।। ধনঞ্জয়ের গাড়ি ।।

অরিন্দম নাথ

সময়টা ১৯৯২ সাল । ফেব্রুয়ারি মাস । আমি তখন প্রশিক্ষণার্থী ডিএসপি। এর আগে একমাস গ্রামীন থানায় কাজ করেছি । অমরপুর মহকুমার নতুন বাজার থানায় । এবার শহরের থানা । মহকুমা সদরের বীরগঞ্জে । বড়বাবু রথীন্দ্র দে । সাব ইন্সপেক্টর । অমরসাগর দীঘির পারে থানা । টিলার উপর । একপাশে মহকুমা শাসকের অফিস । অন্যপাশে বাজার । থানার টিলা ও দীঘির মধ্যে মধ্য দিয়ে সামনের দিকে পিচ রাস্তা । থানার সামনে স্পেস নিতান্তই কম । একটি জিপ গাড়ি ঘুরানোর জায়গাও নেই । মোটর চলাচলের একটিই ফটক । গাড়ি ঢুকালে আবার রিভার্স গিয়ার করে টিলা থেকে নামাতে হয় । তারপর ঘুরিয়ে ব্যাক গিয়ারে থানার পোর্টিকর সামনে প্লেস করা হয় । স্হান সংকুলানের এতো অভাবের মধ্যেও থানার সামনের কোর্টিয়ার্ডের একটি কোণে দাঁড়িয়েছিল একটি জিপ গাড়ি । পরিত্যক্ত অবস্থায় । যদিও চলার উপযোগী । অনেকসময় স্টাফেরা গাড়িতে বসতো । কোয়ার্টারের বাচ্চারাও মাঝেমধ্যে বসার সুযোগ নিত । থানায় যোগ দেওয়ার পর আমি পিন্টু দেববর্মার সঙ্গে মেস করে থাকতাম । পিন্টু সাব ইন্সপেক্টর । থার্ড অফিসার । সিআই সাহেবের ড্রাইভার ছিল অরুণ চক্রবর্তী । সে আমাদের সঙ্গেই অমর সাগরে স্নান করতো । সাঁতার কাটতো । কয়েকদিনের মাথায় অরুণকে গাড়িটি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "কার গাড়ি ?"



- ধনঞ্জয়ের গাড়ি।



- কার গাড়ি?



- ধনঞ্জয়ের গাড়ি ।



- কোন ধনঞ্জয় ?



সেদিন সেকেন্ড অফিসার জিতেন দেবনাথও আমাদের সঙ্গে ছিলেন । তিনি উত্তর দিলেন, "স্যার, সারেন্ডার উগ্রপন্থী ধনঞ্জয় রিয়াঙের গাড়ি ।"



আমি এর আগের বছর অর্থাৎ ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বর শিলং ছিলাম । আমাদের ট্রেনিং এর সুবাদে । এখানকার খবর জানতাম না । জিতেন বাবুর কাছ থেকে এবং অন্য অফিসারদের কাছ থেকে বিস্তৃত জানলাম ।



ধনঞ্জয় রিয়াঙ ছিল টিএনভি উগ্রপন্থী । ত্রিপুরা ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্স । বাড়ি শান্তির বাজার থানাধীন দেবীপুর অঞ্চলে । ১৯৮৮ সালের অগাস্ট মাসে সে অন্যান্য টিএনভি বৈরীদের সঙ্গে আত্মসমর্পণ করে । স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে । এসটি কর্পোরেশন থেকে ঋণ নিয়ে একটি গাড়ি কেনে । জিপ গাড়ি । গাড়িটি শান্তিরবাজার এবং অমরপুর এর মধ্যে পাহাড়ি পথ দিয়ে চলাচল করতো । শান্তিরবাজার, আদিপুর, দেবীপুর, বর্মাটিলা, চেলাগাঙ, কুর্মা, তুতবাগান হয়ে অমরপুর । রাস্তা ভালো না হলেও, সময়ের সাশ্রয় হওয়ায় লোকজন গাড়িটি চলতো । তাছাড়া আত্মসমর্পণকারী বৈরীর গাড়ি হওয়াতে উগ্রবাদী হামলার চান্স কম ছিল ।



ইতিমধ্যে তলে তলে ধনঞ্জয় রিয়াঙ এবং আরও কিছু আত্মসমর্পণকারী বৈরী ও বিপথগামী যুবক নতুন একটি উগ্রবাদী দলের জন্ম দিয়েছে । এদের মধ্যে শিক্ষিত কিন্তু অতিরিক্ত লোভী ছেলেরাও ছিল । নতুন দলটির নাম এনএলএফটি । ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট অফ ত্যুইপড়া । মুখে তাদের স্বাধীন ত্রিপুরার স্লোগান । বৈরী দলটির জন্ম হয়েছিল আগরতলা শহরে । ১৪ই এপ্রিল ১৯ ৮৯ ইংরেজি তারিখে । কুমারী-মধুতি-রূপশ্রী গেস্ট হাউসে । এরপর কিছুদিন দলটি শীতঘুমে কাটায় । ১১ ই ডিসেম্বর ১৯৯০ ইংরেজি তারিখে এনএলএফটি আত্মপ্রকাশ করে । সেদিন সকাল নটার দিকে ধনঞ্জয়ের নেতৃত্বে একটি উগ্রবাদী দল উদয়পুরের তৈনানী ফাড়ি থানা আক্রমন করে । দলটিতে ১০-১২ জন উগ্রবাদী ছিল । সবাই সাদা পোশাকে । তৈনানী ফাড়ি থানার অবস্থান বাজারের লাগোয়া । একপাশে তৈনানী ছড়া । তখন একজন সেন্ট্রি এবং একজন ডিউটি অফিসার ছিল । ধনঞ্জয় রিয়াঙ একজন সঙ্গীকে নিয়ে থানায় ঢুকে । গ্রামীণ জনজাতি পুরুষের বেশে । তার কাঁধে ছিল একটি কাপড়ের ব্যাগ । সে সেন্ট্রিকে বলে যে একটি এজাহার করবে । সেন্ট্রি তাকে ডিউটি অফিসারের রুম দেখিয়ে দেয় । তৎক্ষণাৎ সে তার ব্যাগ থেকে একটি হাতুড়ি বের করে সেন্ট্রির মাথায় আঘাত করে । অতর্কিত আক্রমণে সেন্ট্রি লুটিয়ে পড়ে । ধনঞ্জয় সেন্ট্রির কাছ থেকে হাতিয়ার ছিনিয়ে নিয়ে আগুয়ান ডিউটি অফিসারকে গুলি করে । তার সঙ্গীরা সেন্ট্রির কোমর থেকে চাবি নিয়ে তোপখানা খুলে ফেলে । হাতিয়ার ও গোলাবারুদ লুট করে । অন্য পুলিশরা বাধা দিতে পারে না । তারপর তারা পালিয়ে যায় । আগেই উল্লেখ করেছি আমি ট্রেনিং-এ ছিলাম । তাই ঠিক কতজন মারা গিয়েছিল এবং কয়টি হাতিয়ার লুট হয়েছিল সঠিক বলতে পারব না ।

ধনঞ্জয় এবং তার সঙ্গীদের শনাক্ত করে খোঁজা শুরু হয়। পুলিশ তার উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য গাড়িটি বাজেয়াপ্ত করে। বীরগঞ্জ থানার উঠানে রেখে দেয় । আমি ধনঞ্জয়ের সঙ্গে একবারই সামনাসামনি লড়াই করার সুযোগ পেয়েছিলাম। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯২ সালের অক্টোবর মাসে । শান্তির বাজার থানাদিন চাকাকু ছাড়া জঙ্গলে সে ডেরা বেধেছিল । সেখানে আমরা হামলা করি । তাদের সঙ্গে গুলির লড়াই হয় । তাদের প্রচুর ক্ষতি সাধন করতে পারলেও ধনঞ্জয় ন্যাংটো হয়ে পালিয়ে যায় । লুট করে নেওয়া কয়েকটি হাতিয়ার ও অন্যান্য সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করতে সক্ষম হই । পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে সে আবার আত্মসমর্পণ করে । ত্রিপুরা রিসারেকশন আর্মি বা টিআরএ নাম নিয়ে । এরপর প্রায় পনের বছর আমি ওই তল্লাটে ছিলাম । বীরগঞ্জ থানায়ও গিয়েছি । প্রতিবারই দেখতাম 'ধনঞ্জয়ের গাড়ি' দাঁড়িয়ে আছে । বীরগঞ্জ থানার উঠানে । তবে থেকে থেকে অঙ্গচ্ছেদ হচ্ছিল । হয়তো অন্য গাড়ির ড্রাইভারেরা নিজেদের গাড়িতে স্প্যায়ার পার্টস লাগাতো। এভাবে গাড়িটি ধূলার আস্তরণের নীচে চলে গিয়েছিল । সর্বশেষ যেবার বীরগঞ্জ থানায় গেলাম, নতুন পাকা ঘর হয়েছে । গাড়িটি আর নজরে আসেনি ।

তারপর আরও পনের বছর পুলিশে চাকুরি করেছি । থানায় থানায় এমনি প্রায় হাজারের উপর গাড়ি এবং বাইক পড়ে থাকতে দেখেছি । যেন ধনঞ্জয়ের গাড়ি । প্রতিটির আলাদা আলাদা ইতিহাস । এর বড় অংশ ড্রাগসের মামলায় সীজ করা । দুর্ঘটনার গাড়ি । আদালতে তারিখ পে তারিখ পড়ে । কাঙ্খিত ডিসপোজাল হয় না । দক্ষিণের একটি রাজ্যে এই ধরনের বাজেয়াপ্ত করা গাড়ি মামলা নিষ্পত্তি হওয়া সাপেক্ষ সরকারি কাজে ব্যবহারের রীতি রয়েছে । একবার ত্রিপুরাতেও এই রীতি প্রয়োগের চেষ্টা হয়েছিল । কিন্তু লালফিতার আমলাকান্ত্রিক বাঁধনে আটকে যায় । আমাদের অনেকেরই স্বভাব হচ্ছে কর্তাভজা । সবকিছুর মধ্যেই রাজনীতির রং দেখা হয় । অনেকেই তাই সিদুরে মেঘ দেখেন । সঙ্গে একধরনের নির্মল আনন্দ । আর ধনঞ্জয়ের গাড়িরা দ্রুহকালের অবসানের অপেক্ষায় বসে থাকে ।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.