।। কর' অমৃতলোকপথ অনুসন্ধান ।।

অরিন্দম নাথ

বনদুয়ার অ্যাম্বুশের ঘটনা ঘটে ২২ শে নভেম্বর ১৯৯৯ তারিখে ৷ সকাল আটটার দিকে ৷ তখন দক্ষিণ জেলার এসপি ছিলেন অনুরাগ স্যার ৷ আগেরদিন ছিল রবিবার ৷ সন্ধ্যায় নিমন্ত্রণ ছিল স্যারের কোয়ার্টারে ৷ আমরা সপরিবারে আমন্ত্রিত ছিলাম ৷ রাত্রি দশটার পর ঘরে ফিরে আসি ৷ পরদিন সকালে চা খাওয়ার একটু পর এক্সারসাইজ করছিলাম ৷ ঠিক তখনই গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম ৷ বনদুয়ার আমার কোয়ার্টার থেকে খুব কাছেই ৷ দুই তিন কিলোমিটার দূরে ৷ পরক্ষণেই কন্ট্রোল থেকে ফোনে জানায় আমাদের ডিএআর পার্টির উপর বৈরীরা অ্যাম্বুশ করেছে ৷ দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুঁটে যাই ৷ ততক্ষণে বৈরীরা পালিয়ে গেছে ৷

উদয়পুর থেকে অমরপুরের দূরত্ব চব্বিশ কিলোমিটার ৷ মধ্যে মহারানী ৷ উদয়পুর থেকে আট নয় কিলোমিটার দূরে ৷ গোমতী নদীর অববাহিকা বরাবর একচিলতে সমতল ভূমি ৷ তারপর ওয়ারেনবাড়ি হয়ে গান্ধারী, থাকছড়ার মত বড়মুড়া পাহাড়ের জনপদ ৷ তখন মহারানী এবং অমরপুরের মধ্যে সিআরপিএফ জওয়ানরা যানবাহনের নিরাপত্তা প্রদান করত ৷ বনদুয়ার এবং মহারানীর মধ্যেও রয়েছে বেশকিছু টিলা ৷ কাজুবাদামের বাগান ৷ সর্পিল রাস্তা ৷ এলাকাটি বড়মুড়া পাহাড়েরই অংশবিশেষ ৷ বনদুয়ার হয়ে পাকদণ্ডী চলে গেছে গানথালং, ব্রহ্মছড়া, হয়ে গামাড়িয়া, তৈহরসং, কৃষ্ণভক্তপাড়া, মালসাধুপাড়া প্রভৃতি অঞ্চলে ৷ এখানে রাস্তার নিরাপত্তার জন্য কোন ডেডিকেটেড ফোর্স ছিল না ৷ বৈরীরা এর ফায়দা নেয় ৷ বেশ কয়েকটি ঘটনা করে ৷ ডাকাতি, অপহরণ এমনকি খুনও ৷ বাধ্য হয়ে আমরা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করি ৷ হাতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বাহিনী ছিল না ৷ অফিস থেকে কিছু পুলিশকর্মী ক্লোজ করা হয় ৷ সঙ্গে পুলিশ লাইন থেকে ডিএআর মিলিয়ে দশ বার জনের টিম ৷ সকালে যেত ৷ বিকেলে ফরত ৷ যেখান থেকে টিলার শুরু হয় তার আগে গাড়ি থেকে নেমে যেত ৷ তারপর পায়ে হেঁটে রাস্তার দুই পাশের তল্লাশি করত ৷ উপযুক্ত উঁচু জায়গা দেখে পজিশন নিয়ে বসত ৷ রাস্তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করত ৷ গাড়ি চলাচল শুরু হত ৷ প্রথম কয়েকদিন তারা খুবই সতর্কতার সঙ্গে করছিল ৷ তারপর নিচু পাহাড়ের অংশটা গাড়িতে চলাচল শুরু করল ৷ বৈরীরা সেই সুযোগ নিল ৷ বনদুয়ারের খুব কাছাকাছি কাজুবাদাম বাগানে বসে অ্যাম্বুশ পাতল ৷ রাস্তায় আইইডি লাগাল ৷ জওয়ানরা সেদিন একটি ওয়ান-টনার ট্রাকে করে যাচ্ছিল ৷ আইডি ফাটায় গাড়িটি উপরে উঠে তীব্র ঝাকুনি দিয়ে পড়ে ৷ সাথে সাথে বৈরীরা সয়ংক্রিয় হাতিয়ার থেকে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে ৷ গ্রেণেডও ফাঁটায় ৷ আমাদের স্টাফরা প্রতিরোধ গড়তে পারে না ৷ বৈরীরা হাতিয়ার এবং গোলাবার ছিনিয়ে নিয়ে যায় ৷ এই ঘটনায় মোট আটজন সহকর্মী মারা যান ৷ সম্ভবতঃ দুইজন আহত হয়েছিল । এরমধ্যে একজন ধ্রুব মজুমদার । শহীদরা ছিলেন প্রদীপ দেবনাথ, মোহাম্মদ হানিফ মিয়া, শংকর মালাকার, মানিকলাল দেবনাথ, শিবপ্রসাদ দাস, রূপমোহন জমাতিয়া, সুরেশচন্দ্র পাল এবং নারায়ণ মজুমদার ৷ “তব জাগ্রত নির্মল নূতন প্রাণ ত্যাগব্রতে নিক দীক্ষা, বিঘ্ন হতে নিক শিক্ষা-- নিষ্ঠুর সঙ্কট দিক সম্মান ৷”

তদন্তে জানতে পারলাম বৈরীদের নেতৃত্ব দিয়েছিল দেবাসিং রিয়াং ৷ বাড়ি ধলাই জেলার ধুমাছড়ায় ৷ বেশ কিছুদিন যাবত সেই বৈরীনেতা দক্ষিণ মহারানী অঞ্চলে তার দলসহ সক্রিয় ছিল ৷ অনেকগুলি ঘটনাও করেছিল ৷ আমরা আশানুরূপ সাফল্য পাচ্ছিলাম না ৷ দলের সদস্যদের মধ্যে একজন বাঙালি বৈরী সহযোগীও ছিল ৷ বাবুল মিঞা ৷ একসময় একটি ইটভাটায় কাজ করত ৷ তারপর বৈরী সহযোগী হিসেবে কাজ করতে শুরু করে ৷ তাকে আটক করলাম ৷ সে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার গেল না ৷ এর দুইমাস আগে উদয়পুর আঠারভোলা সড়কের মনিথাং এলাকায় এই বৈরী দলটি আসাম রাইফেলসের উপর অ্যাম্বুশ করেছিল ৷ পাঁচজন জওয়ান মারা গিয়েছিল ৷ তারপর থেকে আসাম রাইফেলসও তেতেছিল ৷ এই গ্রুপের বিরুদ্ধে প্রথম সাফল্য আসে অমরপুরের কুর্মায় ৷ আইপিএস প্রোবেশনার রাজেশ কাম্বলে আসাম রাইফেলসের সঙ্গে অভিযানে গিয়েছিল ৷ তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে বৈরী বীরানন্দ জমাতিয়া মারা যায় ৷ একটি সয়ংক্রিয় হাতিয়ার উদ্ধার হয় ৷ ডিস্ট্রিক্ট টাস্ক ফোর্স বা ডিটিএফের সঙ্গে সংঘর্ষে আরও তিনজন বৈরী মারা যায় ৷ গব্বর জমাতিয়া গামারিয়া এলাকায় ৷ একজন গান্থালং এলাকায় ৷ একজন কিল্লার চালিতাবাড়িতে ৮ই নভেম্বর ২০০০ তারিখে ৷ একটি কার্বাইন উদ্ধার হয় ৷ আরও দুইজন বৈরী মারা যায় কিল্লার মৈথুলং গ্রামে ৷ বিএসএফের সঙ্গে সংঘর্ষে ৷ একটি একে-৪৭ উদ্ধার হয় ৷

কিন্তু দেবাসিংকে আটক করতে পারি না ৷ সে হঠাৎ কর্পূরের মত মিলিয়ে যায় ৷ মহারানী এলাকার একটি জমাতিয়া মেয়ের সঙ্গে সে প্রেম করত ৷ মেয়েটি একজন এডিসির জনপ্রতিনিধির ভাতিজি ৷ তার উপর নজর রেখেও কোন ক্লু পেলাম না ৷ এবার খবর এল বৈরীদের নেতৃত্বে এসেছে দীননাথ মলসম ওরফে লাদেন ৷ ইতিমধ্যে দক্ষিণ জেলার জমাতিয়া অধ্যুষিত এলাকায় বৈরীরা সমস্যায় পড়ল ৷ জমাতিয়ারা তাদের ধর্মগুরু হদাঅক্রা অশ্বত্থামা জমাতিয়ার নেতৃত্বে উগ্রাপন্থীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে ৷ এই প্রতিরোধের সামনে উদয়পুর মহকুমার অধিকাংশ জমাতিয়া সম্প্রদায়ের বৈরী আত্মসমর্পণ করে ৷

এদের মধ্যে একজন ছিল কিল্লার নিত্যবাজারের মেঘনাদ জমাতিয়া ৷ তাকে একদিন অফিসে ডাকালাম ৷ অনেক খবর দিল ৷ সবচাইতে বড় খবর দেবসিং রিয়াং সম্পর্কে ৷ দেবসিং অমরপুর জেলে ভিন্ন নামে বন্দী আছে ৷ তাকে কিছুদিন আগে গণ্ডাছড়ার জগবন্ধুপাড়া থেকে সিআরপিএফরা আটক করেছিল ৷ একদিন বিকালে আরওপি ক্লোজ হওয়ার সময় সে একজন উপজাতি শিক্ষকের মোটর সাইকেলে ড্রাইভ করছিল ৷ বাইকের মালিকের আপত্তি ছিল ৷ কোন সূত্র মারফত সিআরপিএফ জানতে পারে ছেলেটি বৈরী ৷ তাকে আটক করে থানার কাছে হস্তান্তর করে ৷ ঐদিন রাতেই সেই শিক্ষক অপহৃত হন ৷ পরে বৈরীরা তাকে খুন করে ৷ গণ্ডাছাড়া ধলাই জেলাতে হলেও তখন মামলার বিচার হত অমরপুর কোর্টে ৷

খবর নিয়ে দেবসিং এর নতুন নাম জানলাম ৷ সে তখনও জেলেই ছিল ৷ আমরা কোর্টে তাকে বনদুয়ার অ্যাম্বুশ মামলায় আটক দেখিয়ে পুলিশ হেফাজত চাইলাম ৷ আবেদন মঞ্জুর হলে তদন্তকারী অফিসারের সঙ্গে আমিও অমরপুর গেলাম ৷ নিয়ে আসার সময় গাড়িতে সে অসুস্থতার ভান করল ৷ তখন মহারানী হাসপাতালে তাকে নিয়ে গেলাম ৷ সেখানে একজন উপজাতি সম্প্রদায়ের ডাক্তার কর্তব্যরত ছিলেন ৷ ঘটনাক্রমে তিনি ছিলেন এক বৈরীনেতার সহোদর ভাই ৷ আমাদের মনে ভয় ছিল, যদি ডাক্তারবাবু বলেন তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে ৷ অবশ্য সেইরকম কোন বিধান দিলেন না ৷ বিশেষ কোন রোগ পাননি ৷ একটু বিরতির পর আমরা চলতে শুরু করি ৷ তাকে রাধাকিশোরপুর থানার হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করি ৷ ছেলেটির বয়স বিশের কোঠায় ৷ আট ভাইয়ের সবার ছোট ৷ মাথায় কোঁকড়ানো চুল ৷ অদ্ভুত মায়াবী দৃষ্টি ৷ তাকে নৃশংস উগ্রবাদী বলে মানতে মন চাইছিল না ৷ মনে হচ্ছিল, আমি যেন একজন শিল্পীর সামনে বসে আছি ৷ অচিরেই হোঁচট খেলাম ৷ সে বলল যে এনএলএফটি দলের হয়ে কসম খেয়েছে কিছু বলবে না ৷ আমাদের সব চেষ্টা মাঠে মারা গেল ৷

এবার আমরা পদ্ধতি পাল্টালাম ৷ বাছাইকরা লোক নিয়ে তিনটি টিম গড়লাম ৷ তাকে ঘুমাতে না দিয়ে প্রশ্ন করে যাবে ৷ এককেকটি টিম আট ঘন্টা করে ৷ সে যা বলবে লিখে যাবে ৷ তৃতীয়দিন সন্ধ্যার পর তার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল ৷ তখন এসআই ইন্দ্রজিৎ সিনহার নেতৃত্বে একটি দল জিজ্ঞাসাবাদ করছিল ৷ দুইটি অ্যাম্বুশ এবং আরও কয়েকটি ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার যায় ৷ ঘটনায় তার সঙ্গে কে কে ছিল সব বলল ৷ মনে হল, কোনরকম ছলচাতীরি করেনি ৷ কিছু নাম আগেই জানা গিয়েছিল ৷ কিছু নতুন যুক্ত হয় ৷ বাঙালি লোকটিও বনদুয়ারের ঘটনায় ছিল ৷ সে জামিনে ছিল ৷ দেবসিং আটকের খবর পেয়েই আত্মগোপন করেছিল ৷ দেবাসিং জানায় যে সে তার বৈরীদল থেকে অবসর নিয়েছে ৷ জমাতিয়া মেয়েটিকে বিয়ে করে ঘর বাঁধবে ৷ পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি আদালতে গ্রাহ্য হয় না ৷ টাডা বা Terrorist and Disruptive Activities (Prevention) Act আইন ত্রিপুরায় লাগু ছিল না ৷ এই আইনে এসপি অথবা তাঁর উপরের কোন অফিসারের কাছে দেওয়া জবানবন্দী আদালত গ্রাহ্য হয় ৷ টাডা আইন থাকলে হয়তো এই দলের লোকদের সাজা নিশ্চিত করা যেত ৷ আমরা তাকে বছর দুয়েক তাকে আটক রাখতে পেরেছিলাম ৷ এরমধ্যে বছর খানেক নাসা বা National Security Actএ ৷ তারপর জামিন পেয়ে একটি বৈরী গোষ্ঠির সঙ্গে আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে ৷

এর বেশ কয়েক বছর পরের কথা ৷ আমি তখন অন্য দায়িত্বে ৷ একদিন বিকেলে উদয়পুর থেকে জম্পুইজলা হয়ে আগরতলায় ফিরছি ৷ রাস্তায় দেবাসিং রিয়াংয়ের সঙ্গে দেখা ৷ সে একটি টিভিএস বাইকে খুমলুঙের দিক থেকে আসছিল ৷ পেছনে তার বৌ ৷ সেই জমাতিয়া মেয়েটি ৷ কোলে বাচ্চা ৷ মেয়েটিকে আগেও দেখেছি ৷ কোর্টে দেবসিংয়ের সঙ্গে দেখা করতে আসত ৷ তখন তারা বৃদ্ধিবাজারে থাকে ৷ সে রেশনসপ চালায় ৷

কাকতালীয় ঘটনা ৷ এর ব্যাখ্যা আমার নেই ৷ তরুণ চক্রবর্তী একজন সাংবাদিক ৷ এখন কলকাতায় থাকেন ৷ তখন তিনি ইটিভির সাংবাদিক ছিলেন ৷ ডিএসপি সেন্ট্রাল হিসেবে আগরতলায় থাকার সময় পরিচয় ৷ তারপর প্রমোশন পেয়ে উদয়পুরে বদলি হয়ে গেলাম ৷ দেখা সাক্ষাত কমে গেল ৷ ঘটনাচক্রে মনিথাং এবং বনদুয়ারে অ্যাম্বুশের ঘটনার আগের দিন তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল ৷ কুশল বিনিময় হয়েছিল ৷ পরে হীরাপুরে অ্যাম্বুশের সময় যখন এর পুনরাবৃত্তি হল আমি ভয় পেয়ে গেলাম ৷ তাঁকে বলে কয়েই দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ করলাম ৷ পরবর্তীতে পুলিশ সদরে বদলি হয়ে এলাম ৷ তিনি তখন অন্য মিডিয়া হাউসে ৷ আবার নিয়মিত দেখাসাক্ষাৎ হতে লাগল ৷ কোন অঘটন ছাড়াই ৷


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.