শৈবতীর্থ ঊনকোটি,ভুবন ও চন্দ্রনাথ
পান্নালাল রায়
ত্রিপুরার ঊনকোটি,কাছাড়ের ভুবন এবং চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ পাহাড় শৈবতীর্থ।এইসব তীর্থভূমি থেকে এটা অনুমান করতে অসুবিধা হয়না যে একদা ত্রিপুরা সহ সন্নিহিত অঞ্চলে শৈবদের প্রবল প্রভাব ছিল।তবে শৈবতীর্থ হলেও সংশ্লিষ্ট পীঠভূমিতে শক্তি দেবীও রয়েছেন। ঊনকোটিতে যেমন রয়েছে দেবী দুর্গার বিগ্রহ,তেমনই একান্ন শক্তিপীঠের এক পীঠ চন্দ্রনাথে রয়েছে ভবানী মন্দির।শিবরাত্রিতে মেলায় মুখর হয়ে উঠে ভুবন আর চন্দ্রনাথ।
ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের একটি উল্লেখযোগ্য পর্যটন ক্ষেত্র হচ্ছে ঊনকোটি। এখানে পাহাড়ে ছড়িয়ে আছে পাথরের বিগ্ৰহ, আছে পাহাড়ের গায়ে পাথরে খোদাই দেবদেবীর মূর্তি। এছাড়া এক আরণ্যক পরিবেশ,ঝর্ণা,পবিত্র সীতাকুণ্ড আর পাখির কলতান ঊনকোটিকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে। কিন্তু সমৃদ্ধির নানা উপকরণ থাকলেও ঊনকোটির বিকাশে তেমন কার্যকরী উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। এবার ত্রিপুরার শৈবতীর্থ ঊনকোটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সম্ভাব্য তালিকায় স্হান পাওয়ায় এক্ষেত্রে এক আশার আলো দেখা দিয়েছে। এবছর ত্রিপুরার ঊনকোটি সহ ভারতের তিনটি স্হান ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সম্ভাব্য তালিকায় স্থান পেয়েছে। বাকি দুটি হচ্ছে গুজরাটের ভাদনগর এবং মোধেরা সূর্য মন্দির।
ঊনকোটি জেলার জেলা সদর কৈলাসহর থেকে প্রায় ১০ কিঃমিঃ দূরে ঊনকোটির অবস্হান। ধর্মনগর -কৈলাসহর সড়ক থেকে একটি শাখা পথ চলে গেছে ঊনকোটির বুক অব্দি।পাহাড় জুড়ে ছড়িয়ে আছে নানা দেবদেবীর মূর্তি।পৃথক পৃথক বিগ্ৰহ ছাড়াও রয়েছে পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা পাথুরে মূর্তি।এর মধ্যে সবচেয়ে বড় মূর্তিটি ঊনকোটিশ্বর শিবের,ঊনকোটিশ্বর কালভৈরব নামে যা খ্যাত।প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচু এই বিগ্ৰহ। এছাড়া রয়েছে পাথরে খোদাই গণেশ, দুর্গার মূর্তি। কিন্তু কবে কীভাবে এই দুর্গম পাহাড়ে এই সব বিগ্ৰহ সৃষ্টি হলো? ঊনকোটির বিগ্রহ সকলের সৃষ্টি যেন আজও রহস্যাবৃত।তাই জড়িয়ে আছে নানা কিংবদন্তি।আগে এই পাহাড়টির নাম ছিল রঘুনন্দন পাহাড়। একদা দেবাদিদেব মহাদেব দেবকূল পরিবৃত হয়ে যাচ্ছিলেন বারাণসী। কিন্তু রঘুনন্দন পাহাড়ে পৌঁছতেই রাত্রি নেমে আসে।দেবতাগণ তখন পথশ্রমে ক্লান্ত। ঠিক হয় এই পাহাড়ে রাত্রিযাপন করে দেবতারা পরদিন প্রত্যুষে বারাণসীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন। কিন্তু পরদিন বায়সরবে প্রভাত ঘোষিত হলেও মহাদেব ছাড়া আর কারো ঘুম ভাঙ্গলো না। দেবাদিদেব তখন একাই যাত্রা করলেন। আর বাকি দেবতারা পাহাড়ে রইলেন পাথর হয়ে। ঊনকোটি নিয়ে অপর একটি কিংবদন্তি হচ্ছে এই রকম,একদা কালু কামার নামে এক ভাস্কর এই পাহাড়ে এক রাত্রের মধ্যে কোটি দেবতা সংস্হাপনের কাজ শুরু করেন। কিন্তু একটি বিগ্ৰহের কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই ভোর হয়ে যায়। কোটি আর হয়নি,তাই নাম হয় ঊনকোটি।
যাই হোক,প্রত্ন বিশেষজ্ঞদের মতে ঊনকোটির বিগ্ৰহ সকলের নির্মাণ শুরু হয় খ্রীষ্টিয় অষ্টম-নবম শতাব্দীতে। পরবর্তী সময়েও তা পুষ্টিলাভ করে। পরবর্তী নানা সময়ে যুক্ত হয় আরও শিল্পকর্ম।কেউ কেউ বলেছেন ঊনকোটি পালযুগের শৈব তীর্থ। আবার অনেকে বলেছেন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর অবদান রয়েছে ঊনকোটিতে।কেউ কেউ এখানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবের কথাও বলে গেছেন।
ত্রিপুরার মাণিক্য রাজাদের ইতিহাসে ঊনকোটির সৃষ্টি সম্পর্কে কিছু উল্লেখ নেই।'রাজমালা'য় রাজাদের ঊনকোটি পরিদর্শনের যৎসামান্য উল্লেখ পাওয়া যায়। অবশ্য ত্রিপুরার মানিক্য রাজবংশের সূচনা মাত্র পঞ্চদশ শতকের ঘটনা।আর ঊনকোটিকে বলা হচ্ছে পালপর্বের শৈবতীর্থ। ঊনকোটির বিগ্ৰহ সমূহের সৃষ্টি ত্রিপুরার মাণিক্য যুগের অনেক অনেক আগের। তবে ত্রিপুরার সুপ্রাচীন কালের এক রাজা বিমার পুত্র কুমার মনু নদীর তীরে শিবের আরাধনা করেছিলেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। এই স্হানটি মনুনদী তীরবর্তী শৈবতীর্থ ঊনকোটি বলেই মনে করা হয়।
প্রাচীন গ্ৰন্হে ঊনকোটির উল্লেখ পাওয়া যায়।তন্ত্রে ভৈরবোক্ত কালিকা স্তোত্রে রয়েছে -"ঊনকোটীতি বিখ্যাতং সর্ব্বতীর্থনমস্কৃতং।/যত্র তেপে তপঃ পূর্ব্বং দধিচীর্মুনিসত্তমঃ।।"অর্থাৎ ঊনকোটি নামে বিখ্যাত তীর্থ সকল তীর্থ থেকে শ্রেষ্ঠ। সেখানে মুণিশ্রেষ্ঠ দধীচি প্রাচীন কালে তপস্যা করেছিলেন।
ঊনকোটির মতো কাছাড়ের ভুবন পাহাড়ও একটি শৈব তীর্থ। 'কাছাড়ের ইতিবৃত্তে' উল্লেখ রয়েছে যে,১৭০৯ শকাব্দের আগে ভুবন তীর্থ সাধারণের কাছে অজ্ঞাত এবং অগম্য ছিল। কাছাড়ের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সচিব জয়সিংহ ভুবনে মন্দির নির্মাণের উদ্দেশ্যে লোকজন সহ ভুবনের দিকে যাত্রা করেন। কিন্তু স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে তিনি সোনাইমুখের কাছে চন্দ্রগিরিতে শিবলিঙ্গ স্হাপন করে একটি ছোট মন্দির নির্মাণ করান। ভুবন পাহাড়ে প্রাচীন মন্দির,বিগ্ৰহ,সুড়ঙ্গ পথ ইত্যাদি রয়েছে।তবে বেশ আগে থেকেই বিগ্ৰহ সমূহের ভগ্নদশা চলছে। অনেকে মনে করেন ঊনকোটিরও আগে ভুবনের সৃষ্টি।আর সুদূর অতীতে কাছাড়ের ভুবন ও সন্নিহিত অঞ্চলে ত্রিপুরার রাজাদের রাজত্ব ছিল। সুপ্রাচীন কালে ভুবন পাহাড় থেকে আজকের ত্রিপুরার কৈলাসহর পর্যন্ত এক বিস্তীর্ণজনপদছিল এবং কালক্রমে তা ঘোর অরণ্যে পরিণত হয় বলে উল্লেখ রয়েছে'কাছাড়েরইতিবৃত্তে'।শৈবতীর্থ ঊনকোটি যেমন রহস্য ঘেরা তেমনই কাছাড়ের ভুবনও রহস্যাবৃত।সুড়ঙ্গ পথ সহ নানা লোকশ্রুতি জড়িয়ে আছে ভুবনকে।একদা ভুবনের পথ ছিল খুবই দুর্গম।পুণ্যার্থীদের খুব ঝুঁকি নিয়েই পাহাড়ে উঠতে হতো।সাম্প্রতিক কালে ভুবনের উন্নয়নে কিছু কিছু উদ্যোগ সহ শিবরাত্রির মেলার সময় বিশেষ ব্যবস্হা নেয়া হচ্ছে।
ঊনকোটি ত্রিপুরা তথা পূর্বোত্তরের একটি উল্লেখযোগ্য পর্যটন ক্ষেত্র হলেও সর্বভারতীয় স্তরে তার প্রচার প্রসার তুলনায় কম। ঊনকোটিতে বছরে দুবার মেলা বসে।পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে এবং বাসন্তী পূজার অষ্টমীতে অশোকাষ্টমী মেলা। দেশভাগের আগে ঊনকোটি শ্রীহট্ট জেলারও এক গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান ছিল। শতাব্দী প্রাচীন গ্রন্হ 'শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তে'ও ঊনকোটির উল্লেখ রয়েছে। নিকটবর্তী রেলস্টেশন থেকে হাঁটা পথে মানুষ ঊনকোটি দর্শনে আসতেন। পরবর্তী সময়েও মেলার সময় সীমান্তের ওপার থেকে পুণ্যার্থীরা আসতেন ঊনকোটি। বিশেষত মকর সংক্রান্তির সময় ওপারের চাবাগানের শ্রমিকরা দলে দলে ঊনকোটি আসতেন পবিত্র সীতাকুণ্ডে পুণ্য অবগাহনের জন্য। সীমান্ত সেদিনের জন্য উন্মুক্ত থাকতো। অবশ্য সাম্প্রতিক কালে এই ধারা অনেকটাই কম।
চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে আছে মন্দির, পুণ্য অবগাহনের জন্য কুণ্ড আর আছে ভাস্কর্য। প্রাকৃতিক পরিবেশ,ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বের জন্য চন্দ্রনাথ ধামের এক আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে।পীঠভূমি ঘিরে আছে নানা কিংবদন্তী।ত্রেতাযুগে সীতার আগমন ঘটেছিল এখানে।এখানে তপস্যা করেছিলেন মহর্ষি কপিল, ব্যাসদেব মুনি।চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ পাহাড়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ত্রিপুরাও।
ব্যাসদেব মুনির নাম থেকেই চন্দ্রনাথের ব্যাসকুণ্ডের নাম হয়েছে।প্রচলিত বিশ্বাস,ব্যাসদেব এই কুণ্ডে বসেই ধ্যান করেছিলেন।এর পশ্চিম পাড়ে রয়েছে ভৈরব বাড়ি।ব্যাসকুণ্ডের পূর্ব পাড়ে রয়েছে রাণীঘাট। ত্রিপুরার মহারানি তুলসীবতী চন্দ্রনাথ ধাম পরিদর্শনে গেলে পাকা ঘাট নির্মাণ করিয়ে দেন ব্যাসকুণ্ডের পাড়ে।সেই থেকে এটি রানিঘাট নামেই পরিচিত। তিনদিকে ঘেরা পাহাড়ের নিচে রয়েছে সীতাকুণ্ড।তার সাড়ে বারোশো ফুট উপরে রয়েছে চন্দ্রনাথ মন্দির। পাহাড়ের শুরুতে নিচে রয়েছে ভবানী মন্দির। এই মন্দিরের কোণায় যে অগ্নিশিখা জ্বলছে কথিত আছে তিনিই দেবী ভবানী।এই স্থানটি একান্ন শক্তিপীঠের এক পীঠ।এখানে সতীর দক্ষিণ বাহু পড়েছিল।
চন্দ্রনাথে রয়েছে স্বয়ম্ভুনাথ, চন্দ্রনাথ, বীরুপাক্ষ মন্দির।রয়েছে পাতাল কালী মন্দির, কপিলমুনির আশ্রম, প্রাচীন ভাস্কর্য সহ নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন। এরকম প্রবাদ আছে যে,কলিযুগে মহাদেব চন্দ্রনাথ পাহাড়ে অবস্থান করবেন। যুগ যুগ ধরে মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে বয়ে চলেছে এই বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের টানেই মানুষ ছুটে আসেন পাহাড়ে।এখানে উৎসবের দিনে লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী মানুষের মিলন ঘটে।শিবরাত্রি ও দোল পূর্ণিমায় মুখর হয়ে উঠে চন্দ্রনাথ।
যাইহোক, ত্রিপুরার ঊনকোটি,কাছাড়ের ভুবন পাহাড় আর চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ থেকে এটা ধারণা করতে অসুবিধা হয়না যে,একদা এইসব অঞ্চলে শৈবধর্মের মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়েছিল। পাহাড়,মন্দির, পাথরের বিগ্ৰহ, কুণ্ড, ঝর্ণা,প্রাকৃতিক পরিবেশ সব কিছুই পুণ্যার্থীদের কাছে যেমন, তেমনই পর্যটকদের কাছেও যেন এক দুর্নিবার আকর্ষণ!