'রেগিং- একটি গুরুতর সামাজিক ব্যাধি, এর চালু আইনে আরও কিছু সংশোধন প্রয়োজন'
স্বপন চন্দ্র দাস
'রেগিং' একটি ইংরেজি শব্দ, যা বাংলায় বলা যায় উৎকট ও কুৎসিত, কৌতুক বা অসভ্য আচরণাদির দ্বারা শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে উচ্চ এবং উচ্চতর শিক্ষায়তনে রেগিং এক গুরুতর কর্কট রোগের আকার ধারণ করেছে। আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলিতে রেগিং- এর সমস্যা আরো বেশি গুরুতর। প্রতিটি ছাত্র ছাত্রীর পিতামাতা বা পরিবার এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলি প্রতিটি শিশু মনকে অত্যন্ত সযত্নে, নম্রতা ও কোমলতার সঙ্গে গড়ে তুলে। সব পিতা মাতাই চায় তাদের সন্তান ভদ্র, সভ্য ও সজ্জন নাগরিক হিসাবে বড় হয়ে উঠুক। হাজার হাজার ছাত্র ছাত্রীর মধ্যে কিছু সংখ্যক মেধাবী বা অতি মেধাবী চিহ্নিত হয় যাদের পিতা মাতা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সুশিক্ষার জন্য তাদের বিভিন্ন শিক্ষায়তনে উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রেরণ করে। ঐ বিশেষ বিশেষ শিক্ষায়তন গুলি, তা ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং বা অন্য যে কোন টেকনিক্যাল সাবজেক্টই হোক না কেন, সেই শিক্ষায়তনের প্রভাব ছাত্র ছাত্রীর ভবিষ্যৎ জীবনের উপরে ফেলতে বাধ্য। কোমলমতি ছেলে মেয়েরা উচ্চ শিক্ষার অঙ্গনে এসে বিচিত্র, বিকৃত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয় যখন তাদের বরিষ্ঠরা রেগিং এর নামে বর্বরতা শুরু করে।
যে কোন কু-সংস্কৃতি, নেশাসক্ত বা অপসংস্কৃতি ব্যবস্থাপনায় ঢুকে যেতে পারলে বা ঢুকে গেলে ধীরে ধীরে তার ডালপালা বিস্তারিত হতে থাকে। একে দূর করা অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে এটা Institutionalized হয়ে পড়ে। এর জন্য মূলত: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শাসন ব্যবস্থা বা সরকারি ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ ভাবে দায়ী। শুধু মাত্র আইন করে এর আশু সমাধান সম্ভব নয়।
অনেকে আবার ছাত্র ছাত্রীদের স্মার্ট করার জন্য এই ধরনের অপসংস্কৃতিকে support করতেও দেখা গেছে এবং এর পিছনে মদতগার শিক্ষায়তনের কিছু শিক্ষক মণ্ডলীও জড়িত থাকে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্টান সম্পর্কে জানা যায় যে ছাত্র শিক্ষকের মধ্যে যে ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা ও মূল্যবোধের উপর সম্পর্ক গড়ে উঠা উচিত, তা না হয়ে স্বার্থান্বেষী বন্ধুত্ব সুলভ সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়। অনেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে রাজনীতির আখড়া হিসেবে গড়ে তুলতে চায় যা কোন অবস্থাতেই বাঞ্ছনীয় নয়।
কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নবীন বরণ উৎসব বলে শিক্ষা বর্ষের শুরুতে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এবং এখান থেকেই শুরু হয়ে যায় রেগিং- এর সূত্রপাত। যারা রেগিং নামক অসভ্যতার শিকার হয়েছে তারা বিপুল উদ্যমে নব নব কায়দায় নতুনদের উপর রেগিং নামীয় অসদাচরণ শুরু করে এতে সেই শান্ত, কোমল, সৌম্য, সরলমতি ছাত্র ছাত্রীর মূল্যবোধ, ন্যায় পরায়নতা ইত্যাদি ধ্বংস হয়ে যায়। এভাবেই একটি অতি কোমল স্বভাব, স্বচ্ছ চরিত্রের ছাত্র বা ছাত্রী তার
বাল্যকালীন মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলে এবং একটি অশ্লীল, অভদ্র, অশোভনীয় আচরণের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যায়।
রেগিং-এর নামে কি ধরনের কুৎসিত, অভদ্র ও অশালীন আচরণ করা হয় তা যারা এর শিকার হয়েছেন প্রত্যেকেই জানেন এবং বলতে পারেন। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে এবং আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেও এ সম্পর্কে যেটুকু জ্ঞান আমার আছে তা কোন প্রবন্ধে লেখার মত রুচি আমার নেই। একটি সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ কতগুলি মূল্যবোধের উপর গড়ে উঠে যেই মূল্যবোধ গুলি না থাকলে ওই মানুষকে মানুষ বলা চলে না। এরকম মূল্যবোধহীন কিছু অশ্লীল, অভদ্র অন্যায় আচরণই practice করা হয় রেগিং-এর মাধ্যমে। এই সংস্কৃতি ভারতীয় মূল্যবোধের বিরুদ্ধে, মানুষের স্বাভাবিক চিন্তা, চেতনা ও সু-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। সুতরাং এর বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ রকমের প্রতিরোধ গড়ে উঠা উচিত। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলিতে এটা কঠোর ভাবে প্রয়োগ করা উচিত। এর সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর ন্যাস্ত। দায়িত্ব প্রাপ্তরা এই অন্যায় অপসংস্কৃতিকে যদি দূর করতে না পারেন, তাদের দায়িত্বে থাকার কোন অধিকার নেই।
আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অসামাজিক আচরণ, নেশা দ্রব্যের সেবন ইত্যাদি এই অপসংস্কৃতিরই ফলশ্রুতি। একে দূর করার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলিতে
আইনের পরিবর্তনও আবশ্যক। এমন কোন উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে রেগিং- এর অপসংস্কৃতি ঢুকে নাই। প্রতিটি রাজ্যেই রেগিং প্রতিরোধ করার জন্য আইন প্রনয়ণ করেছে যেমন আমাদের ত্রিপুরায় রয়েছে ". The Tripura Educational Institutions (Prevention of Ragging) Act, 1990"।
এই আইনের ৩ নং ধারায় রেগিং এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে “Whoever, being a student in any Educational Institution, causes a fellow student to suffer physically or mentally by way of assault, intimidation insult, tease, torment or any other form of torture commits ragging".
৪ নং ধারায় রেগিং-এর শাস্তির বিধান রয়েছে যাতে বলা হয়েছে “whoever commits ragging shall be punished with imprisonment of either description for a term which may extend to four years or with fine or with both"।
৫ নং ধারায় বলা হয়েছে রেগিং একটি অপরাধ। "The offences of ragging shall be cognizable and non-bailable” রেগিং এর সঙ্গে জড়িত থাকলে ওই জড়িত ব্যক্তি বিশেষ (ছাত্র / ছাত্রী ) শিক্ষায়তনের পড়াশুনা করার অধিকার হারাবে।
প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলি এই আইন সম্পর্কে সচেতন থাকতে বাধ্য এবং এই আইনকে সুষ্ঠ ভাবে প্রচারে নিয়ে যেতে হবে। ত্রিপুরা রাজ্যের এই আইনটিতে কিছু সংশোধনী প্রয়োজন যা অত্যন্ত জরুরি ভিত্তিতে করা উচিত। আশা করি আইন দপ্তর এর উদ্যোগ নেবে।
ত্রিপুরা মানব অধিকার কমিশন ২০২২ সালে খেরেঙজুড়ি জওহর নবোদয় বিদ্যালয়ে রেগিং সংক্রান্ত এক অভিযোগের খবরের ভিত্তিতে স্বত: প্রনোদিত হয়ে Complaint No 5 of 2022 লিপিবদ্ধ করে এবং তদন্ত মুলে বিগত ০১/১১/২০২২ ইং তারিখে একটি বিস্তারিত আদেশ প্রদান করে। পরবর্তী কালে অনুরূপ একটি অভিযোগের খবরের ভিত্তিতে উদয়পুর বনদুয়ার জওহর নবোদয় বিদ্যালয়ের ব্যাপারেও রাজ্য মানব অধিকার কমিশন বিস্তারিত তদন্ত করে ০৩/০১/২০২৩ ইং তারিখে এক আদেশ প্রদান করে। ওই আদেশের কপি গুলি প্রতিটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলির দেখা উচিত এবং উপযুক্ত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
রেগিং এক গুরুতর ফৌজধারী অপরাধ। এ এক অপসংস্কৃতি, বিকৃত রুচি সম্পন্ন মানসিকতা এবং মূল্যবোধ বিরোধী যাহা ভারতীয় ন্যায়ীক সমাজ ব্যবস্থার মূল কাঠামো এবং মূল্যবোধের পরিপন্থী। এই কু-সংস্কার ও অপ-সংস্কৃতিকে সর্বতোভাবে বর্জন এবং ঘৃণার চোখে দেখা উচিত। যারা এতে জড়িত থাকবে তাদের সামাজিক বর্জন হওয়া বাঞ্ছনীয় এবং সমস্ত রকমের সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা উচিত।
প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক ভাবে এর প্রচার করা বাধ্যতা মূলক হওয়া উচিত। ( লেখক শ্রী স্বপন চন্দ্ৰ দাস অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আগরতলা, ত্রিপুরা)