দুই মলাটে লুপ্তপ্রায় বিয়ের গীত
পান্নালাল রায়।
লুপ্তপ্রায় সংস্কৃতিকে দুই মলাটে ধরে রাখার প্রচেষ্টা খুবই প্রশংসনীয়।এর মাধ্যমে আমাদের উজ্জ্বল অতীতের ঠিকানায় পৌঁছতে পারবে ভবিষ্যত প্রজন্ম।এ ধরণের উদ্যোগ আরও গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে,যে মাধ্যমে লুপ্ত প্রায় সংস্কৃতিকে ধরে রাখা হচ্ছে তার ভবিষ্যত নিয়েও আজ অনেকে সন্দিহান।অনলাইনের দাপটে কাগজ-কলম,বইপত্র ইত্যাদি শেষপর্যন্ত টিঁকে থাকবেতো?
একদিন পাথরের বুকে ছবি এঁকে মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করতো,মেতে উঠতো সৃষ্টির আনন্দে।পর্যায়ক্রমে এল লিপি, লেখ্য রূপে প্রকাশ পেল তার ভাব-ভাষা।প্রস্তরলিপি-তাম্রলিপির পর এল কাগজ-কলম,বইপত্র...। ক্রমে ক্রমে সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়ে এগিয়ে চলল মানুষ।কিন্তু মুদ্রণ মাধ্যমের অভাবনীয় অগ্রগতির যুগেও সুদূর অতীতের শিলালিপি কিংবা তাম্রলিপি রয়ে গেল অতীব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে।আমাদের অতীত ইতিহাসের অন্যতম নির্ভরযোগ্য উপাদান হয়ে থাকল সেসব।তেমনই অনুমিত হয়,আগামী দিনেও বইপত্রের গুরুত্ব অপরিসীম থাকবে।অনলাইনের ব্যবহার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা...এগিয়ে যেতে যেতেও মানুষকে মাঝে মাঝে পেছনে ফিরে তাকাতেই হবে।ভবিষ্যতের জন্যই প্রয়োজন হবে অতীতের। তখনই বইপত্র হবে আলোক স্তম্ভ।আমাদের হারিয়ে যাওয়া নানা সম্পদ সম্ভাবনার সন্ধান দেবে বই।
আমাদের ঐতিহ্য মন্ডিত লোকসংস্কৃতি আজ লুপ্ত হবার পথে।একদা বিয়ের মতো আমাদের নানা সামাজিক অনুষ্ঠান ঘিরে ছিল নানা গীত-নৃত্য,লৌকিক আচার।কিন্তু সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের পরিবর্তে আজ মঞ্চ,রেডিও-টিভি-সিনেমা আর শুধু বইপত্রেই যেন তা টিঁকে আছে বললে ভুল বলা হবেনা।গ্রামাঞ্চলে যদিও বা কখনও সেসবের কিছু কিছু দেখা যায়, শহরে কিন্তু তার দেখা মেলা ভার।এরকম হারিয়ে যাওয়া বিয়ের নানা গীত সংগ্রহ করে দুই মলাটের মধ্যে সংকলিত করা শুধু প্রশংসনীয় নয়, এক দুরূহ কাজও বটে।সুদীপ কুমার দাস তাঁর সম্পাদিত 'বিয়ের গীত ও লোকাচার' গ্ৰন্হটির মাধ্যমে এই কাজটাই করেছেন।শুধু বিয়ের গীত নয়,বিয়ের আচার অনুষ্ঠান, সেসবে ব্যবহৃত জিনিষেরও বিস্তৃত বিবরণ,সংশ্লিষ্ট ইতিহাস তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর গ্রন্হটিতে।প্রাসঙ্গিক ভাবেই এসেছে বিয়ের সূচনার ভাবনা,বিয়ে প্রচলনের ইতিহাস,বাঙালি হিন্দুদের বিবাহ রীতি ইত্যাদি প্রসঙ্গ। বিয়ের সমস্ত অনুষ্ঠান পর্ব,বাক্য দান থেকে দ্বিরাগমন পর্যন্ত-সব কিছু নিয়ে রয়েছে গীত ও আচার অনুষ্ঠান। সুদীপবাবু পরম মমতায় সেসব সন্নিবিষ্ট করেছেন তাঁর গ্রন্হে।কোন সময়ে কোন গান গাওয়া হয় তা যেমন উল্লেখ করা হয়েছে,তেমনই সংশ্লিষ্ট মঙ্গল কার্যের উপকরণের বর্ণনাও রয়েছে গ্রন্হটিতে। মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে পান-সুপারি,বেল পাতা,আম পাতা,তুলসী পাতা,ঘট,নারিকেল,গামছা ইত্যাদি ব্যবহারের কথা ব্যাখ্যা করা হয়েছে।এক সময় পূর্ববঙ্গের কিছু ও সন্নিহিত এলাকায় বিয়ের সময় ধামাইল ছিল অপরিহার্য। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ছিল ভিন্ন ভিন্ন ধামাইল গীতি।বিয়ের আচার অনুষ্ঠানে ভোরের একটি ধামাইল গীতি গ্রন্হটি থেকে উল্লেখ করছি-
" বন্ধু রসিক শ্যামরায় অভাগিনী ডাকি
বন্ধু দেখা দেও আমায়,
তোমায় আমায় একদিন দেখা হইল যমুনায়।
সেই অবধি প্রাণটি আমার হরিয়া নিলায়।
চাতক রইল মেঘের আশায় রে বন্ধু
মেঘ না হইল হায়
মেঘ না হইলে চাতক পাখি কী হবে উপায়।"
ভোরবেলায় বর/কন্যার বাবা মা আত্মীয় স্বজন পরিবৃত হয়ে নদীর ঘাটে জল ভরতে যাবার সময় এই গান গাওয়া হতো।এরকম নানা সময়ে বিয়ের নানা আচার অনুষ্ঠান ঘিরে গান গাওয়ার রেওয়াজ ছিল একদা।অধিবাস,সোহাগ মাগা,জল ভরা,আব্যাদিক,গায়ে হলুদ, পাশা খেলা সব অনুষ্ঠান ঘিরেই ছিল গীতের আসর।আর সেসবে আত্মীয় স্বজন সহ পাড়া প্রতিবেশীরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশ নিতেন। এই ভাবে বিয়ে ঘিরে দুই পরিবারের বন্ধন সামাজিক বন্ধনকে যেন দৃঢ় করত।আজ সেসব হারিয়ে গেছে বলা যায়।শহর কেন, গ্রামাঞ্চলেও আজ বিয়ের লৌকিক আচার অনুষ্ঠান ঘিরে তেমন উদ্দীপনা দেখা যায়না।যেসব বিয়ের গীতে একদিন বিবাহ বাসর মুখর হয়ে উঠতো তা হারিয়ে গেছে,হারিয়ে যাচ্ছে ধামাইল নাচও।তাই এই সব গীতকে সংগ্রহ করে কেউ যদি সংকলিত করেন তবে তা হবে আমাদের চিরায়ত লোকসংস্কৃতি সংরক্ষণে এক প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আমাদের অতীত ঐতিহ্য, লৌকিক আচার অনুষ্ঠানের পরম্পরা ধরা থাকবে এর মাধ্যমে।'বিয়ের গীতও লোকাচার' গ্ৰন্হটির সম্পাদনা করে সুদীপ কুমার দাস এই কাজটিই করেছেন। ত্রিপুরার নানা অঞ্চল থেকে তিনি বিয়ের গীত সংগ্রহ করে সংকলিত করেছেন দুই মলাটের মধ্যে। গানগুলো যাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন তাদের নাম দিয়ে ঋণ স্বীকারও করেছেন। রাধারমণের ক'টি ধামাইল গানও গ্রন্হটিতে সংকলিত হয়েছে।বিয়ের লৌকিক আচার অনুষ্ঠানের বিস্তৃত বিবরণ, সংশ্লিষ্ট ইতিহাস গ্রন্হটির উপরি পাওনা।এধরণের গ্রন্হের মাধ্যমে লোকসংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন হয়তো হবেনা,তবে তার সংরক্ষণ হবে।বিয়ের পর কন্যার বাবার বাড়িতে নাইয়র যাওয়ার রীতি এখনও আছে।কিন্তু একে কেন্দ্র করেও যে গীত ছিল আজকের প্রজন্মের কে জানে সে কথা!গ্রন্হটিতে সংকলিত এমন একটি গীত--
"আসল উমা পড়ল সারা ঢাক ঢোলক
খারা জয়ধ্বনি পিতার ভুবন
বাজে বাদ্য রুনু ঝুনু নাইয়র আসছে প্রাণের ধন।
সবে মিলি দেও উলুধ্বনি
নানা মিষ্টি সন্দেশ রসগোল্লা ফলের রস
নানাবিধ পিঠা চমৎকার।
মায়ের কোলেতে বসি কাঁদে উমা
কাল শশী বহুদিন হয় দেখিনা তোমায়।"