আগরতলা ও রানি পূর্ণকলা

পান্নালাল রায়

ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার গোড়াপত্তনের সঙ্গে যেমন জড়িয়ে আছে রাজার শিকারের কাহিনি তেমনই রয়েছে রানি পূর্ণকলার এক ক্ষীণ যোগসূত্রও।

ঐতিহাসিক যুগে ত্রিপুরার রাজধানী কয়েকবার স্হানান্তরিত হয়েছে।সহস্রাধিক বছর রাজধানী ছিল উদয়পুরে।১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে রাজা কৃষ্ণ মাণিক্য উদয়পুর থেকে তাঁর রাজধানী সরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন বর্তমান পুরান আগরতলায়।সম্ভবত উদয়পুরের তুলনায় আজকের পুরান আগরতলা বহির্শত্রুর আক্রমণের দিক থেকে নিরাপদ মনে হয়েছিল রাজার কাছে।পরবর্তী সময়ে কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য পুরান আগরতলা থেকে বর্তমান আগরতলায় রাজধানী স্হানান্তর করেন।কারও কারও মতে শিকারপ্রিয় রাজা কৃষ্ণকিশোরের শিকারের সুবিধার জন্যই সেদিনের জল-জঙ্গলের স্হানটিতে রাজধানী উঠিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। তবে শুধুমাত্র রাজার শিকারের সুবিধাই নয় ,ছিল অন্যান্য কিছু সুবিধাও।তার মধ্যে অন্যতম ছিল ব্রিটিশ বাংলার সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধা।

কৃষ্ণকিশোর মাণিক্যের রাজত্বকাল হচ্ছে ১৮২৯-৪৯ খ্রিস্টাব্দ। তা হলে অনুমান করতে অসুবিধা হয়না যে,এই সময়কালের মধ্যেই বর্তমান আগরতলায় ত্রিপুরার রাজধানী স্হানান্তরিত হয়েছিল।তবে এই রাজধানী স্হানান্তরের ঘটনা কিন্তু পরবর্তী সময়ের ঐতিহাসিক গ্রন্হ গুলোতে তেমন একটা গুরুত্ব পায়নি।সুবিখ্যাত ইতিহাসবিদ কৈলাসচন্দ্র সিংহ তাঁর 'রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস' গ্ৰন্হে এসম্পর্কে লিখেছেন-"শিকারের সুবিধার জন্য বহু অর্থ ব্যয় করিয়া তিনি(কৃষ্ণকিশোর) আগরতলার (বর্তমান পুরান আগরতলা) নিকটবর্তী এক জলাভূমিতে 'নূতন হাবেলী' নামক নগর নির্মাণ পূর্বক সেই স্হানে রাজপাট স্হাপন করেন। " শুধু কৈলাসচন্দ্র কেন,কামিং সাহেবও গুরুত্বহীন ভাবেই উল্লেখ করেছেন আগরতলায় রাজধানী স্থানান্তরের কথা।তদানীন্তন সেটেলমেন্ট অফিসার জে জি কামিং,আই সি এস তাঁর চাকলা রোশনাবাদ সংক্রান্ত গ্রন্হে নতুন আগরতলা বিষয়ে লিখেছেন-New Agartala or Natun Habeli was founded in 1838,in the time of Raja Krishna Kishor Manikya. এখানে কামিং সাহেবের লেখা থেকে বর্তমান আগরতলায় নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে অবশ্য একটি নির্দিষ্ট বছরের উল্লেখ পাওয়া যায়।সেটা হল ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দ। কিন্তু সেসময় স্হানটিতে কোনো অট্টালিকা,জলাশয় কিংবা রাস্তাঘাট নির্মাণের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।কোনো কোনো ঐতিহাসিক উল্লেখ করেছেন ১৮৪০ সালে আগরতলায় কৃষ্ণকিশোর একটি জলাশয় খনন করিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তার সংস্কার করে হয় কৃষ্ণসাগর-বর্তমান উজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদের সামনের জোড়া দীঘির একটি।ঐতিহাসিকগণ আরও উল্লেখ করেছেন যে,কৃষ্ণকিশোর ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে নতুন আগরতলায় একটি কুটির নির্মাণ করিয়েছিলেন। কেউ কেউ বলেছেন, ১৮৪৯ সালে নতুন আগরতলায় ছন বাঁশের এক রাজবাড়ি করিয়েছিলেন তিনি।

বর্তমান রাজধানীর জন্মবৃত্তান্তে রয়েছে শিকারের কাহিনি।শিকারপ্রেমী রাজার জায়গাটি নাকি খুব ভাল লেগে গিয়েছিল।শিকারের সুবিধা হবে ভেবেই তিনি নাকি এখানে তাঁর রাজধানী উঠিয়ে নিয়ে এসেছিলেন।কিন্তু শুধুমাত্র এ কারণেই রাজধানী স্থানান্তরের গল্প অবিশ্বাস্য। বর্তমান স্হানে রাজধানী নিয়ে এলে ব্রিটিশ বাংলার সঙ্গে যোগাযোগে সুবিধা হবে-রাজধানী স্থানান্তরের এটা এক বিশ্বাসযোগ্য কারণ।তবে ঐতিহাসিকরা এর সঙ্গে কুকি আক্রমণের কথাও যুক্ত করেছেন।কুকিরা পুরান রাজধানীতে লুটপাট চালিয়েছিল। কুকি হামলা থেকে রক্ষার জন্যও ব্রিটিশ বাংলার কাছাকাছি বর্তমান জায়গাতে রাজধানী নিয়ে আসা হতে পারে বলে কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন।যাইহোক, পুরান আগরতলা থেকে বর্তমান আগরতলায় রাজধানী স্থানান্তরের পেছনে যে একাধিক কারণ রয়েছে তা অনুমান করতে মোটেই অসুবিধা হয় না।তবে এই স্হানান্তর পর্বটা হয়েছিল রাজার সিদ্ধান্ত গ্রহণের কিছুদিন পরে,পর্যায়ক্রমে।কৃষ্ণকিশোর মাণিক্যের কোনো কীর্তি চিহ্ন নেই আগরতলায়।তবে রাজা যে একটি জলাশয় খনন ও কুটির নির্মাণের মাধ্যমে নতুন জায়গাটিতে বসতি পত্তনের সূচনা করতে চেয়েছিলেন সে ইঙ্গিত পাওয়া যায় বিভিন্ন তথ্যে।

এবার আসা যাক,কৃষ্ণকিশোরের এক মণিপুরী রানি পূর্ণকলার কথায়।নতুন রাজধানী পত্তনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই রানির নাম।কৃষ্ণকিশোর ছিলেন ঘোর ইন্দ্রিয়পরায়ণ।তিনি বেশ কয়েকটি বিবাহ করেছিলেন। রাজার পাচিকা ছিল পূর্ণকলা।অল্প বয়সের এই ব্রাহ্মণ মণিপুরী কন্যা ছিলেন খুবই সুন্দরী।একদিন মহারাজা কৃষ্ণকিশোর পূর্ণকলার প্রেমে পড়ে গেলেন।তারপর বিবাহ। এ সম্পর্কে কৈলাসচন্দ্র সিংহ লিখেছেন-"মহারাজা কৃষ্ণকিশোর ঘোর ইন্দ্রীয়পরায়ণ ও বিলাসী নরপতি ছিলেন। তিনি তাঁহার পাচিকা(মণিপুরী ব্রাহ্মণ কন্যা) পূর্ণকলার প্রেমে মুগ্ধ হইয়া বৃদ্ধ বয়সে তাঁহাকে বিবাহ করিয়াছিলেন। "

কিন্তু ব্রাহ্মণ কন্যাকে ক্ষত্রিয় রাজার বিবাহ সেদিনের রক্ষণশীল সমাজ মেনে নিতে পারেনি।এতে সমাজপতিরা ঘোর অমঙ্গলের আশঙ্কা করেছিলেন। ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে বজ্রাঘাতে মৃত্যু ঘটেছিল কৃষ্ণকিশোরের। অনেকের বিশ্বাস, ব্রাহ্মণ কন্যা বিবাহ করার জন্যই রাজার এমন অপঘাত মৃত্যু হয়।যাইহোক, কৃষ্ণকিশোর অবশ্য তাঁর নতুন রানিকে যথেষ্ট মর্যাদা দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর এই রানিকে আগরতলার বর্তমান ধলেশ্বর এলাকায় বাড়ি তৈরি করে দিয়েছিলেন। সঙ্গে রানির পরিচারিকা সহ লোকজনদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। এভাবেই নাকি নতুন রাজধানীর পূর্বপ্রান্তে গড়ে উঠেছিল প্রথম বসতি।উল্লেখ করা যায় যে,কৃষ্ণকিশোর কর্তৃক ১৮৪৪ সালে বর্তমান আগরতলায় যে কুটির তৈরির তথ্য পাওয়া যায় সেটিই সম্ভবত রানি পূর্ণকলার জন্য নির্মিত কুটির। জানা যায়,পরবর্তীকালে রাজমন্ত্রী কামিনী কুমার সিংহ সেই কুটিরকে কেন্দ্র করেই নিজস্ব বাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন। আগরতলার আজকের ধলেশ্বর এলাকায় এ ভাবেই নাকি গড়ে উঠেছিল মণিপুরী বসতি।তা হলে এরকম ধারণা করা যায় যে,বর্তমান আগরতলায় বসতি পত্তনের পর্বটা প্রথমে শুরু হয়েছিল বর্তমান ধলেশ্বর অঞ্চলেই।রানি পূর্ণকলার বাড়ি তৈরির আগে নতুন হাবেলীর অন্য কোনও অংশে জনবসতির তথ্য পাওয়া যায়নি।

যে কোনও রাজধানীর স্হানান্তর পর্ব যেমন পর্যায়ক্রমে ঘটে থাকে,তেমনই ব্যতিক্রম নয় এই আগরতলাও।কৃষ্ণকিশোর বর্তমান আগরতলায় রাজধানী সরিয়ে আনলেও এখান থেকে তিনি রাজত্ব করেননি।তাঁর পুত্র ঈশানচন্দ্রও নয়।এমনকি,অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালের রাজা বীরচন্দ্রও তাঁর রাজত্বকালের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেছেন পুরাতন আগরতলায়।যাইহোক, সব রাজার রাজত্বকালেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে আজকের আগরতলা।তবে রাজ আমলে তাকে গড়ে তোলার প্রক্রিয়া বেগবান হয়েছে রাধাকিশোর থেকে বীরবিক্রম পর্যন্ত।

কিন্তু রাজধানী হলেও কেমন ছিল সেদিনের আগরতলা?বীরচন্দ্রের রাজত্বকালে ১৮৭৪ সালে আগরতলার লোকসংখ্যা ছিল ৮৭৫, ১৮৮১ সালে ২,৬৫৫ এবং ১৮৯১ সালে তা হয় ৪,৭২৩। সেদিনের নতুন হাবেলী ছিল এক নিস্তরঙ্গ শহর।দু'একটি রাস্তা।এদিক সেদিক তখনও জলা।বর্ষায় পাহাড়ি নদী হয়ে উঠে ভয়ঙ্কর।হেমন্তে ম ম করে নবান্নের ঘ্রাণ। ব্যস্ততা নেই, অশান্তি নেই।কীর্তনের সুর ভাজতে ভাজতে চলে যায় কোনো পথচারী।কোলাহলের কেন্দ্র ছিল সাপ্তাহিক হাট।বীরচন্দ্রের রাজত্বকালে আজকের আগরতলার কাসারী পট্টিতে নিয়মিত সাপ্তাহিক হাট বসতো বলে জানা যায়।অতীত দিনের এক বর্ণনায় আছে,সেদিন আখাউড়া খাল দিয়ে নানা পণ্য বোঝাই নৌকা আসত আখাউড়া সহ সন্নিহিত গ্রামাঞ্চল থেকে।আগরতলায় আজকের তুলসীবতী স্কুলের পেছনের জলাভূমিতে নৌকা গুলো নোঙর করা হতো।

কৃষ্ণকিশোর, ঈশানচন্দ্র, এমনকি মহারাজা বীরচন্দ্রেরও কোনও কীর্তিচিহ্ণ নেই আজকের আগরতলায়।কালের কবলে হারিয়ে গেছে সব।কিন্তু ইতিহাসের ধূসর পৃষ্ঠায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা তথ্য,নানা কাহিনি।আছে কিছু জনশ্রুতিও।কালক্রমে সবই চলে যাচ্ছে বিস্মৃতির অতল গহ্বরে।তেমনই রানি পূর্ণকলাও।আজকের এক ব্যস্ত রাজধানী আগরতলার সঙ্গে যে রানি পূর্ণকলারও এক ক্ষীণ যোগসূত্র রয়েছে সেও তো এক বিস্মৃত অধ্যায়।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.