বিতর্ক সভায় সংখ্যা গরিষ্ট মানুষের অভিমত, বেঁচে থাকার অধিকার থাকলে ইচ্ছা মৃত্যুর অধিকারও থাকুক
শুভঙ্কর চক্রবর্তী
গত ১৪ ই অক্টোবর মহালয়ার পিতৃপক্ষের শেষ দেবী পক্ষের সূচনা দিন ছিল। এই বিশেষ দিনটিতে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বী দল, ভারত পাকিস্তানের ম্যাচও ছিল। এমনিতেই উৎসবের মহল, তার উপর ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারত খেলবে চির প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। তাই দর্শক আসবে কিনা এই আশঙ্কাকে বিফল প্রমাণিত করে রাজধানীর রবীন্দ্রভবনের ২নং হলে, দিলীপ সরকার মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের আয়োজনে, 'নিস্কৃতিমৃত্যু আইন সম্মত হওয়া উচিত ' শীর্ষক বিতর্ক সভায় উল্লেখযোগ্য ভাবে দর্শকের উপস্থিতি প্রমাণ করলো, চিন্তা ও মননের জগতে পিছিয়ে নেই ত্রিপুরা। রাজধানী ছাড়াও রাজ্যের বিভিন্ন অংশের মানুষের উপস্থিতি তারই স্বাক্ষর বহন করে।
এডভোকেট দিলীপ সরকার ছিলেন গুয়াহাটি ও ত্রিপুরা বারের ফৌজদারী আইন বিষয়ক একজন বিশিষ্ট আইনজীবী। গুয়াহাটি হাইকোর্ট (আগরতলা বেঞ্চ) এবং ত্রিপুরা হাইকোর্টের পাবলিক প্রসিকিউটর। রাজ্যের বহু জটিল মামলা পরিচালনা করার জন্য তাকে বিশেষ ভাবে পাবলিক প্রসিকিউটর হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছিলো। আইনী ক্ষেত্রে তার অসাধারণ যৌক্তিক চিন্তাভাবনাকে সাধারণ মানুষ তথা নবপ্রজন্মের আইনজীবীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার লক্ষ্যে দিলীপ সরকার মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের তরফে ২০২২ সাল থেকে বিতর্কসভার আয়োজন করা হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সাধারণ মানুষের যৌক্তিক চিন্তাভাবনার বিকাশ এবং নবপ্রজন্মের প্রতিনিধিদের মাঝে মেধা বিষয়ক কার্যকলাপের প্রচার ও প্রসার।
জাতীয় সঙ্গীতের পরে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রফেসর ডা: মানিক সাহা'র হাত ধরে মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্বলনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হয়। তার আগে মঞ্চাসীন বিশিষ্ট অতিথি বর্গকে পুষ্পস্তবক এবং উত্তরীয় পরিয়ে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা: কুনাল সরকার, হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি স্বপন চন্দ্র দাস এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক শেখর দত্ত প্রমুখ মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন।
প্রয়াত দিলীপ সরকারের পত্নী মঞ্জু সরকার, এই আয়োজনে উপস্থিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সহ উপস্থিত বিশিষ্ট জনেদের ধন্যবাদ জানান। প্রবীন সাংবাদিক শেখর দত্ত রাজ্যে আলোর দিশারী ও শুভচিন্তার ভগীরথ আখ্যা দিয়ে তার উপস্থিতির জন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেছেন এইধরনের অনুষ্ঠান থেকে রাজ্যের নব প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে যৌক্তিক চিন্তা ভাবনা বিকশিত হবে। তাই প্রতি বছর এই ধরনের অনুষ্ঠান করার জন্য উদ্যোক্তাদের প্রতি অনুরোধ রাখেন। রাজ্যের পুলিশ একাউন্টেবিলিটি কমিশন এবং মানবাধিকার কমিশনের সভাপতি তথা ত্রিপুরা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি এস.সি.দাস প্রয়াত আইনজীবী দিলীপ সরকারের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে ফৌজদারি মামলায় দিকপাল আইনজীবী দিলীপ সরকারের পেশাগত ও তার জীবনশৈলীর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কিছু অজানা বিষয়ের উপর আলোকপাত করেছেন।
মুখ্যমন্ত্রী প্রফেসর ডা: মানিক সাহা তার নাতিদীর্ঘ ভাষণে আলোচনার শীর্ষক নিয়ে অনুসন্ধিৎসা ব্যক্ত করেন। প্রয়াত দিলীপ সরকারের প্রতি যথাযথ সম্মান জানিয়ে তিনি সভার আলোচনা পর্ব শোনার আশা ব্যক্ত করেন। এবং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এবং এই ধরনের অনুষ্ঠান আরও বেশী করে আয়োজন করার উপর গুরুত্ব দেন। বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা: কুনাল সরকার মুখ্যমন্ত্রীর ভূয়সী প্রশংসা করেন। বিতর্কসভার আলোচনা শুরুর আগেই হলে ঢুকে মুখ্যমন্ত্রী ডক্টর কুনাল সরকারকে বলেন 'আজ আমি শুনতে এসেছি'। মুখ্যমন্ত্রীর এই শুনতে চাওয়ার ইচ্ছাকে তুমুল প্রশংসা করে বলেন, সাধারণত রাজনৈতিক নেতারা নিজেরা বেশি বলতে চান। এক্ষেত্রে ডক্টর মানিক সাহার 'আমি শুনতে এসেছি' উক্তির প্রেক্ষিতে বলেছেন 'ডক্টর মানিক সাহা অবশ্যই এক ব্যতিক্রমী রাজনীতিবিদ'। ডক্টর কুনাল সরকার আরও মন্তব্য করেন অবাধ কথা বলার সুযোগ থাকা ও বিতর্ক করার প্রবনতা বুঝিয়ে সমাজ কেমন আছে। এক্ষেত্রে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ভারত পাকিস্তানের খেলার মধ্যেও বিতর্ক অনুষ্ঠানে বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতিকে ত্রিপুরার মানুষের মধ্যে যে মত প্রকাশের ভিন্ন ধারার অনুভূতি কাজ করে তার উত্তম লক্ষন আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রথম পর্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে শুরু হয় বহু আকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক সভার। বিতর্কে প্রস্তাবের পক্ষে ডা:রণবীর রায়, অরিন্দম ভট্টাচার্য, রুমেলা গুহ এবং চন্দ্রিল ভট্টাচার্য অংশ নেন। বিপক্ষে ছিলেন ড: সুমন্ত চক্রবর্তী, শুভ্রজিৎ ভট্টাচার্য, জয়ন্ত দুবে এবং স্বাতী ভট্টাচার্য। আলোচনা শুরুর আগে ইউথানেসিয়া নিয়ে মহিলা কলেজের অধ্যাপিকা তাপসী ভট্টাচার্যের প্রকাশিত একটি বইয়ের উল্লেখ করে তাকে পুষ্পস্তবক এবং উত্তরীয় প্রদান করে সম্মান জানানো হয়। এবার বিতর্কের শুরুতে ডা: কুনাল সরকার বলেন তিন হাজার বছর আগে সক্রেটিসকে হেমলক বিষ পান করায় উৎসাহ যুগিয়ে তাকে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করে নিতে বাধ্য করা হয়েছিলো।
প্রস্তাবের স্বপক্ষে ডা: রণবীর রায় বলেন বাঁচার তীব্র লড়াই চালিয়েও ব্যথা, বেদনা ও কষ্টের তীব্রতার মধ্যে যখন কোনও মানুষ চিকিৎসার আর কোনও নিদান পান না, চিকিৎসকেরা যখন জানিয়ে দেন রুগীর বেঁচে থাকার আশা অস্তমিত, তখন ভেজীটেটিভ স্টেজে থাকা সেই রুগীর কাছে নিষ্কৃতি মৃত্যুর আইনী কবচ থাকা জরুরী। এই প্রসঙ্গে তিনি অরুণা শেহবাগের মামলার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন ১৯৭৩ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ভেজিটেটিভ স্টেজে থাকা অরুণার বান্ধবী সুপ্রিম কোর্টের কাছে ইচ্ছা মৃত্যুর অবেদন করেন। শীর্ষ আদালত অবশ্য ইচ্ছা মৃত্যু বা ইউথানেসিয়ার পক্ষে কোনও রায় না দিলেও, সরকার কে এই বিষয় টি ভাবার এবং আইন প্রনয়নের পরামর্শ দেয়। তার মতে রাইট টু লিভের পাশাপাশি রাইট টু ডেথ এর ও আইনী স্বীকৃতি থাকা প্রয়োজন।
প্রস্তাবের বিপক্ষে ড: সুমন্ত চক্রবর্তী আবেগ প্রবন ভাবে তার বাবাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে বলেন, স্বল্প সংখ্যক দেশের উদাহরণ দিয়ে আমরা সাতশো কোটি মানুষের নিষ্কৃতি মৃত্যু চাইতে পারিনা। তিনি পরিসংখ্যান দিয়ে বলেন, ১৯৪৭ সালে ভারতে গড় আয়ু ছিলো ৩২ বছর। আজকে সেই সংখ্যা দাড়িয়েছে ৭২। মার্ক জাকারবার্গ এবং এলন মাস্কের উদাহরণ দিয়ে সুমন্ত বলেন, আগামী শতাব্দীতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর সাহায্যে মানুষের মৃত্যু বিলম্বিত করার গবেষণা চলছে। পরম্পরা ও মূল্যবোধে সমৃদ্ধ ভারতবর্ষে নিস্কৃতি মৃত্যু মেনে নেওয়া যায়না। রণবীর রায়ের দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের নিস্কৃতি মৃত্যুর দাবীকে তিনি উপহাস করেন।
প্রস্তাবের স্বপক্ষে আইনজীবী অরিন্দম ভট্টাচার্য বলেন, কোয়ালিটি অফ লাইফ বিচার না করে স্প্যান অফ লাইফ নিয়ে মাতামাতি করা ঠিক হবেনা। জীবন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে এক অসহনীয় অবস্থায় থাকা মানুষের জন্যই নিস্কৃতি মৃত্যুর মতো শব্দ বন্ধের উৎপত্তি।
প্রস্তাবের বিপক্ষে পরবর্তী বক্তা সাংবাদিক শুভ্রজিৎ ভট্টাচার্য বলেন, কোভিডের সময় মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের চিকিৎসা পরিষেবা দিয়ে গেছেন। জীবনকে বাঁচানোর জন্য ভারতে ১৬০০ চিকিৎসক ও অসংখ্য স্বাস্থ্যকর্মী প্রাণ দিয়েছেন। তিনি নীতি নির্ধারকদের মেন্টাল হেলথ কেয়ার এক্ট বানানোর জন্য যত্নবান হবার আহ্বান রাখেন।
প্রস্তাবের পক্ষে রুমেলা গুহ, নিস্কৃতি মৃত্যুর সাথে আত্মহত্যা বা হত্যার স্পষ্ট পার্থক্যের উল্লেখ করেন। তার মতে মৃত্যু অমোঘ। সেখানে টার্মিনালি ইল পেশেন্টদের যেখানে প্রযুক্তি এবং করুণার ছত্রছায়ায় বেঁচে থাকতে হয়, সেখানে রাইট টু লাইফের সাথে সাথে রাইট টু ডেথের আইনী কবচ থাকা অত্যন্ত জরুরী।
প্রস্তাবের বিপক্ষে তরুন আইপিএস জয়ন্ত দুবে জানান, এক্টিভ এবং প্যাসিভ ইউথেনসিয়া নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, তার মাঝেই কিন্তু প্যাসিভ ইউথেন্সিয়া চিকিৎসা ব্যবস্থায় কার্যকর হয়ে চলেছে। অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্ট নিয়ে তার তোলা প্রশ্নের জবাবে ডা: কুনাল সরকার জানান, ইতিমধ্যেই আইনী পথে সারা দেশে অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্ট হচ্ছে। সারা দেশে ১১০০ রুগীর হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট অত্যন্ত সুচারুভাবে ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে।
এবার প্রস্তাবের পক্ষে বলতে ওঠেন চন্দ্রিল ভট্টাচার্য। তিনি প্রথমেই রবি ঠাকুর কবিতার উল্লেখ করে বলেন, কবিই লিখে গেছেন, মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম স মান। ডাক্তার যাকে জবাব দিয়ে দিয়েছে, সেই আতুর মানুষটি যিনি দগ্ধে দগ্ধে বেঁচে রয়েছেন, সেই মানুষটির মর্যাদাময় জীবন না থাকলে তার কাছে মৃত্যুই কাম্য। পরোক্ষ নিস্কৃতি মৃত্যু যেখানে বাস্তব, সেখানে প্রত্যক্ষ নিস্কৃতি মৃত্যুর আইনী কবচ না থাকা যেন জীবনের সঙ্গা নিয়ে প্রগলভতা করা। অপপ্রয়োগের আশঙ্কা করে আইন প্রনয়ন না করাটা যেন ভাবের ঘরে চুরি করার মতো। হিটলারের ইহুদীবিদ্বেষ সংক্রান্ত জেনোসাইডকে নিস্কৃতি মৃত্যুর আখ্যা দেওয়া কে তিনি সত্যের অপলাপ আখ্যা দিয়ে বলেন, রাষ্ট্রের হাতে জেনোসাইডের প্রয়োগ রুখতে হলে, গনতন্ত্রের শক্তিশালী হওয়া দরকারী।
প্রস্তাবের বিপক্ষে সর্বশেষ বক্তা আনন্দ বাজার পত্রিকার সাংবাদিক স্বাতী ভট্টাচার্য, যন্ত্রণাময় হলেও জীবনের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বেঁচে থাকার অধিকারকেই স্বীকৃত রাখার দাবী জানান। তিনি উপহাসের সুরে বলেন, বেঁচে থাকার উপযুক্ত ব্যবস্থা না করে, নিস্কৃতি মৃত্যু চাওয়ার দাবীকে অযৌক্তিক আখ্যা দেন। বিতর্কের শেষে ডা: কুনাল সরকার দুই পক্ষের বক্তাদের নিজ নিজ মতের সমর্থন কে জোরালো আবেদন রাখার সুযোগ দেন । প্রস্তাবের বিপক্ষের বক্তারা আবেগ দিয়ে উপস্থিত শ্রোতাদের উদ্বুদ্ধ করতে চান। সেখানে প্রস্তাবের পক্ষে চন্দ্রিল সহ অন্যান্য বক্তারা যুক্তি দিয়ে তাদের মত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালান। সভার শেষে ভোটাভুটিতে প্রস্তাবের বিপক্ষে ৩১ টি এবং প্রস্তাবের পক্ষে তিন শতাধিক মানুষ তাদের মতামত জানান। অত্যন্ত সুচারুভাবে এই বিতর্ক সভা সম্পাদনের জন্য প্রয়াত দিলীপ সরকারের কনিষ্ট পুত্র সবাইকে ধন্যবাদ জানান।