ককবরকঃ লিপি বিতর্ক এবং কিছু কথা

শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ

ককবরক ভাষার লিপি বিতর্কে ফের অশান্ত হয়ে উঠেছে ত্রিপুরা। লিপি বিতর্ক নিয়ে রাজনৈতিক তরজায় লাভ হচ্ছে না কারোরই । লিপি জনিত সমস্যাটিই বরং ঝুলছে বছরের পর বছর। এই সমস্যার আশু সমাধান তাই জরুরী। জরুরী এই কারণেই - যে ভাবে ইস্যুটিকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে পাশা খেলা চলছে তাতে রাজ্যের শান্তি সম্প্রীতির বাতাবরণ নষ্ট হতে পারে। আশঙ্কার কারণ এখানেই। বাংলা হোক অথবা দেবনাগরী কিম্বা রোমান - ককবরকের লিপি নিয়ে পক্ষে বিপক্ষের মতামত শুনে বুঝতে পারি উভয়ের যুক্তিই সঙ্গত; আবার উভয়ের যুক্তিও খণ্ডনযোগ্য। ডিসাইসিভ অর্থাৎ চূড়ান্ত তথ্য এবং তত্ব সহকারে কোনও পক্ষই দৃঢ়তার সঙ্গে বুঝিয়ে বলতে পারছে না ককবরকের জন্য কেন একটি নির্দিষ্টই লিপিই সুপ্রযুক্ত। গোটা বিষয়টাই যেন পলিটিক্যাল এজেন্ডা ফুলফিলমেন্টের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ককবরকের জন্য এক সময় বাংলা লিপির পক্ষে সওয়াল করেছিলেন তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী দশরথ দেব । আজ বাংলা লিপির সপক্ষে তেমন আর কেউ বলছে না। পরিবর্তিত সময়ে মুখ্য হয়ে উঠেছে দেবনাগরী বনাম রোমান লিপি বিতর্ক। প্রসঙ্গত বলি দেবনাগরীর উৎসমূলে রয়েছে ব্রাহ্মী লিপি। ব্রাহ্মীর উদ্ভব ঘটেছিল অ্যাফ্রো- এশিয়ান সেমিটিক ভাষার লিপি থেকে। হিব্রু, আরামাইক, আরবী এবং আহমারিক ভাষাকে বলা হয় অ্যাফ্রো - এশিয়ান ফ্যামিলি ল্যাঙ্গুয়েজ। আবার আমরা আজ ইংরেজি লিপি বলে যা জানি সেই রোমান লিপিরও উদ্ভব ঘটেছিল অ্যাফ্রো - এশিয়ান ফ্যামিলি ল্যাঙ্গুয়েজ থেকেই। রোমান লিপি ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কোনও এক সময়ে ইতালির এট্রুস্কান বর্ণমালা থেকে বিকশিত হয়েছিল। এই এট্রুস্কান লিপির মূল উৎসে কিন্তু ছিল সিরিয়া এবং ফিলিস্তিনে প্রায় ১১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যবহৃত উত্তর সেমিটিক বর্ণমালা। রোম তখন অ্যাফ্রো – এশিয়ার এই অঞ্চলে সাম্রাজ্য বিস্তারে সমর্থ হয়েছিল । ল্যাতিন ভাষার মাধ্যম হিসেবে সেই সময় থেকেই উত্তর সেমিটিক বর্ণমালা ব্যবহার শুরু করেছিল রোমানরা ।

ব্রাহ্মী এবং রোমান লিপির উদ্ভব স্থল তাই প্রায় একই এবং বিকশিত হওয়ার সময়ও প্রায় এক । এই দুই লিপিরই বিকাশ ঘটেছিল ৮০০ থেকে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রাহ্মী থেকে উদ্ভূত দেবনাগরী লিপি হয়ে উঠে সংস্কৃত ভাষার মাধ্যম আর ওদিকে রোমান হয়ে উঠে ইংরেজি সহ ইউরোপীয় ভাষার মাধ্যম। মজার কথা হচ্ছে, সংস্কৃত আর ল্যাতিন ভাষার মিলও রয়েছে আশ্চর্য রকমের। আজ ভারতে আর্য তত্ব নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক চলছে। আর্যরা কি বহিরাগত না ভারতের - এ বিষয়ে কোনও আলোচনায় যাচ্ছি না। তবে সংস্কৃত আর ল্যাতিন যে একই ভাষা গোষ্ঠী সম্ভূত এ বিষয়ে কোনও বিসম্বাদ নেই। সংস্কৃত থেকে উদ্ভব অসমীয়া, বাংলা, ওড়িয়া সহ উত্তর ভারতের ভাষাগুলির বিভিন্ন মূল শব্দ যেমন এক, তেমনই সংস্কৃতের সঙ্গে সাদৃশ্য যুক্ত ল্যাতিন থেকে উদ্ভব ইংরেজি সহ ইউরোপের বিভিন্ন ভাষাগুলির মূল শব্দাবলীও একই রয়ে গিয়েছে। এমন অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে তাৎক্ষনিকভাবে একটি বেছে নেওয়া যেতে পারে। বুঝিয়ে দেওয়া যেতে পারে এই দুই প্রাচীন ভাষার একীভূত উৎসের কথা। ল্যাতিন ভাষায় যখন দাঁত’কে বলা হয় dēns, dentis, dentī, dentem , সংস্কৃতে তখন তা উল্লিখিত হয় dán, datás, daté, dántam নামে। অর্থাৎ ল্যাতিনে যা dentem, সংস্কৃত তাই dántam। ১৭৮০’এ সংস্কৃত এবং ল্যাতিনের মধ্যে স্যর উইলিয়াম জোন্স যে সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছিলেন তা ইন্দো-ইয়োরোপিয়ান ভাষাগত ইতিহাস বুঝতে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল।

তবে ভারতকে শুধুই ইন্দো-ইয়োরপিয়ান ভাষাগত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করাটাও মস্ত ভুল। সত্যি কথা বলতে কী, ১৭৮০’র পর ব্রিটিশ রাজ ভারতে আর্য তত্ব খুব জোর শোরে প্রচার করতে শুরু করেছিল। এই প্রচারের পেছনে মূলোদ্দেশ্য ছিল একটাই; আর সেই উদ্দেশ্য ছিল প্রাচীন সভ্যতা বিরহিত ভারত আসলেই এক অসংস্কৃত দেশ। আর্যরা আসার বিকশিত হয় ভারত ! এমন অপপ্রচারের সময় চেপে যাওয়া হয়েছিল দক্ষিণ ভারতের সমৃদ্ধ দ্রাবিড় সভ্যতা আর সঙ্গম ভাষার কথা। দ্রাবিড় ভাষা কিন্তু সংস্কৃতের থেকেও প্রাচীন। পাশা উল্টে গিয়েছিল ১৯৩০ দশকের প্রারম্ভে। হরাপ্পা মহেঞ্জোদারো’র ধ্বংসস্তূপ আবিস্কারের পর জানা গিয়েছিল ভারতীয় সভ্যতার প্রাচীনত্ব। জানা সম্ভব হয়েছিল মিশরীয় সভ্যতা, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা কিম্বা গ্রীক অথবা রোমান সভ্যতার মতোই ভারতীয় সভ্যতাও কত প্রাচীন। বন্ধ হয়েছিল ইংরেজ শাসকদের অপপ্রচার।

কিন্তু উপমহাদেশের এই সম্পূর্ণ আখ্যানে কিরাতভূমি বলে খ্যাত অঞ্চলের পুত্রকন্যা ত্রিপুরিদের স্থান কোথায় ! ত্রিপুরিরা আর্য কিম্বা দ্রাবিড় নয়। ত্রিপুরিদের পূর্বজেরা মূলত পশ্চিম চীনের ইয়াংজি কিয়াং এবং হোয়াং হো নদীর উপরের ধারার কাছাকাছি থেকে নেমে এসেছিল অসমের বরবক্র নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে। স্যুই রাজবংশ (৫৮১–৬১৮) ক্ষমতায় আসার অনেক আগেই চীন ত্যাগ করেছিল তারা। আজ ত্রিপুরিদের ভাষা ককবরকে রয়েছে টিবেটো-বার্মিজ ভাষার প্রভাব। ককবরকের সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে অসমের বোড়ো, দিমাসা এবং মেঘালয়ের গারো ভাষার। এক সময়ে হয়তো এরা একই জনগোষ্ঠী ছিল। পরবর্তীকালে বিভক্ত হয়ে যায় সম্ভবত।

১৮ শতকে হিমালয় এবং উত্তরপূর্ব ভারতের পার্বত্য প্রদেশে বাসরত জনজাতিদের ভাষার কথা বলতে গিয়ে ইংরেজরা টিবেটো-বার্মিজ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছিল। এই শব্দবন্ধের উদ্ভাবক জেমস লোগান। ১৮৫৬’এ তিনিই প্রথম ‘টিবেটো-

বার্মিজ’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেছিলেন। আসলে এই টিবেটো-বার্মিজের মূল উৎসে রয়েছে দক্ষিণ পশ্চিম চিনের প্রাচীন ভাষা। উত্তরপূর্ব ভারতের অনেক পার্বত্য জনজাতির ভাষার মতো ত্রিপুরি ভাষা ককবরকেও এমন কিছু বেসিক ওয়ার্ডস বা মূল শব্দ রয়েছে যা চিনা ভাষার শব্দের সঙ্গে আশ্চর্যরকম ভাবে মিলে যায় !

প্রাচীন ভাষা ককবরকের লিপি কী সত্যি কখনই ছিল ! এর সদুত্তর এই সময়ে কোনও ভাষাবিদের পক্ষেই দেওয়া হয়তো সম্ভব নয়। বলা হয় ‘কলমা’ নামে ককবরকের লিপি এক সময় ব্যবহৃত হতো। দুর্লভ চন্তাই নাকি কলমা লিপিতেই ত্রিপুরি রাজবংশের ইতিবৃত্ত ‘রাজরত্নাকর’ লিখেছিলেন। পরে ১৪ শতকে সেই ‘রাজরত্নাকর’এর বঙ্গীয় সংস্করণ ‘রাজমালা’ নামে বের করেন শুক্রেশ্বর এবং বাণেশ্বর এই দুই পণ্ডিত। কলমা লিপি যদি থাকতোই তবে তা লুপ্ত হল কী ভাবে - সেও এক প্রশ্ন। এখানে আরও একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়। ককবরকের সঙ্গে সাদৃশ্য যুক্ত বোড়ো, দিমাসা , গারো ভাষারও কিন্তু হরফ নেই বলে সেইসব ভাষার জন্য লিপি হিসেবে দেবনাগরী, বাংলা এবং রোমান ব্যবহৃত হয়। বোড়ো ভাষার জন্য ব্যবহৃত হয় রোমান লিপি। আগে গারো ভাষার জন্য বাংলা লিপি ব্যবহৃত হতো। এখন বাংলার পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে রোমান। বোড়ো, দিমাসা , গারো ভাষার নিজস্ব লিপি থাকলে থাকলে ককবরকেরও লিপি সমস্যার কিছু সুত্র অবশ্যই পাওয়া যেতো। আর যদি থাকতোই তার পরিণতি মণিপুরে সেই ভয়ঙ্কর লিব্রিসাইড অর্থাৎ পুস্তক ধ্বংসের মতো হয় নি তো ! ১৭২৬’এ মণিপুরের মহারাজা পামহেইবা বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর বাংলাকে রাজভাষা করার জন্য প্রাচীন মৈতেই মায়েক লিপিতে লেখা সব পুঁথিপত্র পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। এর ফলে মায়েক লিপি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। পঞ্চদশ শতকে রাজন্য ত্রিপুরায় এ রকম কোনও ঘটনার কথা অবশ্য জানা যায় নি। তবে ওই শতকে মহারাজা রত্নমাণিক্যের আমল থেকেই ত্রিপুরার রাজকার্যে বাংলাভাষার প্রয়োগ শুরু হয়েছিল। মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের ( ১৮৬২ - ১৮৯৬ ) আমলে বাংলা শুধু রাজকার্যে নয় - রাজ পরিবারেরও ভাষা হয়ে উঠেছিল। মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য বাংলাতেই হোরিগান লিখেছিলেন। স্বজনদের চিঠিপত্রও লিখতেন বাংলাতেই। ইংরেজদের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করেই পরবর্তী তিন মহারাজার আমলেও অক্ষুণ্ণ রয়ে যায় বাংলার ধারাবাহিকতা । মাঝখানে কিছু মন্ত্রী অমাত্য রাজকার্যে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার শুরু করায় বিরক্ত হয়েছিলেন মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোর। রাজকার্যে যাতে শুধু বাংলাই ব্যবহৃত হয় - সে বিষয়ে এক অধ্যাদেশও জারি করেছিলেন তিনি । পঞ্চদশ শতকের শেষার্ধ থেকে রাজন্য ত্রিপুরার আদেশনামা, দলিল দস্তাবেজ, মুদ্রায় বাংলা লিপি ব্যবহৃত হতে থাকে । এদিকে ককবরক ভাষার গুরুত্ব ক্রমে হ্রাস পেতে থাকে ত্রিপুরি রাজ পরিবারে। তবু শোনা যায়, রাধা কিশোর মাণিক্য নাকি ককবরক ভাষা বেশ ভালোই জানতেন। তিপ্রা – বাংলার অভিধান নিয়ে নাকি ১৮৭৫ – ১৮৭৬'এ কাজও করেছিলেন। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক তিনি সেই বই প্রকাশ করেন নি। বই লেখায় কী লিপিই বা তিনি ব্যবহার করেছিলেন - তাও জানা আর সম্ভব হয় নি।

উল্লেখ্য যে, মহারাজা বীরচন্দ্রের আমলেই রাজন্য ত্রিপুরার বিচার বিভাগের প্রধান এবং রাজকীয় ত্রিপুরার সৈন্য বাহিনীর প্রধান রাধামোহন ঠাকুর ককবরকের পুনরুজ্জীবনের জন্য চেষ্টা করেছিলেন। রচনা করেছিলেন ককবরকের ব্যাকরণ। ত্রিপুরি ভাষাকে ককবরক হিসেবে নামকরণও সম্ভবত তাঁরই। কক অর্থ "ভাষা" আর বরক অর্থ "মানুষ", অর্থাৎ ককবরক কথাটির অর্থ ত্রিপুরি মানুষের ভাষা। তবে তাঁর রচিত 'ককবরকমা' (১৯০০) প্রকাশের আগেই বছর তিনেক আগে অর্থাৎ ১৮৯৭'এ বের হয়ে গিয়েছিল দৌলত আহমেদের রচিত ককবরমা বইটি। ঠাকুর রাধামোহন দেববর্মণ এবং দৌলত আহমেদ ককবরকের ব্যাকরণ গ্রন্থ প্রণয়ন করেছিলেন বাংলা লিপিতে। রোমান হরফে ককবরক লেখার কথা সেই সময় কেউ ভাবেন নি। বাংলা ভাষা এবং বাংলা লিপিরই তখন চল। তবে চিত্তাকর্ষক বিষয় হল, উজ্জ্বয়ন্ত রাজপ্রাসাদের গ্রন্থাগারে রক্ষিত বিভিন্ন প্রাচীন পুস্তকাদি ঘাঁটলে দেখা যায় বইগুলির মার্কিং করা হয়েছে এক রহস্যময় লিপিতে ! এই লিপি কী খরোষ্ঠী না ব্রাহ্মী না অন্য কিছু - আজ তা হলফ করে বলা সম্ভব নয়। দেখেশুনে শুধু এই কথাই মনে হয়, রাজ অন্দর মহলে কিছু ব্যক্তি বা রাজ কর্মচারী হয়তো একটা গুপ্ত লিপি জানতেন এবং চর্চা করতেন।

বিংশ শতকের শেষার্ধে ভাষাবিদ কুমুদ কুণ্ডু চৌধুরী ককবরক ভাষার উন্নয়ন এবং প্রসারে বেশ কিছু প্রশংসনীয় কাজ করে গিয়েছেন। তিনিও কিন্তু লিখেছিলেন বাংলা লিপিতেই। ককবরকের লিপি পুনরাবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়েছিলেন অলিন্দ্রলাল ত্রিপুরা। লিপিও নাকি তৈরি করেছিলেন। কিন্তু তাঁর উদ্ভাবিত লিপি কেন ত্রিপুরি সমাজে গৃহীত হল না - বোঝা যায় নি। সাঁওতালি জনগোষ্ঠীরও লিপি ছিল না। ১৯২৫’এ ময়ুরভঞ্জ জেলার কবি রঘুনাথ মুর্মূ সৃষ্টি করেন অলচিকি লিপি। ১৯৩৯’এ সর্ব সমক্ষে প্রথমবারের মতো তিনি তাঁর উদ্ভাবিত লিপি প্রচারিত করেন। অলচিকি আজ সাঁওতালি ভাষার নিজস্ব এবং প্রধান লিপি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে সাঁওতালি ভাষার জন্য লিপি হিসেবে অলচিকির পাশাপাশি বাংলা, ওড়িয়া, রোমান এবং দেবনাগরীতেও এই ভাষার লিখন বহাল রয়েছে। ককবরকের জন্য আজ যারাই বাংলা, দেবনাগরী অথবা রোমান লিপির হয়ে সওয়াল করছেন তাদের বক্তব্যের পক্ষে যেমন যুক্তি রয়েছে তেমনই বিপক্ষেও রয়েছে যথেষ্ট যুক্তি। একটি নির্দিষ্ট লিপিকে গ্রহণ করলেই ককবরক সঠিক ভাবে লেখা সম্ভব হবে এবং উচ্চারণে সুবিধা হবে - এ কথা আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। টিবেটো-বার্মিজ হলেও সব লিপিতেই ককবরক সঠিক ভাবে লেখা এবং উচ্চারণ করা অসম্ভব কিছু নয়।

মোদ্দা কথা হচ্ছে কোন লিপি গ্রহণ করলে সামগ্রিক ভাবে ককবরক ভাষা ভাষীর লাভ হবে আখেরে ভেবে চিন্তে দেখতে হবে সেই বাস্তব দিকটাই। পঞ্চদশ শতকে ত্রিপুরার মহারাজা রত্নমাণিক্য বাংলাকে রাজভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন

ভৌগলিক এবং অর্থনৈতিক কারণে। এর পেছনে বাংলার প্রতি আলাদা কোনও ভালোবাসা ছিল না অবশ্যই। তখনও রাজন্য ত্রিপুরার প্রায় তিনদিকেই ছিল বৃহত্তর বাংলা। ত্রিপুরার মতো রাজ্যে শান্তি আর সমৃদ্ধির স্বার্থে সম্পদশালী বাংলার সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। বাংলার বদলে ভৌগলিক ভাবে যদি পঞ্জাব কিম্বা কর্ণাটক রাজন্য ত্রিপুরার সীমান্ত সংলগ্ন হতো তবে নিশ্চিত ওই সমৃদ্ধ দুই রাজ্যের একটির অবশ্যই ভাষাগত প্রভাব পরিলক্ষিত হতো এই রাজ্যে। বাংলার পরিবর্তে রাজন্য ত্রিপুরার ভাষা এবং লিপি হয়তো হতো পঞ্জাবি কিম্বা কন্নাদ ! পঞ্চদশ শতকে বাংলাকে রাজকার্যে ব্যবহার করার পেছনে ছিল মহারাজার বাস্তব বোধ।

আজ এই সময়ে ত্রিপুরার লিপি নিয়েও সেই বাস্তব বোধকেই প্রাধান্য দেওয়া দরকার। পঞ্চদশ শতকে গাঙ্গেয় উপত্যকা এবং ত্রিপুরার যে অবস্থা ছিল আজ তা আর নেই। বদলছে অনেক কিছুই। নতুন সময়ের প্রেক্ষিতে নতুন ভাবেই সব কিছু চিন্তাভাবনা করা দরকার। একটি বিশ্বজনীন ভাষা গড়ে তোলার জন্য ১৮৮৭'এ এল এল জামেনহফ এসপারেন্তো নামে সহজবোধ্য নতুন ভাষা সৃষ্টি করেছিলেন। এসপারেন্তো সাম্প্রতিক কালে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। হাঙ্গেরি এবং চিনের কিছু স্কুলে এস্পারেন্তো শেখানো হয়। তবে কোন দেশেই সরকারি ভাষা হিসেবে এখনও স্বীকৃত হয় নি। এখন স্বীকৃত না হলেও আগামী দিনে এসপারেন্তো হয়তো বিভিন্ন দেশে সরকারি ভাষা হিসেবে নিশ্চয় স্বীকৃতি পাবে। লক্ষণীয় যে এসপারেন্তো'রও লিপি কিন্তু রোমান।

এসপারেন্তো হোক আর না হোক – এই সময়ে ভাষা হিসেবে ইংরেজি যে বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছে এই বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। আজ বিশ্বের ৮৬টি দেশে প্রথম অথবা দ্বিতীয় সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজি ব্যবহৃত হচ্ছে। ইংরেজিকে গ্লোবাল ল্যাঙ্গুয়েজ অথবা বিশ্বভাষা বলতে তাই কারোর আপত্তি থাকার কথা নয়। সঙ্গত কারণেই ওইসব দেশে ইংরেজি ভাষার অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে রোমান লিপি। সব মিলিয়ে রোমান লিপি ব্যবহার করছে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ। হিন্দির পাশাপাশি ইংরেজি আমাদের দেশেও লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কার কাজ করছে। মিজোরামের লোক তামিলনাড়ুতে গিয়ে ইংরেজিতেই কথা বলে কাজ চালিয়ে নেন। একই রকম ভাবে কাশ্মীরের লোক নাগাল্যান্ডে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে ইংরেজিতেই কথা বলেন। দেশে তাই ইংরেজি ভাষার প্রচার এবং প্রসারের ফলে প্রাদেশিক ভাষার গুরুত্ব কমছে। অন্যান্য প্রদেশের মতো খোদ বাঙালিদের ঘর, পরিবারেও আজ বাংলার পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে ইংরেজি। এই প্রবণতা ভালো কী মন্দ - সে ভিন্ন কথা এবং পরে এ বিষয়েও অন্য কোনও নিবন্ধে বিস্তৃত আলোচনার ইচ্ছে রইল। উল্লেখ্য, বাংলা বলতে পারলেও পড়তে কিম্বা লিখতে পারেন না অথচ পশ্চিমী শিক্ষায় দুরস্ত এমন বাঙালিদের জন্য বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদী সৃষ্টিগুলি পড়ানোর সুযোগ করে দেওয়ার একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন বহির্বঙ্গ আন্দোলনের পুরোধা প্রয়াত অরুণ চক্রবর্তী । তিনি এনবিটিআই'র (ন্যাশনেল বুক ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া) মাধ্যমে নির্বাচিত বাংলা সাহিত্যের বইগুলি রোমান লিপিতে ছাপার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর সেই উদ্যোগ সফল হয়েছিল কিনা জানি না। তবে তাঁর এই বাস্তবোচিত উদ্যোগটি অবশ্যই প্রশংসনীয় ছিল।

সব কিছু তুল্যমূল্য বিচার করার পর এহেন বাস্তবতার নিরিখে ককবরক ভাষার লিপি হিসেবে রোমান হরফ বেছে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। এতে ভালো বই খারাপ কিছু হওয়ার কথা নয়। অধিকাংশ ত্রিপুরিও ককবরকের জন্য রোমান হরফই চাইছে। আগে বিভিন্ন সময়ে ককবরকের লিপি ঠিক করে নেওয়ার জন্য ত্রিপুরায় একাধিক ভাষা কমিশন গঠিত হয়েছিল । তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল শ্রদ্ধেয় ডঃ পবিত্র সরকারের নেতৃত্বে গঠিত ভাষা কমিশন। ডঃ পবিত্র সরকারের নেতৃত্বাধীন ভাষা কমিশন কিন্তু ককবরকের লিপি নির্বচনে জনগণের সিদ্ধান্তকেই মান্যতা দিয়েছিল। তার মানে পরোক্ষ ভাবে এই কমিশন ককবরকের জন্য সায় দিয়েছিল রোমান লিপিকেই। শুনেছি, বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ককবরক ভাষার লিপি হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে রোমান। উপমহাদেশের বাংলা, দেবনাগরী লিপির সঙ্গে ককবরকের কোথাও কোনও নূন্যতম যোগসূত্র নেই। যোগসূত্র নেই সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারের লিপি রোমানের সঙ্গেও । তবু কেন রোমানের কথা বলl হচ্ছে ! আসলে বাস্তবতাকে অস্বীকার করে লাভ নেই। রোমান লিপি ব্যবহার করলে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া সহ বিশ্বের অন্যান্য স্থানে বসবাসরত বরাক জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন সম্ভব হবে। সহায়ক হবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের জনগোষ্ঠীর চিন্তা ভাবনার শরিক হওয়া। সম্ভব হবে জ্ঞান বিজ্ঞানের আদান প্রদান । বাংলা কিম্বা দেবনাগরী লিপির মাধ্যমে এই বৈশ্বিক সংযোগ স্থাপন সম্ভব নয়। আমাদের পুরাণ, মহাকাব্য, সংস্কৃত ধ্রুপদী সাহিত্য দেবনাগরীতেই লিখিত হয়েছে। কিন্তু দেবনাগরী লিপির প্রতি আমার সবিশেষ দুর্বলতা সত্বেও ককবরকের জন্য আমি এই সময়ে রোমান লিপি ব্যবহার করাই বিধেয় মনে করি। পঞ্চদশ শতকে যে বাস্তবতার প্রেক্ষিতে ত্রিপুরার মহারাজা রত্নমাণিক্য রাজকার্যে বাংলার ব্যবহার শুরু করেছিলেন - সেই একই কারণে আজ ককবরক ভাষার জন্য লিপি হিসেবে রোমানকে বেছে নেওয়া উচিত।

তবে রোমান লিপি কিন্তু প্যানাসিয়া অর্থাৎ সর্বরোগহরকারী একমাত্র মোক্ষম দাওয়াই নয়। ককবরকের জন্য রোমান লিপি গ্রহণ করলেই ত্রিপুরি সমাজে আর কোনও সমস্যা থাকবে না অথবা ত্রিপুরি সমাজে সমৃদ্ধির ঢল নামবে - মোটেও এমনটা নয় কিন্তু। তাই যদি হতো তবে তো উত্তরপূর্ব ভারতে রোমান লিপি ব্যবহার কারী ত্রিপুরার প্রতিবেশি কয়েকটি রাজ্যে কোনও রকম অশান্তির নামগন্ধও থাকতো না। দুধ আর মধুর বন্যায় ভাসতো সে সব রাজ্য। রোমান লিপিকে কোনও একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের এজেন্ডা বাস্তবায়ায়িত করার লক্ষ্যেই যদি ব্যবহার করার চেষ্টা হয় -

তবে ত্রিপুরি সমাজের বিশেষ অগ্রগতি হবে না। বিদেশি সংস্কৃতির প্রচার প্রসারের লক্ষ্যে রোমান লিপির অপব্যবহার যাতে না হয় - সতর্ক থাকতে হবে সে বিষয়ে। রোমান লিপির মাধ্যমে শিক্ষাদীক্ষা, ত্রিপুরি এবং ভারতীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের

কথাই নতুন প্রজন্মের মধ্যে ব্যাপ্ত করতে হবে। নতুন ত্রিপুরি প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আত্মমুখিনতার পরিবর্তে ত্রিপুরি সমাজ যাতে আরও বেশি করে জাতীয় স্তরে অংশ গ্রহণের সুযোগ পায় - লক্ষ্য রাখতে হবে সেদিকেও। শিক্ষাদীক্ষার প্রসারে রোমান লিপিকে ব্যবহার করতে হবে এমন ভাবে যাতে নতুন ত্রিপুরি প্রজন্ম এই বোধে উদ্দীপ্ত পারে যে, প্রতীচ্যের তুলনায় প্রাচ্যের দেশ ভারত সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যে অনেক সমৃদ্ধ। উত্তরপূর্ব ভারতের কয়েকটি রাজ্যে ঘোরাঘুরি করার সুবাদে লক্ষ্য করেছি যে, ওখানকার মানুষজনের মনে কিছু ভ্রান্ত ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে। পশ্চিমী সভ্যতা, কৃষ্টি এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে ওরা যেমন উচ্চ ধারণা পোষণ করে - নিজেদের দেশ হওয়া সত্বেও ভারত সম্পর্কে তেমন কিছু ওরা ভাবে না। বরং নিজেদের দেশ সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই যেন ওরা পোষণ করে। এমন উদাহরণের সংখ্যা নেহাৎ কম না ! ত্রিপুরি সমাজে রোমান লিপি যাতে সদর্থক ভাবে ব্যবহৃত হয় সেই ব্যাপারে সবারই যত্নবান হতে হবে।

পরিশেষে এ কথাই বলি, রোমান লিপি গৃহীত হলেও ককবরক ভাষার নিজস্ব লিপি সৃষ্টি বা উদ্ভাবনের জন্য কিন্তু নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে। ভাবী প্রজন্মের জন্যই এই কাজটি করতে হবে। নইলে জাতি হিসেবে ত্রিপুরিদের মৌলিকত্ব আর রইল কোথায় ! প্রাচীন জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃত ত্রিপুরিরা সর্বার্থেই মেধাবী এবং স্বতন্ত্র। এই স্বতন্ত্রতাই ত্রিপুরিদের স্বাভিমান এবং অহংকার। তাই ধার করা লিপির পরিবর্তে নিজস্ব লিপি গড়ে তোলা দরকার। অনেকেই বলেছেন অচাইরা নাকি ককবরকের প্রাচীন লিপি সম্পর্কে অবহিত এবং বংশানুক্রমে তারা সেই লিপিকে সযত্নে সংরক্ষণ করে চলেছেন । অচাইরা নাকি বিভিন্ন ত্রিপুরি ধর্মীয় রীতি পদ্ধতি এবং পূজাপাঠে ব্যবহৃত সেই লিপি-জ্ঞান অন্য কারোর সঙ্গে ভাগ করে নিতে চান না ! তা-ই যদি হয়, বৃহত্তর স্বার্থে কিন্তু অচাইদের এগিয়ে আসা উচিত উচিত এবং সেই গুপ্ত লিপি-জ্ঞান সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া দরকার। বিষয়টি নিয়ে ভাবা উচিত ভাষাবিদ এবং গবেষকদেরও। তবে যতদিন পর্যন্ত সর্বজনগ্রাহ্য লিপি উদ্ভাবিত না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত ককবরকের জন্য রোমান লিপির ব্যবহার চলতে থাকুক।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.