরিকত্বের নিয়ম মেনে চলতে হবে এবং সমাজের সর্বত্র পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সহযোগিতার পরিবেশ বিরাজ করতে হবে। এই পাঁচটি আচরণগত বিষয় বিকশিত হোক তা সবাই চায়। কিন্তু ছোটখাটো বিষয় থেকে শুরু করে সেগুলোর চর্চা করে, আমাদের প্রকৃতিতে এই আচরণ গ্রহণ করার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা প্রয়োজন। আগামী দিনে সংঘের স্বয়ংসেবকরা সমাজের অভাবী বন্ধুদের সেবা করার পাশাপাশি এই পাঁচ ধরনের সামাজিক উদ্যোগ চালিয়ে সমাজকে এতে অংশীদার এবং সহযোগী করার চেষ্টা করবে। সরকার, প্রশাসন এবং সমাজের সজ্জনশক্তি সমাজের স্বার্থে যা কিছু করছে বা করতে চাইছে, সংঘের স্বয়ংসেবকদের সেই কাজে সহযোগিতা নিয়ত পূর্ববৎ চলতে থাকবে। সমাজের ঐক্য, সতর্কতা ও সর্বক্ষেত্রে নি:স্বার্থ প্রয়াস, জনকল্যাণকারী সরকার ও জনমুখী প্রশাসন যখন নিজের স্ব-এর ভিত্তির উপর উত্থিত হয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা পূর্বক প্রচেষ্টা চালায়, তখনই রাষ্ট্র সমৃদ্ধ হয়। শক্তি ও গৌরবে পূর্ণ রাষ্ট্রের কাছে যখন আমাদের সনাতন সংস্কৃতির সবাইকে তার একই পরিবার অন্তর্ভুক্ত হিসাবে বিবেচনা করার মতো একটি সংস্কৃতি থাকে, যা অন্ধকার থেকে আলোতে, অসত্য থেকে সত্যের দিকে নিয়ে যায় এবং যা আমাদের নশ্বর জীবন থেকে সার্থকতার অমৃতময় জীবনের দিকে নিয়ে যায়, তখন সেই রাষ্ট্র, পৃথিবীর হারানো ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে এবং বিশ্বকে একটি সুখী ও শাস্তিপূর্ণ নতুন জীবনের বরদান প্রদান করে। বর্তমান সময়ে আমাদের অমর জাতির পুনরুজ্জীবনের / পুনরুত্থানের / নবজাগরণের উদ্দেশ্য এটাই। "ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারীরা জগৎগুরুর জ্ঞান সম্বল করে, এগিয়ে চললেই অরুণ প্রভাত আসবে, অভিষেকের সময় আসন্ন, প্রশ্ন অনেক হলেও উত্তর এক।" বিজয়া দশমীতে দেওয়া সরসংঘ চালকের ভাষণ