।। রক্ষা বন্ধন ।।

অরিন্দম নাথ

গতকাল সকালের ঘটনা । ভোর ছয়টা । প্রতিদিনের মতো প্রাতঃভ্রমণ করে ফিরে এসেছি । ঘামে শরীর জুবুজুবু । টি শার্ট আর গেঞ্জি মেলে দিয়েছি । ফ্যানের নিচে বসেছি । গায়ে একটি টাওয়েল । সত্যিকথা বলতে কি, বেশ হাঁপিয়ে গেছি । মোবাইলে একটি ফোন এলো । নাম্বারটি সেভ করা ছিল । স্ক্রিনে নাম ফুটে উঠলো । একজন বয়স্ক লোক । দাদা ডাকি । একসময় একসঙ্গে একটি এনজিও করতাম । অনেকদিন কথা হয় না । একটু বিরক্ত হলেও ফোন ধরলাম । উনার নাম নিয়ে দাদা সম্বোধন করে উত্তর দিলাম । তিনি খুশি হলেন । বিশেষত তাঁর নাম মনে রেখেছি বলে । আমি বললাম, সব কৃতিত্ব ফোনের । আপনার নাম মোবাইলে সেইভ আছে । ফোন করার কারণ জিজ্ঞাসা করলাম । তিনি বললেন এমনিতেই আমার কথা তাঁর মনে এলো । কুশল বিনিময়ের পর ফোন ছেড়ে দিলেন । দুজনেরই তখন খুশির অভিব্যক্তি ।

রাত্রিতে বিছানায় শুয়ে নিদ্রা দেবীর তপস্যা করছিলাম । তিনি বললেন, আসতে একটু লেট হবে । মনে মনে সারাদিনের ঘটনাবলীর সালতামামি করছিলাম । এখন অবসর জীবন । ঘটনাপ্রবাহ কম । সকালের ফোনটিই মনে রেখাপাত করে । একটি ঘটনা মনে আসে ।

দুই হাজার আঠার সাল । নভেম্বর মাস । হায়দ্রাবাদে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল জাতীয় পুলিশ একাডেমিতে ট্রেনিং করছি । ইন সার্ভিস ট্রেনিং । একদিন বিকেলে এক ম্যাডাম ক্লাস নিচ্ছিলেন । তিনি বোম্বে অথবা দিল্লি থেকে এসেছিলেন । জাতীয়স্তরের একটি ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের ফ্যাকাল্টি । জনসংযোগের উপর ক্লাস । একটি কাহিনী বললেন । গোয়ার পাঞ্জিমের একটি স্কুল । কো-এডুকেশন কনভেন্ট স্কুল । তাঁর কথায়, কো-এডুকেশন স্কুলে ছেলেমেয়েদের ব্যক্তিত্বের সুন্দর বিকাশ ঘটে । প্রত্যেকে তার বিপরীত সত্তাকে একই সঙ্গে বেড়ে উঠতে দেখে । বিশেষত বয়সন্ধিকালে । অজান্তেই উত্তেজনা প্রশমিত হয় । তাঁর কথার একটি বাস্তব উদাহরণ আমার মনে আসে । আগরতলার একটি রেস্টুরেন্টে একদিন রাত্রিতে একজন কর্মকর্তা রেইড করেছিলেন । সেখানে বেআইনি নাইট ক্লাব চালানো হতো । প্রায় পঞ্চাশজন ছেলেমেয়ে তখন উপস্থিত ছিল । ইলেভেন টুয়েলভের পড়ুয়া । কারও বার্থ-ডে পার্টি চলছিল । সবাই ছিল জোড়ায় জোড়ায় । ছেলেদের একজন ছিল কো-এডুকেশন স্কুলের । বাকিরা শহরের একটি নামকরা ছেলেদের স্কুলের । মেয়েদের সবাই বনেদী মেয়েদের স্কুলের ।

আবার ম্যাডামের গল্পে ফিরে যাচ্ছি । সেই স্কুলে একটি পরিবারের দুইটি মেয়ে পড়তো । ওঠাওঠি দুই বোন । এক ক্লাস উপর নীচে পড়ত । তাদের আর কোনও ভাই-বোন ছিল না । দুজনেই ভীষণ সুন্দরী । বাবা একজন নাবিক । অধিকাংশ সময় জাহাজে থাকেন । ডাঙ্গায় এলে মদের নেশায় মত্ত হয়ে পড়েন । সঙ্গে ছিল অন্য নারীতে আসক্তি । মা ঠিক উল্টো । নার্স । ভীষণই শান্ত স্বভাবের । বড় মেয়েটি পেয়েছিল মায়ের স্বভাব । ভীষণই শান্ত । পাশাপাশি পড়াশুনায় ভালো । ছোট মেয়েটি বাবার মত । উশৃংখল প্রকৃতির । পড়াশুনার প্রতি নজর নেই । সারাক্ষণ সাজ সজ্জাতেই মগ্ন থাকতো । একসময় বাবা মায়ের মধ্যে ডিভোর্স হয় । মেয়ে দুটি মায়ের সঙ্গে থেকে যায়। মা আবার বিয়ে করেন । বড়বোন নতুন বাবাকে মেনে নেয় । ছোটবোন নতুন সম্পর্ক সহ্য করতে পারে না । এর প্রভাব তাদের জীবনশৈলীতে প্রভাব ফেলে । স্কুল শেষ করবার আগেই ছোট মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হয় । পড়াশোনা শেষ করতে পারে না । স্কুল ড্রপ-আউট হয়ে হারিয়ে যায় । বড়বোনটি পড়াশুনায় একটি স্ট্যান্ডার্ড ম্যানটেন করত । সে স্বাভাবিক ভাবে পাশ করে । স্কুল কলেজের পড়াশোনা শেষ করে । জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয় ।

ছোট মেয়েটির ক্লাসে এক ম্যাডাম ছিলেন । ভীষণই মমতাময়ী । ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে ভীষণ ভালোবাসতো । তিনি তাদের ভারতীয় সংস্কৃতিতে উদ্বুদ্ধ করতেন । ক্লাসে রক্ষা বন্ধন পালন করতেন । রাখী পূর্ণিমায় ক্লাসের মেয়েরা ছেলেদের রাখী পরাত । উশৃঙ্খল জীবন-যাপন সত্বেও মেয়েটিকে তিনি খুব স্নেহ করতেন । তার মিথ্যে কথা ধরে ফেলতেন । তাকে শোধরাতে বলতেন । তিনি ছিলেন স্কুলের মধ্যে মেয়েটির একমাত্র শুভানুধ্যায়ী । একসময় সেই ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রীরা পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে যায় । তারপর বেশ কয়েক বছর গড়িয়ে গেছে । বড় মেয়েটির অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে গিয়েছে । ছোট মেয়েটি আগেই হারিয়ে গিয়েছিল । পরিবারটিও অন্য কোথাও চলে যায় । স্কুলের ম্যাডাম মেয়েটির কথা ভুলেই গিয়েছিলেন । একদিন সন্ধ্যেবেলা মেয়েটির একটি ফোন পান । নিজের পরিচয় দিয়ে মেয়েটি কান্নাকাটি করতে থাকে । কথাবার্তায় বুঝতে পারেন মেয়েটি নেশাগ্রস্থ । তার জীবনে হতাশা গ্রাস করেছে । সে সুইসাইড করতে যাচ্ছে । বেশ কয়েকটি স্লিপিং পিল খেয়েছে । তারপর মেয়েটির ফোন লাইন কেটে যায় । ফোন করলে আন-এটেন্ডেড থাকে । মেয়েটি কোথায় আছে বলতে পারেন না । তিনি মেয়েটির কিছু সহপাঠীর নাম মনে করেন । তাদের কয়েকজনকে ফোনে পেয়েও যান । বিশেষকরে ছেলেদের বলেন যে তিনি নিশ্চিত মেয়েটি সত্যিকথা বলেছে । ছাত্রদের কাছে রক্ষা বন্ধনের পরীক্ষা দাবী করেন । মেয়েটিকে বাঁচাতে বলেন ।

পরবর্তী কয়েক ঘন্টা দেশ বিদেশের বিভিন্ন শহরে গ্রামে ফোন বাজতে থাকে । এই ছেলেদের সঙ্গে আরও অনেকে নেটওয়ার্কে যুক্ত হয় । ভোররাত্রি তিনটে চারটার মধ্যে মেয়েটির লোকেশন শনাক্ত হয় । ব্যাঙ্গালুরু শহরের একটি গলিতে । সৌভাগ্যক্রমে কাছাকাছি ছেলেদের একটি বন্ধুও ছিল । সে তার স্ত্রীকে নিয়ে তৎক্ষণাৎ ওই ঠিকানায় যায় । মেয়েটিকে অসুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করে । সে নেশা করে এবং ঘুমের ঔষধ খেয়ে অচেতন হয়ে পড়েছিল । মেয়েটিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় । সুস্থ হলে মেয়েটি আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ে । যখন দেখতে পায় অনেক বন্ধুবান্ধব ও স্কুলের সহপাঠী তাকে তখনও মনে রেখেছে । সে স্বামী পরিত্যক্তা হিসেবে জীবন অতিবাহিত করছিল । এই ঘটনা তার মনে বাঁচার প্রেরণা যোগায় । সে নতুন করে জীবন শুরু করে । অচিরেই নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয় ।

আমাদের ম্যাডাম, গল্পটি বলা শেষ করে সবাইকে একটি টাস্ক দেন । দশজন জীবিত ব্যক্তির নাম লিখতে যারা প্রত্যেকের নিজ নিজ জীবনে কোনও না কোনওভাবে গভীর প্রভাব ফেলেছেন । ওই ব্যক্তিরা নিজের পরিবারের মধ্য থেকেও হতে পারেন । সহকর্মী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, বন্ধু-বান্ধব, ড্রাইভার, হোমগার্ড এমনি অধস্তন পেশার লোকজন । সবাই খুব চিন্তা করে নিজনিজ লিস্ট তৈরি করি । এইবার ম্যাডাম আমাদের আধঘন্টা সময় দেন । বলেন যে, এই লিস্ট থেকে অন্তত পাঁচজনকে ফোন করতে । কুশল জানতে । আমরা আবার সক্রিয় হই । আমার লিস্টে একজন ড্রাইভারের নাম ছিল । তাকে চাকুরী জীবনের প্রথমদিকে আমি পেয়েছিলাম । আমার ফোন পেয়ে সে আবেগ আপ্লুত হয়ে কেঁদে ফেলে । আমার লিস্টে একজন বিদেশিনীও ছিলেন । বাংলাদেশের একজন মহিলা । শিক্ষিকা । পাশাপাশি লেখিকা । তাঁর সঙ্গে পরিচয় ফেইসবুকের মধ্য দিয়ে । এখনও দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি । তাঁকেও ফোন করি । কথা বলি । গতকাল আমার বয়োজ্যেষ্ঠ দাদা হয়তো সেরকমই ফোন করেছিলেন ।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.