।। অপাংক্তেয় ।।
অরিন্দম নাথ
দু'হাজার সালের ত্রিপুরা উপজাতি স্বশাসিত জেলা পরিষদ নির্বাচন বা টিটিএএডিসি নির্বাচন উগ্রপন্থা দমনে নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়েছিল । নির্বাচন হয় সে বছরের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে । নির্বাচনের আগে বৈরীরা হঠাৎ সক্রিয় হয়ে ওঠে । বিশেষকরে, এনএলএফটি বৈরীরা । তখন রাজ্যে এবং এডিসিতে বামফ্রন্টের সরকার । তাদের মুখ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে, হঠাৎ গজিয়ে ওঠা উগ্রজনজাতি চিন্তাধারার একটি দল । দলটির প্রতি উগ্রবাদীদের সমর্থন লক্ষ্য করা যায় । তাদের হয়ে তারা পাহাড়ে প্রচার করত । দলটির প্রার্থীদের ভোটে জয়ী করার জন্য সাধারণ মানুষের উপরে চাপ দিত । গণমুক্তি পরিষদের নেতাদের উপর আক্রমণ হানত । পাশাপাশি বাঙ্গালীদের উপর চূড়ান্ত আঘাত নেমে আসে । পুলিশ প্রশাসক হিসেবে আমরা তখন হিমসিম খাচ্ছিলাম । এরমধ্যে একটি আধা-সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব তলে তলে বিভীষণের ভূমিকা নেন । এরকম পরিস্থিতিতে সন্ত্রাসবাদ থেকে বিদ্রোহে পরিবর্তিত হচ্ছিল ।
বিদ্রোহের প্রাথমিক স্তর হচ্ছে টেররিজম বা সন্ত্রাসবাদ । ভয়ের সঞ্চার করা । এরমধ্যে অনেক সময় কোন দাবী থাকে না । একজন লোকও টেরর সৃষ্টি করতে পারে । এরপর আসে চরমপন্থা বা এক্সট্রিমিজম । চরমপন্থায় কিছু উদ্দেশ্য যুক্ত হয় ।তারপর আসে মিলিটেন্সি । মিলিটারির মত পদ অলংকৃত করে । তেমন ত্রিপুরার বৈরীরা করেছিল । সবশেষে আসে ইনচারজেন্সি বা বিদ্রোহ । সেখানে মিলিটান্টরা জনগণের সমর্থণ আদায় করে নেয় । আমি তখন দক্ষিণ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার । উপজাতি মহল্লায় বৈরী কিংবা আসামী ধরতে গেলে প্রতিরোধ আসত । উপজাতি মহিলাদের লেলিয়ে দেওয়া হত প্রতিরোধ করার জন্য । আমি দক্ষিণ জেলায় যোগ দেওয়ার পর এই প্রতিরোধ ভাঙ্গার জন্য উদ্যোগী হই । অতিরিক্ত লেঠেল বাহিনী পাঠাতাম । বেশ কয়েক জায়গায় আমারা অপরাধী ধরে নিয়ে আসার জন্য লাঠি চালাই । এরপর এই প্রবণতা কমে আসে । বিশেষকরে, জেনুইন আসামী ধরলে প্রতিরোধ আসত না । পাশাপাশি সমতলে একদল লোক উগ্রপন্থীদের প্রচ্ছন্ন মদত দিত । বৈরী ঘটনা ঘটলে বাঙালীদের রাস্তা অবরোধ করতে বাধ্য করত । ফোর্সের পেছন পেছন গিয়ে উপজাতি মহল্লায় আগুন দিত । দক্ষিণ জেলায় দেখেছি এইসব ঘটনার পেছনে কিছু চোরাই কাঠের ব্যবসায়ী জড়িত থাকত । আমরা তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর হলাম । ফলে দক্ষিণ জেলায় তুলনামূলক রাস্তা অবরোধ কমে আসে ।
এই পরিস্থিতি থাকে না । এডিসিতে পালাবদল হলে পুলিশের বিরুদ্ধে জনজাতিদের প্রতিরোধ চরম আকার ধারণ করে । শামুকছড়ায় একটি ঘটনা ঘটে । কাকরাবন ফাঁড়ি থানার ওসি এসআই আশীষ দেবের নেতৃত্বে একটি টিএসআর বাহিনী গিয়েছিল পাশের যাত্রাপুর থানার রামছড়া এলাকায় । বৈরী বিরোধী অভিযানে । সেখানে বৈরীদের অবস্থানের সুনির্দিষ্ট খবর ছিল । কিন্তু মহিলাদের প্রতিরোধে ভেরিফাই করতে পারে না । অন্য জেলা হওয়াতে বলপ্রয়োগ করে না । আমাদের ফোর্স শামুকছড়া হয়ে ফিরে আসছিল । সেখানে আবার আমাদের ফোর্সের সামনে মহিলাদের দিয়ে পথ অবরোধ করায় । বৈরীরা থাকে পেছনে । তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে । হঠাৎ বৈরীরা গাঁদা বন্দুক থেকে গুলি করে । পাশাপাশি স্থানীয় জনগণও আক্রমণ করে । ফোর্স তখন পাল্টা গুলি চালাতে বাধ্য হয় । একজন সিভিলিয়ন মারা যান । একটি মেয়ের পায়ে গুলি লাগে । এই ঘটনার পর থেকে দক্ষিণ জেলায় গ্রামবাসীদের প্রতিরোধ কমে আসে । অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে আমি চারজন এসপি পেয়েছি । আমি দীর্ঘ সময় জেলায় থাকার দরুণ উপরের এবং নিচের মধ্যে এক কমন যোগসূত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম । বিশেষকরে, নিম্ন পর্যায়ের পুলিশ কর্মচারীদের সঙ্গে আমার একটি সুদৃঢ় সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল । সবসময় তাদের পাশে থাকতাম ।
দু'হাজার সালের জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি মাসে আরও একটি ঘটনা ঘটে । এলাকার দখল নিয়ে এটিটিএফ এবং এনএলএফটির মধ্যে সংঘর্ষ হয় । কালাঝরি পাহাড়ে । ডুম্বুর জলাশয়কে অবলম্বন করে এটিটিএফের একটি দল মাইকেল দেববর্মার নেতৃত্বে নতুনবাজার এবং বীরগঞ্জ থানা এলাকায় সক্রিয় ছিল। কালাঝারি পাহাড় হচ্ছে আঠারমুড়া পাহাড়ের দক্ষিণ অংশ । উত্তরের অংশ খোয়াই নদীর উপর দিকে উত্তর পাড়ের দিকে আঠারমুড়া । বীরগঞ্জ এবং নতুনবাজার থানার অবস্থান সমান্তরালে অবস্থিত দেবতামুড়া ও এবং কালাঝারি পাহাড়ের মধ্যের সমতল ও আধাআসমতল ভূমি । মধ্যদিয়ে বয়ে যাচ্ছে গোমতী নদী । এনএলএফটি অন্যান্য সব জায়গায় সক্রিয় ছিল । এটিটিএফের সঙ্গে সংঘর্ষে এনএলএফটি জয়ী হয় । সিআরপিএফ কিছু অস্ত্র উদ্ধার করে ।
টিটিএএডিসিতে পালাবদলের কারণে গণমুক্তি পরিষদের সদস্যদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় । তারি বৈরী বিরোধী অভিযানে পুলিশকে কার্যকরী খবর দিতে শুরু করে । পাশাপাশি দক্ষিণ জেলায় হদাঅক্রা অশ্বত্থামা জমাতিয়ার নেতৃত্বে জমাতিয়ারা বৈরীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় । কারণ বেশিরভাগ বৈরী ছিল খ্রিস্টান । কিছুদিন বৈরীদের আক্রমণ বন্ধ থাকে । ইতিমধ্যে শ্রীযুক্ত বি এল ভোরা (B. L. Vohra) ডিজিপি ত্রিপুরা হিসেবে যোগ দিয়েছেন । সবাইকে উজ্জীবিত করার এবং টিম হিসেবে চালিয়ে নিয়ে যাবার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল স্যারের । দক্ষিণ জেলার এসপি অনুরাগ স্যার বদলি হয়ে পশ্চিম জেলার এসপি হিসেবে যোগ দিয়েছেন । জুন মাসের দুই তারিখে তিনি আমার কাছে দক্ষিণ জেলার অস্থায়ী দায়িত্ব দিয়ে গেছেন । শ্রীযুক্ত টি বি রায় স্যার দক্ষিণ জেলার এসপির দায়িত্ব নেবেন । স্যারের আসতে দেরি হয় । এই অবস্থায় ১৬ই জুন সন্ধ্যায় আগরতলা পুলিশ সদর থেকে খবর পাই পরদিন ডিজিপি স্যার এবং আইজিপি ইন্টেলিজেন্স স্যার হেলিকপ্টারে যতনবাড়ি পৌঁছাবেন । সেখানে আধা-সামরিক এবং পুলিশকে নিয়ে মিটিং করবেন । ইনচার্জ এসপি হিসাবে আমাকে সেই মিটিংয়ে থাকতে হবে । স্যারদের রিসিভ করতে হবে । অমরপুর থেকে নতুনবাজারের রাস্তায় আরওপি বা রোড ওপেনিং পার্টির দায়িত্বে ছিল পঞ্চম বাহিনী টিএসআরের জওয়ানরা । তাদের ডলুমা সদর সদর দপ্তর থেকে আরওপি লাগাত । সকাল আটটা থেকে আরওপি লাগত । উদয়পুর থেকে নতুনবাজার হয়ে যতনবাড়ি পৌঁছাতে দেড় ঘন্টার মত সময় লাগবে । আমি তৎক্ষণাৎ আমাদের কন্ট্রোল রুমের মারফৎ খবর পাঠাই আরওপি যেন পরদিন এক ঘন্টা আগে লাগানো হয় । আমি সাধারণত দুইটি গাড়িতে এসকর্ট নিয়ে চলাচল করতাম । সকাল সকাল বেরুতে হবে এইকথা চিন্তা করে তিনটি এসকর্ট গাড়ি নিয়ে যাওয়া মনস্থ করি । সকাল সোয়া ছটায় বেরিয়ে যাব । এভাবে আদেশ দিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে কাঁকড়াবন পুলিশ ফাঁড়িতে যাই । সেখানে কিছু কাজ করে রাত্রি দশটা নাগাদ কোয়ার্টার ফিরে আসি ।
১৭ই জুন ২০০০, শনিবার সকাল সোয়া ছটার দিকে উদয়পুর থেকে রওয়ানা হই । আমাদের চারটি গাড়ি ও লোকজন ছিল নিম্নরূপ :
প্রথম গাড়ি TR01 0873, ড্রাইভার মানিক মুরাসিং, হাবিলদার অমল বৈদ্য, কনস্টেবল বলরাম দেববর্মা, অমল শীল, বিজয় বৈদ্য এবং রসরাজ দাস ।
দ্বিতীয় গাড়ি TR03 0906, ড্রাইভার শ্যামনাথ রামকুমার, অরিন্দম নাথ, হাবিলদার কামাখ্যা রঞ্জন দাস, কনস্টেবল পঙ্কজ দাস, তপন দেবনাথ এবং জহর দেববর্মা ।
তৃতীয় গাড়ি TR03 0877, ড্রাইভার সুভাষ লোধ, হাবিলদার মনতোষ চক্রবর্তী, কনস্টেবল সূর্য দেববর্মা, কৃষ্ণ ত্রিপুরা এবং নৃপেনজয় দেববর্মা ।
চতুর্থ গাড়ি TR03 0905, ড্রাইভার শংকর দাস, নায়েক রঞ্জিত দাস, কনস্টেবল সুরজিৎ সরকার, নয়নজ্যোতি চাকমা, সুশীল দাস এবং জীবন পাল ।
সকাল সাতটা নাগাদ আমরা ডলুমায় পৌঁছাই । টিএসআর ড্রপ গেটে জানতে চাই আরপি লেগেছে কিনা । উত্তর আসে আরওপি লাগেনি । কিছুক্ষণের মধ্যে আরওপি বেরুবে । তখন জানতে চাই ফোর্সের কোনো গাড়ি আগে গিয়েছে কিনা । উত্তর আসে, ৯০ ব্যাটেলিয়ান সিআরপিএফের ডেপুটি কমান্ডেন্ট কনৌজিয়া সাহেব কিছুক্ষণ আগে নতুনবাজারের দিকে গিয়েছেন । আমরা আরওপি লাগার জন্য অপেক্ষা করি না । নতুনবাজারের দিকে এগিয়ে যাই । ডলুমা থেকে আনুমানিক দুই কিলোমিটার দূরে পাহাড়পুর যাত্রীশেড । পাহাড়পুর গ্রাম যাত্রীশেড থেকে দুই তিন কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত । কালাঝারি পাহাড়ের পশ্চিম পদতলে ।
তখন সময় সকাল সাতটা দশ সোয়া সাতটা হবে । হঠাৎ একটি বুম করে আওয়াজ । আমার গাড়ির ড্রাইভার শ্যামনাথ রামকুমার ভাবে গাড়ির টায়ার ফেটেছে । মুখেও সেই কথা বলে । সে নেমে পড়ে গাড়ি থেকে । মাথা নীচু করে টায়ার দেখে । মুহূর্তে ঝাকে ঝাকে গুলি আসা শুরু হয় । আমরা বুঝতে পারলাম বৈরীদের অ্যাম্বুশে আমরা পড়েছি । আমি দরজা খুলে বাঁদিকে ঝাঁপ দিই । ওই দিক থেকেই উগ্রবাদীরা গুলি করছে । ফুট চারেক উঁচু টিলা । উপরে বৈরীদের অবস্থান । আমি হামাগুড়ি দিয়ে অ্যাম্বুশ জোন পেরিয়ে এগিয়ে যাই । তখন আমার মাথার উপর দিয়ে গুলি যাচ্ছে । কিছু আবার ট্রেসার বুলেট । আগুনের ফুলকি দেখা যাচ্ছে । বৈরীরা আমার থেকে দুই তিনফুট দূরে । সেখান থেকে গালি দিচ্ছে । আমাদের দল পাল্টা জবাব দিচ্ছে । আমাদের সুবিধা হয়েছে হবিলদার অমল বৈদ্যদের গাড়ি অ্যাম্বুশ জোনের বাইরে । তারা কাভার ফায়ার দিচ্ছে । মিনিট দশেক পর বৈরীদের আওয়াজ পাই না । পেছনের গাড়ির রঞ্জিত দাস এবং ড্রাইভার ছাড়া সবাই আহত । তৃতীয় গাড়ির সূর্য দেববর্মা ও কৃষ্ণ ত্রিপুরা আহত । আমার দেহরক্ষী পঙ্কজকে দিয়ে দুটি গাড়িতে আহতদের হাসপাতালে পাঠাই । ইতিমধ্যে টিএসআররা দৌড়ে এসেছে । এসডিপিও অমরপুর সৌরভ ত্রিপাটিও এসেছেন । আমি এসডিপিওকে বৈরীদের বিরুদ্ধে ধাওয়া করার দায়িত্ব দিই । জহর দেববর্মা ও একটি ছেলে রয়ে যায় ।
আহতদের সবাইকে অমরপুর থেকে উদয়পুরে রেফার করেছে । এরমধ্যে সবচাইতে খারাপ অবস্থা সূর্য দেববর্মার । গ্রেনেডের আঘাতে একটি পা উড়ে গেছে । উদয়পুর থেকে সূর্যকে জিবি হাসপাতালে রেফার করা হয় । রক্তের প্রয়োজন । রেয়ার গ্রুপ । এবি নেগেটিভ । খবর রটে গেছে আমার উপর আমার গুলি লেগেছে । অনেকেই রক্ত দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসে । এর মধ্যে অমরসাগরপারের অর্জুন দাস ও গয়া শীলের এবি নেগেটিভ রক্ত পাওয়া যায় । আমি পুলিশ সদরে অনুরোধ করি হেলিকপ্টারে সূর্যকে শিফট করার ব্যবস্থা করার জন্য । একজন আইজি সাহেব বলেন চপার উঠানামা করতে করতেই সূর্য আগরতলায় পৌঁছে যাবে । তাকে তাড়াতাড়ি রওনা করে দিতে । আমরা তাকে অ্যাম্বুলেন্স পাঠাই । পথে বিশালগড় পৌঁছার পর সে মারা যায় । বাকি জখমপ্রাপ্তদের মধ্যে সুরজিত সরকারের আঘাত সবচাইতে গুরুতর ছিল । তার ডান পায়ে গ্রেণেডের স্প্লিন্টার লেগেছিল । সুস্থ হলেও চল্লিশ শতাংশ ডিজিবিলিটি ডেভেলপ করে । এখনো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটে । পা যেন একটু ছোট হয়ে গেছে । বাকিদের গুলি লেগেছিল । জীবন পাল, নয়নজ্যোতি চাকমা এবং সুশীল দাস দীর্ঘদিন ভোগে । তিনজনেরই কিছু কিছু ডিফর্মিটি রয়ে গেছে । সবচেয়ে অসহায় লাগতো আহতদের পরিবারের লোকদের সামনা-সামনি হতে । তাদেরকে সুস্থ করে তুলতে পরিবারের সদস্যদের ত্যাগ ও তিতিক্ষা ভাষায় অবর্ণনীয়।
আমি ঘটনাটির রিকনস্ট্রাকশন করেছিলাম । বৈরীদের তরফে অ্যাম্বুশে নেতৃত্ব দিয়েছিল তপন কলই । তার মত নৃশংস উগ্রপন্থী ত্রিপুরায় কমই জন্মেছে । ফোর্সের উপর বহু হামলা করেছে । সে আত্মসমর্পণ করেছে বলে শুনেছি । জনান্তিকে জেনেছি, তার কথায় সেদিন তাদের টার্গেট নাকি ছিল টিএসআর আরওপি বাহিনী । কিন্তু আমাদের এসকর্টের সামনে তারা এক্সপোজ হয়ে যায় । এটাও ঠিক, আমাদের পেছনের গাড়ির নায়েক রঞ্জিৎ দাস গাড়ি থেকেই কারবাইন দিয়ে ব্রাশ ফায়ার করেছিল । তখন তারা গ্রেণেড লব করে । গ্রেণেডের শব্দে গাড়ির টায়ার পাংচার হয়েছে ভেবে শ্যামনিথ গাড়ি থামিয়ে দেয় । তৃতীয় গাড়ির পথ আটকে যায় । গাড়িটি ডান দিকে মোড়ে নালার কাছাকাছি চলে যায় । তৃতীয় ও চতুর্থ গাড়ির মাঝামাঝি গ্রেনেড পড়েছিল । তৃতীয় গাড়িতে সূর্য ছিল । সে নেমে পেছনের দিকে যাবার সময় গ্রেনেড ফাটে । গ্রেণেড ফাটলে নয় মিটার রেডিয়াসের মধ্যে লোকজন বাঁচতে পারে না । প্রথম ফায়ার আমরা করেছি বলে কিছুটা এডভানটেজ পেয়েছি । প্রথম গাড়িটি গাড়িটির পাশাপাশি আমার গাড়ির জওয়ানরা সুস্থ ছিল । তারা বীরত্তের পরিচয় দেয় । পাল্টা গুলি । আমার পিজি তপন দেবনাথ এত গুলি করেছিল যে তাঁর এসএলআর গরম হয়ে ব্যারেল বেঁকে গিয়েছিল । একই অবস্থা হয়েছিল অমল শীলের হাতিয়ারের ।আর সবচাইতে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিল কৃষ্ণ ত্রিপুরা । উগ্রবাদীরা যে টিলায় অ্যাম্বুশ নিয়েছিল সেখানে ওঠে কৃষ্ণ ফায়ার করে । তার হাতে গুলি লাগে । সেখানে একটি ভীমরুলের বাসা ছিল । গুলিতের সেটা ডিসটার্ব হয় । কিছু ভীমরুল কৃষ্ণকে কামড় দেয় । বাকিগুলি উগ্রবাদীদের দিকে ধাওয়া করে । বলা যায়, মানুষ এবং পতঙ্গের প্রতিরোধে বৈরীরা পিছু হটে । হাতিয়ার লুট করতে পারে না ।
তপন কলইয়ের বক্তব্য আমার এবং আমার প্রোটেকশনে যারা ছিল তাদের বিশ্বাস হয় না । বিশেষকরে, জনজাতি সদস্যরা বৈরীদের আমার নাম নিয়ে গালাগালি দিতে শুনেছে । আমার উপর উগ্রপন্থীদের ক্ষোভ ছিল । এর আগে আমার নেতৃত্বে পুলিশ অভিযানে রাইয়াবাড়িতে বৈরীনেতা হাফলং জমাতিয়া মারা যায় । এই ঘটনার কিছুদিন আগে একদিন বিকেলে আমি কিল্লা থানায় গিয়েছিলাম । উদয়পুর কিল্লার মধ্যে তখন একটিই গাড়ির সড়ক । যখন ফিরবো তখন খবর এলো রাইয়াবাড়িতে উপজাতি লোকেরা পথঅবরোধ করেছে । হাফলং জমাতিয়ার এক আত্মীয় নেতৃত্ব দিচ্ছে । পুলিশের বিরুদ্ধে কোন একটা অভিযোগ । খবর পাই যে এদের পেছনে বৈরীরা রয়েছে । এই অবস্থায় অন্ধকারে তাদের মোকাবিলা সমীচীন মনে করি না । থানায় গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে পিত্রা হয়ে উদয়পুর ফিরে আসি ।আমার ফিরে আসার খবর পেয়ে রাস্তা অবরোধ উঠে যায় । প্রসঙ্গক্রমে এটিটিএফ এর পত্রিকা চবাতেও আমার মুন্ডুপাত হত।
আরেকটি তথ্য পেয়েছিলাম । উদয়পুরের এসপি অফিস থেকে ষোল তারিখ সন্ধ্যায় ডলুমায় টিএসআরের কাছে খবর পাঠিয়েছিলাম পরদিন সকালে একঘন্টা আগে আরওপি লাগাতে । তাদের সান্ধ্য রোল কলে সেটা জানানো হয় । একটি উপজাতি ছেলে, যার বাড়ি পাহাড়পুর রোল কলের পর গ্রামে চলে যায় । সে হয়তো লুজটক করেছে । যদিও সে আমার কাছে অস্বীকার গিয়েছিল। বৈরীদের চর সেখানে ছিল । সেই অনুযায়ী তপন কলই প্ল্যান বানায় । একটি এসকর্ট বেশি নেওয়াতে সেদিন বেঁচে গিয়েছিলাম । শ্যামনাথ রামকুমার এখন নেই । বছর তিনেক আগে ক্যান্সারে মারা গিয়েছে । সেদিন বোকামী করে সে গাড়ি থামিয়ে দিয়েছিল । অন্যথায় আমরা হয়তো অ্যাম্বুশ জোন পেরিয়ে যেতাম । রাখে হরি, মারে কে। সেদিন আমাদের বাঁচাতে ভীমরুলও এগিয়ে এসেছিল ।
একটি দুঃখ মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বয়ে বেড়াব । আমার কনভয়ের উপর অ্যাম্বুশ হয় ১৭ই জুন, ২০০০ তারিখে । শ্রীযুক্ত টি বি রায় স্যার এসে জেলার এসপির দায়িত্ব নেন ২১ বা ২২ শে জুন তারিখে । মধ্যের তিন চারদিনের মধ্যে কোন উচ্চপদস্থ অফিসার আসেননি আমাকে সান্ত্বনা দিতে । ডিআইজি, আইজি কিংবা ডিজি কেউই আসেননি । আমি যেন অপাংক্তেয় । তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই ভরসা ।
'জন্ম মোদের ত্র্যহস্পর্শে, সকল-অনাসৃষ্টি....ছুটি নিলেন বৃহস্পতি, রইল শনির দৃষ্টি।'
শনিবাসরীয় এই ঘটনায় একটি মজার মুহূর্তও ছিল । আমার পরনে ছিল খাকি ডাংরি । চোখে রেবেনের রোদ চশমা । কোমরে পিস্তল । লাফিয়ে নামার পর, অ্যাম্বুশ জোন পেরিয়ে গেছি । হঠাৎ খেয়াল হল আমার চোখে শোভা পাচ্ছে গগলস । সেই রোদ চশমা পুরাতন ভৃত্যের মত আমাকে আজও সঙ্গ দেয় । আর সঙ্গ দিত তিনটে গাড়িতে অনেকগুলি গুলির ক্ষত । বৈরী-বিরোধী অভিযানের উপর লেখা ২০১৫ সালে জ্ঞান-বিচিত্রা থেকে প্রকাশিত 'নাম রেখেছি বনলতা' বইটি উৎসর্গ করেছিলাম সূর্য দেববর্মা এবং আমার সেদিনের সাথীদেরকে । বিশ বছর পূর্তিতে একবার সেই স্পটে গিয়েছিলাম । স্থানটির ভার্জিন সৌন্দর্য আমায় মুগ্ধ করেছিল ।