।। উলঙ্গ অসুর ।।

অরিন্দম নাথ

এক অসুরের গল্প । জীবনে আমি তাকে তিনবার দেখেছি । দুইবার খুব কাছ থেকে । একবার কিছুটা দূর থেকে । তিনবারই আলাদা ভূমিকায় । তারপর ছবিতে । অনুভবে । তার ধ্বংস লীলায় । আমি তখন মহকুমা পর্যায়ের আধিকারিক । সময়টা বিগত শতাব্দীর শেষ লগ্ন । আমার পোস্টিং তখন মফস্বলের একটি শহরে । বড়মুড়া পাহাড়শ্রেণীর পাদদেশ । ফিল্ড ওয়ার্কার হিসেবে । জাতি-জনজাতির গ্রামে ঘুরে বেড়াই । মন দিয়ে কাজ করি । মানুষজন আমাকে ভালবাসে । পাহাড়ের শ্যামলিমা আমাকে মুগ্ধ করে । আমাকে ডাকে । আমি বাঙালি। তথাপি জনজাতিরা আমাকে আপন করে নিয়েছে । তাদের সুখ-দুঃখের কথা বলে । প্রশাসনিক ক্যাম্পে গেলে খাতির করে । উগ্রপন্থা বিরাজ করলেও ভয় পাই না ।

তথাপি একদিন আমি অপহৃত হলাম । সঙ্গে আমার এক অধস্থন কলিগ । শীতকালের বিকেল। সন্ধ্যা নেমে আসে খুব দ্রুত । প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটি কাজ দেখে ফিরছিলাম । বাজার পর্যন্ত পায়ে হেঁটে । তারপর গাড়িতে করে । সদরে আসার পথে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে আমাদের অপহরণ করল । দশ বারো জনের একটি উগ্রবাদী দল । সবাই জলপাই রঙের পোশাক পরিহিত। সাথে স্বয়ংক্রিয় হাতিয়ার । বন্দুকের মুখে আমাদেরকে দৌড়ের উপর নিয়ে যাচ্ছিল । গন্তব্য পাহাড়ের দিকে । তাদের ভয় পুলিশ বা টিএসআর যদি পিছু ধাওয়া করে । কিছুটা দূরত্ব গিয়ে তারা নিশ্চিন্ত হয় । পুলিশ পেছনে আসছে না । ততক্ষণে অন্ধকার নেমে এসেছে । এবার আমাদের হাত পিছুকরে বেঁধে ফেলে । নরমাল হাঁটতে বলে । মোটামুটি পরিচিত পথ । হাত বাঁধা থাকায় চলতে কষ্ট হচ্ছিল । এবার হাতের বাঁধন খুলে দেয় । বুঝতে পারি স্থানটি অম্লাক । পাহাড়ের উপর শেষ জমাতিয়া গ্রাম । তারা আমাদের পাহাড়ের আরও উপরে নিয়ে যায় । সেখানে ইতস্তত ছড়িয়ে আছে তেমতাই, বামপাই, লাইলাক, নাজিলা, ডাকমুড়া, ছনখলা এমনি সব মলসম গ্রাম ।

গ্রামে তারা ঢুকে না । গ্রামের একপাশে একটি জুম খেতে আশ্রয় নেয় । সেখানে একটি গাইরিং দাড়িয়েছিল । জুমঘরের মেঝেতে শুতে দেয় । একটি বাঁশের চাটাই বিছানো ছিল । কোথা থেকে দুইটি কম্বল এনে দেয় । কিন্তু কোন খাবার-দাবার দেয় না । শুধু জল । হাত পেছন করে বাঁধা। পাঁচজন পাহারায় থাকে । দুই জনের কাছে স্বয়ংক্রিয় হাতিয়ার । বাকি তিনজনের কাছে গাঁদা বন্দুক । এই অবস্থায় রাত্রিতে ঘুম আসে না । দুজনেই প্রায় বিনিদ্র রজনী কাটাই । পরদিন ভোরবেলা কোথাও থেকে খাবার নিয়ে আসে । ভাত, ডাল আর গোধক । দিনের বেলায় মুহুর্মুহু খবর আসতে থাকে । পুলিশের অভিযানের । তারা দূর থেকে বাইনোকুলার দিয়ে লক্ষ্য রাখছিল। রেডিওতে আমাদের অপহরণের খবর শুনায় । প্রথম কয়েকটা দিন দিনের বেলা জঙ্গলে নিয়ে বেঁধে রাখত । বাঁশ বনের ভিতর শিমুল কিংবা কনক গাছের সঙ্গে । রাত্রিতে চার পাঁচ কিলোমিটার রেডিয়াসের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জুম ক্ষেতের গাইরিং এর ভিতর রাখত। প্রথমদিকে একদিন আমাদের খুব কাছ দিয়ে পুলিশ টিএসআরের দল যাচ্ছিল । আমি তাদের কথাবার্তাও শুনতে পাচ্ছিলাম । একজন উগ্রবাদী হাতের একে ফর্টিসেভেন আমার দিকে তাক করে রেখেছিল । অন্য একজন আমার সহকর্মীর দিকে। তার অবস্থা তখন আরও কাহিল ছিল । আমি গ্রামের ছেলে । সে ছিল আগরতলা শহরের ছেলে ।মাঝে মাঝে বৈরী দলের নেতারা দেখা করতে আসতো । তারা আমাদের বাধ্য করত চিঠি লিখতে । মোটা মুক্তিপন দাবী করে। নিজের বাড়িতে । সরকারি আধিকারিকদের কাছে । অনেকগুলি টাকা । সবার জন্য টাইটান ঘড়ি । ফেয়ার এন্ড লাভলী ক্রীম । দশ ব্যান্ডের রেডিও । এমনি সব দাবী। মাঝেমধ্যে বলতো গ্রামবাসীরা তাদের চাপ দিচ্ছে । আমারও জানতাম কথাবার্তা চলছে। এই মর্মে পরিবারের তরফ থেকে চিঠিও পেয়েছিলাম। কার সঙ্গে কথা হচ্ছে জানতাম না । পরিবারের লোকেরা নিশ্চিত ছিলেন আমার সততা কাজে আসবে । আমাদের জীবনহানি হবে না । তারপর জীবন কিছুটা স্বাভাবিক ছন্দে চলে আসে । গার্ডের একজন দুইজন সদস্য মাঝেমধ্যে বদল হতো । দুইবেলা খাবার মিলতো । সকাল সাতটার মধ্যে । আবার বিকেল চারটার মধ্যে। তারপর জঙ্গলে । জুম হাটে রাত্রি যাপন । রান্না দূরে কোথাও করত। যাতে ধোঁয়া দেখে পুলিশ না চলে আসে। গোধক, ছোট মাছ কিংবা মুরগির মাংস । একটি আমিষ পদ। মাঝেমধ্যে শুকরের মাংস । ভাত । ডাল। আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করত । শুধু রাত্রিতে হাত বেঁধে রাখত । বলতো, কথাবার্তা চলছে । সহসাই ছাড়া পাব । এভাবে চৌদ্দদিনের দিন বিকেলে হরকত দেখতে পাই । বলে দু-একদিনের মধ্যে আমরা মুক্তি পাবো ।

পরদিন সকাল থেকেই তাদের মধ্যে বেশ খুশিখুশি ভাব লক্ষ্য করি। আমাদের হাতের বাঁধন ইতিমধ্যে খুলে দিয়েছে । সেদিন ফিস্টের ব্যবস্থা করে শূকরের মাংসের ভর্তা । সঙ্গে মুরগির মাংস । জুমের চালের ভাত । ডাল । পুরো দলটি একত্রিত হয় । সব মিলিয়ে বারো জন । তারা আরও একজনের অপেক্ষা করছিল । তাদের দলের এরিয়া কমান্ডার । তিনি এলেন বেলা তিনটের দিকে । কালো । লম্বা ছিপছিপে চেহারা । পরনে সামরিক পোশাক । রোদ চশমা । কাঁধে একে ফর্টিসেভেন রাইফেল । সঙ্গে আরও দুজন অস্ত্রধারী । বুঝলাম, বডিগার্ড । কোথা থেকে তিনটি প্লাস্টিক চেয়ার এনে হাজির করলো । একটিতে নেতা বসলেন । বাকি দুইটিতে আমরা দুজন। খুব ধীরে ধীরে কথা বলছিলেন । সন্ধ্যার দিকে তাদের লোক আমাদেরকে দেওয়ান বাজারের কাছে ছেড়ে আসবে । আমাদের দুজনের সঙ্গে পাশাপাশি বসে খেলেন । তারপর একটু বিশ্রাম নিলেন । এর মধ্যে ছাড়ার মুহূর্ত এসে গেল । দুইজন গাইড এসে হাজির । দেখে মনে হলো গ্রামবাসী । এবার নেতা আমাদের অরেঞ্জ স্কোয়াশ খাওয়ালেন । গ্লাসে করে । এরপর গাইড আমাদেরকে দেওয়ানবাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিল । পাহাড় থেকে নামতে ঘন্টা দেড়েক সময় লাগলো । নিকটবর্তী বাজারে আমাদের আত্মীয়-স্বজন এবং দুইজন সহকর্মী অপেক্ষা করছিলেন । তাদের তরফ থেকে গাড়ির ব্যবস্থা ছিল । পুলিশকে খবর জানিয়ে সেদিন রাত্রিতেই আমরা নিজ নিজ বাসায় পৌঁছে যাই।

পরে জেনেছিলাম আমাদের দুজনের পরিবারের পাশাপাশি গ্রামবাসীরাও চাঁদা তুলে মুক্তিপন দিতে সাহায্য করেছিল । আমি আবার আমার সরকারি কাজে যোগ দিই । আমাকে অন্য কোথাও বদলি করা হয় না । গ্রামবাসীরাও চাইছিল, আমি থাকি । তবে আমার সহকর্মী বদলি হয়ে গেলেন । আমি ভাবলাম, বিজলী একই গাছে দুবার পড়ে না । এর বছর দুয়েক পরের কথা । আমি তখনও আগের পদে কর্মরত । একদিন এক ব্লক সদরে প্রশাসনিক বৈঠকে গিয়েছি । আমন্ত্রিত হিসেবে কয়েকজন জনপ্রতিনিধিও এসেছেন । একজনকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠি । সেই অসুর । যার হাত থেকে বন্দীশায় কমলার শরবত খেয়েছিলাম । আমার মনে কেমন যেন ভয় ঢুকে গেল । আমি ঘনঘন ঘড়ি দেখতে লাগলাম । কখন মিটিং শেষ হবে । তারপর সেখান থেকে গাড়িতে চলে এলাম সদরে । আমার এক বন্ধু তখন পুলিশে চাকুরি করে । তার পোস্টিং সেই জেলা সদরে । তার কাছে গিয়ে হাজির হলাম । চা খেতে খেতে সে আমার কাহিনী শুনল । তারপর তার বসের কাছে নিয়ে গেল । বস বললেন, "আপনি যে কথা বলছেন, লিখে দেবেন?"

আমার মনে আবারও ভয় এসে হাজির হলো । আমি লিখিত দিতে অস্বীকার করলাম । কিছুদিন পর আমি পদোন্নতি পেলাম । নতুন পোস্টিং নিয়ে আগরতলায় চলে এলাম । এবার আমি প্রশাসনিক দায়িত্বে । বয়সও তখন প্রায় ষাট হতে চলেছে । দুই হাজার সতের সাল । জুলাই মাস । বড়মুড়ায় একটি রাজনৈতিক দলের তরফে পথ অবরোধ চলছে । আমারও ডিউটি পড়েছে পুলিশ ও টিএসআরের সঙ্গে । একদিন সকালে তুমুল উত্তেজনা । একদল আন্দোলনকারী উলঙ্গ হয়ে বেরিকেড ভেঙ্গে এগিয়ে আসতে চায় । কিছুটা দূরে দাঁড়ানো পুলিশ এবং প্রশাসনের লোকেদের উত্তেজিত করার চেষ্টা করছে । বল প্রয়োগ করার জন্য । সুবোধ সরকারের 'মনিপুরের মা' কবিতার কথা মনে এলো । ভাবলাম এরই প্রভাব । পরক্ষণেই ভুল ভাঙলো । চেয়ে দেখি, নেতৃত্বে সেই দিনের সেই অসুর । উলঙ্গ । তারপর সেই অসুর আরও ক্ষমতাবান হলো । আরও অসুরের জন্ম দিল । পাহাড়ে । সমতলে। তারপর আর পাঁচজন শিক্ষিত লোকের মত আমি ভুলেই গেলাম তার কথা ।

গতকাল রাত্রিতে একটি সিনেমা দেখেছি । হিন্দি সিনেমা । 'নাকাব' । মুখ্য ভূমিকায় ঋষি কাপুর । ফারাহা খান । আমজাদ খান। অনেকদিন আগে পড়া একটি গল্প মনে এলো। আমাদের দেশের বৃহৎ অংশের মানুষ অসৎ প্রকৃতির । বাকিদের এক শতাংশ ছাড়া সবাই নীরব থাকে । 'অন্যায় যে করে অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে' । নিজেকে সেই এক শতাংশ লোকের মধ্যে উত্তরণের বাসনা জাগলো । তাই আজ নাকাব হটিয়ে দিলাম ।

(সত্য ঘটনা আশ্রিত গল্প। লেখক গল্পের কথক হলেও, অপহৃত হননি। পুলিশ অফিসার হিসেবে তিনি ঘটনাটি সম্পর্কে অবগত ছিলেন । তাই গল্পের আমেজেই নেবেন।)


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.