অভিনব উপহার নিয়ে তিন বন্ধু।

নন্দিতা দত্ত

চারদিকে যখন বস্ত্রদান,নানা সামগ্রী দান নিয়ে ফটোশেসন,অভিনব ভাবনায় তিন বন্ধু দান নয় উপহার দিতে এগিয়ে এলেন। প্রতিদিনের প্রয়োজনে যা প্রয়োজনীয় তা নজর এড়িয়ে যায় অনেকের। কিন্তু যা অভিনব তাই ভাবে নবযৌবনের দূত রা।তাই তাদের অদ্ভূত ও বলে অনেকেই। কিন্তু ওরা যে কতটা গভীরে গিয়ে ভাবে,তাতে কতটা আন্তরিকতা থাকে তা বোঝা যায় তাদের কাজে।তাদের সাহসিকতায়,সত্তায়,মানবিকতায়।নিজের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা অন্যের জীবনেও ঘটতে পারে,তাই সতর্ক থাকা দরকার,সতর্ক ওরাই করতে পারে।

"এই তোর পায়ে কি হয়েছে রে? এমন করে হাঁটছিস কেন?সুষমাকে মামা প্রশ্নটা করলে সুষমা এড়িয়ে যায়। নাছোড়বান্দা মামি কারণ টা উদ্ধার করে জানতে পারে - "জানো মাত্র পঞ্চাশ টাকায় দারুণ জুতো জোড়া দেখে লোভ সামলাতে পারিনি।কিনে পরার কয়েকঘণ্টার মধ্যে পায়ে ফোষ্কা শুধু নয়,ব্যাথাও"। তারপর ডাক্তার ওষুধে মাসখানেক পরে পা সুস্থ হয়। সুষমার কথায়, আমাদের বাড়িতে মুড়ি বিক্রি করতে আসতেন কাকু। একদিন দেখলাম উনার পায়ের গোড়ালিতে ক্ষত।কালো প্লাস্টিকের চটিটা পরে হাঁটতেন কষ্ট করে। কয়েকমাস পর থেকে উনার গোড়ালি থেকে একটু একটু করে কেটে ফেলতে হচ্ছে।উনি এখন আসেন না।উনার ছেলের কাছ থেকে জানা পায়ের চটিটা থেকে এমন হয়েছে। কদিন পরে হয়তো আবারো অপারেশন করে আরেকটু পায়ের পাতার অংশ কেটে ফেলতে হবে।

দুটো ঘটনা একটা টার্ণিং পয়েন্ট আমার কাছে।" বলছিল সুষমা চক্রবর্তী। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী। চলার পথে অনেকের পায়ের দিকে নজর যায় তার।বিশেষ করে রিক্সা চালায় যারা।যাদের অধিকাংশের পায়ে প্লাস্টিকের চটি দেখলেই মুড়ি কাকুর পায়ের কথা মনে হয়।

বন্ধু ভবানী আর শুভজিৎ কে একদিন বলে,আমি একটা বিষয় ভাবছি।পূজায় অনেকেই রিক্সা চালায় যারা , তাদের জামা কাপড় দেয়।তাদের যে পা দিয়ে এত পরিশ্রম সে পা সুরক্ষিত থাকুক এটা অনেকেই জানেন না বা ভাবেন না। অনেকেই প্লাস্টিকের চটি পরেন। কিন্তু প্লাস্টিকের চটি গরমে খুব সাধারণ ভাবে চোখে না পড়ার মত গলে পায়ের দীর্ঘ স্হায়ী বা চিরকালের জন্য ক্ষতি করতে পারে।যেটা মুড়ি কাকুর হয়েছে।তাদের জন্য কিছু করতে মন চাইছে।তিন বন্ধুর আলোচনা চলতে লাগলো কিভাবে কিছু চটি রিক্সাচালক দের দেওয়া যায়।তিনজনই পড়াশোনা করে।এই কাজটা করতে গেলে কয়েক হাজার টাকা লাগবে। কিভাবে সম্ভব? প্ল্যান করে সোস‌্যল মিডিয়ায় লিখলো সুষমা। আপনি মাত্র কুড়ি টাকা দিয়ে আমাদের ইচ্ছাপূরণে সাথে থাকতে পারেন। লেখার উদ্দেশ্য ওরা নিজেরা যতটা পারবে দেবে,বাকি যদি কেউ তাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসেন তাহলে জুতোর সংখ্যা একটু বাড়াতে পারবে।কুড়ি টাকা থেকে শুরু করে অনেকেই আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, তোমাদের মহৎ উদ্দেশ্যে আমিও কিছু দিচ্ছি।দুতিনদিনের মধ্যে তাদের লক্ষ্যপূরণ হলে তারা আবার পোষ্ট লিখলো আমরা আবেদন করছি, আপাতত আপনারা কেউ আর টাকা পাঠাবেন না। ১৫-৭৮০ টাকা উঠার পর বাকিটা তাদের দুতিনজন অভিভাবক সহ তারা নিজেরা দিয়ে ১৩৬ জোড়া জুতা কিনলো।যাতে ব্যয় হয়েছে ২১ হাজারেরও বেশি টাকা।প্যাকিংয়ের সাথে চার জোড়া ফ্রি।

তাদের একটাই শর্ত ছিল ব্র্যান্ডেড জুতো কিনবে। খোঁজ খবর নিয়ে সুমিত ফুটওয়ারে যোগাযোগ করলো ওরা।ওদের আন্তরিক ও অভিনব উদ্যোগের কথা শুনে মূল দাম থেকে একটা বেশ খানিকটা ছাড় দিলো সুমিত ফুটওয়ার।

শুক্রবার সকালে স্নান সেরে মন্দির রে প্রণাম করে বেরিয়ে পড়লো তিন বন্ধু।ঘুরে ঘুরে তো চটির প্যাকেট নিয়ে দেওয়া যাবেনা।কথা বলতে বলতে কদমতলায় চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়াতেই মনে হলো এই জায়গাটা ভালো।চায়ের দোকানের মালিককে বলতেই তিনিও উৎসাহ নিয়ে বললেন, এখানে ছায়া আছে।অনেক রিক্সা চালকও থাকেন। এখানেই ওরা বিতরণের কাজ করতে পারে।চায়ের দোকানের কাকুর সাথে আসেপাশের দোকানের অনেকেই সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেন।একজন প্রশ্ন করলেন চটি কে পেল কে পেলনা এটা কিভাবে বুঝবেন? তিনে কিউব ওরা তিনবন্ধু।তাই প্রতি সংখ্যার পাশে কিউব লিখে ১৩৬ জন রিক্সাচালক কে তাদের পায়ের মাপমতো চটি দেওয়া হলো।৬/৭/৮/৯-চারটি নম্বরের চটি বাছাই করে পায়ের মাপে একেক জন চটিতে পা গলালেন।মাপমতো না হলে ঐ রিক্সা চালক বাড়ি গিয়ে হয়তো ছেলেকে বা কোন আত্মীয়কে দিয়ে দেবেন।তাতে তাদের উদ্দেশ্য সাধন হবেনা।

শুভজিৎ হিসাব রাখলো ভবানী মার্কার দিয়ে রিক্সায় নম্বর দিল, সুষমা চটি এগিয়ে দিল।লাইন ঠিক রেখে সুশৃঙ্খল ভাবে কাজটি করতে সহায়তা করলেন,স্হানীয় দোকানের লোকেরা।বাকি চারজোড়া চটি তারা দিল ঐখানে বসে যারা সব্জি বিক্রি করেন এমন চারজনকে।

রিক্সা চালক দের চটি উপহার দেবার কথা শুনে অনেকেই যেমন মহৎ কাজ বলে উৎসাহ দিয়েছেন,বিরূপ মন্তব্য করে তাদের নিরুৎসাহিত করেছেনও অনেকেই। কিন্তু তারা তাদের সিদ্ধান্তে অনঢ় থেকে দান নয় উপহার দিয়েছেন। সুষমার কথায়, আমাদের উদ্দেশ্য দান নয় যার যেটা নেই তাকে তা দেওয়া। আমার নিজের পাঁচটা থেকে কাউকে একটা দিয়ে দিলে আমার কিছু কমবে না বরং তার একটা সুন্দর দিন কাটবে। আমাদের এটা একটা বড় প্রাপ্তি। চারে যদি ভাল থাকা যায় তাহলে পাঁচ নম্বরটা আমরা অন্যকেই দেব। এটাই আমাদের উদ্দেশ্য। আর চটি কেন সেটা তো বড় গল্প আপাতত বলি যারা নিজের জন্য কখনো এতোটুকু ভাবেন না ভাবলেও তাদের প্রয়োজনটা সব সময় অবহেলার চোখে দেখেন ।অন্তত না পারতে এক জোড়া চটি কখনো নেবেন না নিজের জন্য। এটা আমাদের মনে হয়েছে আমরা যা করে নিলাম যা আমাদের পক্ষে সম্ভব। যদিও এটা খুবই সামান্য একটা প্রতীকি। তবে এই উদ্যোগ একদিন বৃহতে মিশবে মিশবেই, আমরা সেটা করবো।

পথ চলতি মানুষ,স্থানীয়রা এমন অভিনব উদ্যোগকে কুর্ণিশ জানিয়েছে,আর এই তিন বন্ধু তাদের এই উদ্যোগে যাদের পাশে পেয়েছেন তাদের কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।

এ প্রজন্মের দিকে আত্মকেন্দ্রিকতার অভিযোগ ওঠে, আবার এই প্রজন্মই অভিনব কিছু করার সাহস দেখায়,যা আপাতদৃষ্টিতে আমাদের চোখে পড়েনা।

তারা কোন রিক্সা চালকের ছবি তোলেনি,বা প্রচার মাধ্যমকে ঘটা করে জানাতে চায়নি। কিন্তু অভিনব উদ্যোগ কে সাধুবাদ জানাতেই হয় ভবিষ্যতে দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.