ঘুড়ি উড়ানোর দিনঃ কিছু স্মৃতি কিছু কথা
শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ
জীবনের গতিপথ আজ বদলে গেছে। এই বদলে যাওয়ার আর এক নামই হয়তো জীবন। আনুষ্ঠানিকতার মোড়কে ঢাকা পড়েছে আবেগ আর উচ্ছ্বাস। মাঝেমধ্যেই তবু মনে পড়ে যায় ছোটবেলার কথা। মনে পড়ে নীল আকাশের বুকে রঙবেরঙের ঘুড়ি উড়ানোর কথা। বুক চিরে যেন বেরিয়ে আসে দীর্ঘনিঃশ্বাস ! সেইসব দিন ! ঘুড়ি উড়ানোর দিন। বিশ্বকর্মা পূজার দিনে আগরতলার আকাশে উড়তো কত ঘুড়ি। এখন বেশির ভাগ সময়ই প্রবাসে দিন কাটে আমার । জানি না বিশ্বকর্মা পূজার সময় আগরতলার আকাশে ঘুড়ি উড়ে কিনা। শুধু জানি একদা এমন দিনে বর্ণিল হয়ে উঠতো আগরতলার আকাশ। রঙে ভরা সেই নীল আকাশ। রায়ট অব কালার্স। মনে হতো কোনও এক অদৃশ্য শিল্পী যেন আপন খেয়ালে নীল ক্যানভাসে এঁকে চলেছেন বিবিধ রঙের অনিন্দ্যসুন্দর কোলাজ। প্রসঙ্গ ক্রমেই বলি, রঙ আমার সব সময়ই ভালো লাগে। রঙের মোহ আমি আজও কাটিয়ে উঠতে পারি নি । আমার যাবতীয় কল্পনার দুয়ার খুলে দেয় রঙ। রঙিন ঘুড়ির আবেশে তাই মুগ্ধ হতাম ছোটবেলা থেকেই। সেই সব দিনে কখনও আবদার করে, কখনও ঠাকুরমার অজান্তেই তাঁর আঁচলে বাঁধা পয়সা খুলে নিয়ে, মায়ের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে পয়সা চুরি করে একছুটে চলে যেতাম দোকানে। ঘুড়ির কাগজ কিনে বাড়ি ফিরতাম। ঘুড়ি বানাতামও নিজেই। ট্যালকম পাউডারের লম্বা টিনের দু প্রান্তে ফুটো করে আড়াআড়ি কাঠি ঢুকিয়ে বানিয়ে নিতাম লাটাই। বেশি পয়সা যোগাড় করতে পারতাম না বলে "আনার"নামে সবচেয়ে কম দামী সুরু সুতো ব্যবহার করতাম। সেই সুরু সুতোয় মাঞ্জা লাগিয়ে ঘুড়ি উড়াতাম। তার আগে অবশ্য মাঞ্জা বানানো, সুতোয় সেই মাঞ্জা লাগিয়ে শুকানো - অনেক ঝামেলা আর হ্যাপা পোয়াতে হতো। নীল আকাশের বুকে ঘুড়ি উড়ানোর তীব্র আকাঙ্খা থেকেই মনের মাঝারে তৈরি হতো এই প্যাশন। সরু সুতোয় ঘুড়ি উড়ানোর ঝামেলাও কম ছিল না। পাড়ার ডাকাবুকো ছেলেরা ব্যবহার করতো কাঠের রীলে জড়ানো বক সুতো। ওই সুতো ছিল নাইলনের মতো শক্ত । দাম বেশি ছিল বলে গোটা ছোটবেলা আমার শস্তা আনার সুতো দিয়েই ঘুড়ি উড়িয়ে দিন কেটেছে। বক সুতোর সঙ্গে আনার সুতোর কোনও কম্পিটিশনই ছিল না। ওরা ছিল এলিট। আকাশ যুদ্ধে সব সময়ই ওদের জিত ছিল অনিবার্য । ওদের সঙ্গে আমি ভোঁ কাটাকাটির খেলায় প্রথমেই হেরে যেতাম। তবু মাঞ্জা জোরদার হলে, বাতাসের বেগ ভালো থাকলে এবং তেমন ভাবে সুতো ছাড়তে পারলে বক সুতো দিয়ে উড়ানো ঘুড়িবাজদেরও বীট করা সম্ভব ছিল এবং সংখ্যায় বেশি না হলেও এক দু'বার আমি ওদের কেটেছি। আগরতলার ভাষায় এক বলে গুড্ডি চৈল' । গুড্ডি মানে ঘুড়ি আর চৈল মানে ভোঁ কাটা। সত্তর দশকে আগরতলার অনেক বাড়িতেই গুড্ডি কোম্পানি গড়ে উঠেছিল। সেই সময় দোকানে রেডিমেড ঘুড়ি কিনতে পাওয়া যেতো না। সবাই নিজের মতো ঘুড়ি বানিয়েই উড়াতো। এরই ,মাঝে কিছু বাড়িতে ঘুড়ি এবং লাটাই বানানো হতো এবং সেসব বিক্রি করা হতো। টুকরা ঠাকুর নামে আমাদের এক প্রতিবেশি বাঁশ দিয়ে অদ্ভুত সুন্দর সব লাটাই বানাতেন। আমার বেশি পয়সার সংস্থান ছিল না। তাই সেসব সুন্দর লাটাই দিয়ে ঘুড়ি উড়ানো হয় নি কখনও। লাটাইগুলির সৌন্দর্য দেখেই শুধু তৃপ্ত হতাম । আর পাড়ারই আর একজন প্রতিভাধর দাদা কাজল দা যিনি জুলিয়াস নামে বেশি পরিচিত ছিলেন তিনি নিজেই ইনোভ্যাটেভলি অসম্ভব সুন্দর সব ঘুড়ি বানাতেন। মুগ্ধ হয়ে দেখতাম কাজল দা'র বানানো সব ঘুড়ি । আর তখন আগরতলার ঘুড়িগুলির নামেও কম বৈচিত্র্য ছিল না ! দবাজ, চম্পাকলি, পরমহংস, চকরি, পঙ্খিরাজ, দৈখল - এমন আরও কিছু। বাকিগুলির নাম মনে করতে পারছি না। আগরতলায় ঘুড়িগুলির এমন নামকরণের কারণ জানতে পারি নি । তবে ঘুড়িগুলির মতোই ওই মোহময় কাব্যিক নামগুলিও আমার বালক মনে ঝঙ্কার তুলেছিল। আগরতলার আকাশ তখনও বহুতল বাড়ির গহিনতায় আকীর্ণ হয় নি। মানুষের বাড়িঘর ভাগাভাগি হয়ে এতোটুকুন হয় নি। প্রায় সবার বাড়িতেই পুস্প শোভিত বাগান ছিল । সুরভিত ফুলের সমাহার ছিল। আগরতলার বিকেল তখন পুষ্প সৌরভে হয়ে উঠতো অনন্যসাধারণ। তারই মাঝে ওই ঘুড়ি উড়ানো সুবাসিত বিকেল । অনেক গম্ভীর প্রকৃতির বয়স্ক মানুষও মুগ্ধ বিস্ময়ে আকাশে ঘুড়ির খেলা দেখতেন । মাইকে গান বাজানর চল ছিল সেই সময়ে। মাইকের আওয়াজ এমনই উচ্চগ্রামে বাঁধা যে কেউ তা বাজালে তা ছড়িয়ে পড়তো প্রায় পুরো আগরতলায়। শব্দ দূষণের বিধি তখনও বলবৎ হয় নি । সৌভাগ্যবশত, তারস্বর সত্বেও মাইকে বাজানো সেসব গান ছিল আক্ষরিক অর্থেই শ্রুতি মধুর ! বাজতো ১৯৫৭’র ফিল্ম ভাবী’র একটি জনপ্রিয় গান, ‘’ ‘’চলি চলি রে পতং / মেরি চলি রে/ চলি বাদলোঁ কে পার /হো কে দোর পে সওয়ার/ সারি দুনিয়া / ইয়ে দেখ দেখ / জলি রে / চলি চলি রে পতং /মেরি চলি রে’’। ... সে এক সময় ছিল বটে। তারপর বহু কিছু পালটে গেছে। জেট সেটের গতিতে দৌড়েছে আমাদের জীবন । ধীরে ধীরে কখন যেন আবেগের রঙও ফিকে হয়ে গিয়েছিল বুঝতে পারি নি। তবে সত্যিই কী আর সব রঙ পুরো ফিকে হয়ে যায় ! না, কিছু হলেও থেকে যায়। রয়ে যায় মনেরই মণিকোঠায় । রাজস্থানে যখন পর্যটন মন্ত্রকের অধিকর্তা হিসেবে জয়েন করেছিলাম - সেখানে তখন পতং উৎসব অর্থাৎ ঘুড়ি উৎসবের সময় খুবই এনজয় করতাম। পতং উৎসব সেখানে খুবই জাঁকজমক সহকারে করা হয়। তবে ওদের উৎসবের দিনক্ষণ আলাদা। মকর সংক্রান্তির দিনে পালিত হয় এই উৎসব। আকাশটা তখন ছেয়ে রয় ঘুড়ি আর ঘুড়িতে ! পতং উৎসব তো নয় - এ যেন আকাশ জোড়া জমাটি রঙের উৎসব। কী যে ভালো লাগে বলে বোঝাতে পারবো না। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে । পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তরফেই সেবার জয়পুরের কার্যালয় থেকে আমরা পতং উৎসবের আয়োজন করেছিলাম। পেয়েছিলাম ফের সেই ঘুড়ি উড়ানোর মওকা। আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে এসেছিলেন রাজস্থানের তৎকালীন পর্যটন মন্ত্রী এবং বলিউড অভিনেত্রী বীণা কাক। ঘুড়ি উড়িয়েছিলেন সেদিন তিনিও । সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন ছোটবেলায় ঘুড়ি উড়ানোর শখ ছিল তাঁরও । বূঝতে পেরেছিলাম, জীবনের পথে চলতে গিয়ে আবেগের রঙ যতই ফিকে হয়ে যাক না কেন - কিছুটা তবু থেকে রয়ে সারা জীবনের জন্য । আমাদের সবার ক্ষেত্রেই এই কথা প্রযোজ্য । এটাই হয়তো আমাদের মতো মানুষের সারা জীবনের মহার্ঘ্য সঞ্চয়।