।। আছেন তো ভালো ।।

অরিন্দম নাথ

প্রতিদিনের মর্নিং ওয়াক আমি রিলিজিয়সিয়াসলি করি । সঙ্গে আমার কুকুর জলি থাকে । এক বা দুইজন পার্টনার । একটি বিষয় আমাকে খুব আনন্দ দেয় । মনে মনে এর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও খুঁজি । প্রায়ই একজন ষাটোর্ধ ভদ্রলোকের সঙ্গে আমাদের দেখা হয় । আমার হৃদয়ের অপারেশনের আগে থেকেই। তিনি আমাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে থাকেন । তাঁর দুই ছেলে । বড় ছেলে স্পেশালিস্ট ডাক্তার । রাজ্যের বাইরে একটি নামকরা হাসপাতালে চাকুরী করেন । বৌমাও ডাক্তার । সদ্য বিবাহিতা । তাঁর ছোট ছেলে ইঞ্জিনিয়ার । মধ্যে একটি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিল । রাজ্যের বাইরে । এই নিয়ে পরিবারটি বছর খানেক খুব উৎকণ্ঠায় কাটিয়েছেন । এখন ছেলেটি বাসায় থাকে। স্বাধীন ব্যবসা করে । আগে তিনি সস্ত্রীক প্রাতঃভ্রমণ করতেন । এখন একা কিংবা প্রতিবেশী কারো সঙ্গে হাঁটাহাঁটি করেন । আমাকে দেখলেই তিনি হাসি মুখে একটি প্রশ্ন করেন, "স্যার, আছেন তো ভালো ?"

অনেক সময় মর্নিং ওয়াকের কোর্সেই দুইবার তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় । তখনও তিনি একই প্রশ্ন করেন, "স্যার, আছেন তো ভালো ?"

প্রথম প্রথম একটু মজা পেতাম। রবিঠাকুরের 'স্বপ্ন' কবিতার কয়েকটি পঙক্তি মনে আসতো:

"মোরে হেরি প্রিয়া

ধীরে ধীরে দীপখানি দ্বারে নামাইয়া

আইল সম্মুখে--মোর হস্তে হস্ত রাখি

নীরবে শুধাল শুধু, সকরুণ আঁখি, "হে বন্ধু আছ তো ভালো?"

ভাবতাম,পূর্বজন্মে তিনি আমার প্রিয়া ছিলেন । লিঙ্গান্তরে । প্রতিদিন একই প্রশ্ন শুনে এখন বিরক্তি লাগে । এমনি উৎকণ্ঠা মুখবইয়ের অনেক মিতাও দেখান । ফেসবুকের ইনবক্সে একই রকম প্রশ্ন করেন। আমি আমার পুলিশের অভিজ্ঞতায় এর ব্যাখ্যা খুঁজি । তেত্রিশ বছর পুলিশে চাকুরি করেছি । এই সুবাদে প্রচুর পুলিশ কর্মীর সংস্পর্শে এসেছি । বিশেষকরে, অসংখ্য টিএসআর কর্মীকে কাছ থেকে দেখেছি ।

পুলিশ কর্মচারীদের একটি খারাপ অভ্যাস আছে ৷ গর-হাজিরার ব্যামো ৷ তাদের স্বভাব অনেকটা কই মাছের মত ৷ জ্যান্ত কই মাছকে দাঁড়িপাল্লায় ওজন করা কষ্টকর ৷ মাপতে গেলে পাল্লা থেকে লাফিয়ে নেমে যায় ৷ প্রত্যন্ত অঞ্চলের ক্যাম্পে পর্যাপ্ত লোক না থাকলে সমস্যা ৷ তাই অফিসারেরা সময়ে অসময়ে ক্যাম্প ভিজিটে যান ৷ হাজিরা নেন ৷ অধিকাংশ সময়ই ক্যাম্পের দুই একজন গর-হাজির থাকে ৷ অনেক সময় এই গর-হাজিরার সংখ্যা আরও বেশি থাকে ৷ এই গর-হাজিরার একটি নাম আছে ৷ ‘মন ছুটি’ । কিংবা ‘কইয়া লিভ’ ৷ ক্যাম্প-ইনচার্যকে বলে বাড়ি চলে যাওয়া ৷ কোনও রেকর্ড থাকে না ৷ অনেক সময় ‘কইয়া লিভ’ পুলিশ কর্মচারীদের বিপদ ডেকে আনে ৷ বিশেষ করে যখন পুলিশ-ক্যাম্পে কোনও ঘটনা ঘটে ৷ বৈরী আক্রমণ কিংবা কোন আইন-শৃঙ্খলাজনিত পরিস্থিতি ৷ ঊর্ধ্বতন অফিসারেরা ছুটে আসেন ৷ ক্যাম্পে অনুপস্থিতির ঘটনা নজরে আসে ৷ শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত হয় ৷

পরিবারকে নিয়ে এই উৎকণ্ঠা পুলিশের সর্বস্তরের কর্মীর মধ্যেই লক্ষ্য করেছি । ছোটপদ থেকে বড়পদ পর্যন্ত । মর্নিং ওয়াকের শুভানুধ্যায়ীর সঙ্গে কোথায় যেন মিল । হাইট অফ অ্যাংজাইটি । পাশাপাশি আদর্শ পিতা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের ছেলেমেয়েরা পড়াশুনায় ভালো হয় । আমার ধারণায় তিনটি কারণে এই উচাটন । পরিবারের প্রতি ভালোবাসা । প্রেম অথবা পরকীয়ায় আসক্তি । ভূ কিংবা ড্রাগস মাফিয়াগিরিতে জড়িয়ে যাওয়া। সুখের কথা, শেষোক্ত ক্যাটাগরিতে খুব কম লোকই জড়িত।

ডিএসপি এবং উচ্চ পর্যায়ের এমনি পাঁচজনকে চিনতাম । সামনে থেকে দেখেছি । স্টাডি করেছি । এরমধ্যে দুইজনের ক্ষেত্রে পরিবারের পাশাপাশি পরকীয়ায় তীব্র আসক্তি ছিল । তিনজন ছিলেন এমএসসি পাশ । দুইজন এমএ পাশ । একজন পরকীয়ার অভিশাপে অকালে ঝরে গেছেন । সবার ক্ষেত্রেই এইটি ছিল দ্বিতীয় চাকুরী। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছেলেমেয়েরা জুয়েল হয়েছে । একদিন আমার এক সহকর্মীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। সর্বভারতীয় সেবার অফিসার । ডাক্তার । তিনি আমাকে অন্য একটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি ভাবার সুযোগ করে দেন । তাঁর কথায়, এই লোকগুলি জিএডি-তে আক্রান্ত। জেনারালাইজড অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার। সাধারণ উদ্বেগজনিত ব্যাধি। পরিবার বা অন্য কিছুর প্রতি অত্যধিক এবং অনিয়ন্ত্রিত উদ্বেগ । ফোনের পর ফোন করে যায় । মাকুর মত কর্মস্থল আর বাসার মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করে। উৎকণ্ঠা থেকে মাথাব্যথা, পেশীতে টান, অস্থিরতা, হৃদস্পন্দন, পেট খারাপ ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়।

তিনি আরও বলেন যে এই লোকগুলি উচ্চশিক্ষিত হয় । কোনও প্রশাসনিক মিটিং-এ যোগ দিলে সারাক্ষণ ইন্ডিফারেন্ট থাকে । অন্য কোনও খেয়ালে চলে । বসে বসে পা নাড়াতে থাকে। অথবা অন্য কোনও অঙ্গভঙ্গি করে । তাদের মনে সারাক্ষণ একটি কথা কাজ করে । আমার প্রতি দপ্তর ইনজাস্টিস করেছে ।

আমি আমার সহকর্মীর সঙ্গে মনে মনে সহমত পোষণ করি ।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.