।। দের আয়ে, দুরস্ত আয়ে ।।
অরিন্দম নাথ
বৃষ্টির জন্য গত দুইদিন মর্নিং ওয়াক করতে পারিনি। গতকাল আটটার দিকে বৃষ্টি ধরেছিল। কিছুটা সময়ের জন্য । তখন পোষা কুকুর জলিসহ বেরিয়েছিলাম। ডন-বস্কো বাজার অবধি । আজ সকালেও আকাশের মুখ ভার। তথাপি ভোর পাঁচটায় বেরিয়েছিলাম। সঙ্গে রঞ্জনবাবু । আমার প্রতিদিনের মর্নিং ওয়াকের পার্টনার । সাথে অবশ্যই জলি । গাইড । সে-ই আমাদের ঠিক ঠাক নিয়ে যায় । ভাদ্রমাস আসছে। সারমেয়রা জায়গায় জায়গায় সম্মেলন করে। জলি যতদূর সম্ভব ঠেকগুলি এড়িয়ে চলে। অনেক সময় নতুন ট্র্যাকে চলে। এতে মনোটোনিও কাটে । বেশ একটা অচেনার আনন্দ পাওয়া যায় । আজ সারমেয়রা ছিল না। সম্ভবতঃ নিরাপদ আশ্রয়ে। আমরা সর্ট-ট্র্যাক ধরে হাটছিলাম । পথের একটি অংশ সিমেন্টের সলিং । গ্রামীণ পথ । কিছুটা শেওলাধড়া। পিচ্ছিল । আছাড় খেলে আমরা এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখি । কেউ দেখলো কি না । সাক্ষী রাখতে চাই না । তাই আমরা সতর্ক হয়ে চলছিলাম । আমি রঞ্জনবাবুকে মজা করে বলছিলাম, "এই ধরনের বন্ধুর পথে, বন্ধুর সাথে চলারও উপকারিতা আছে । আমার মনে হয় মসৃন পথের চেয়ে এইপথে আমাদের দুজনেরই মেদ তাড়াতাড়ি ঝরবে । আমাদের সবগুলো ইন্দ্রিয়েরও ব্যায়াম হচ্ছে ।"
রঞ্জনবাবু এমআর । মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ । তাঁর অভিজ্ঞতা প্রচুর । আমার কথায় সায় দিয়ে বললেন, "ডেন্টিস্টরা বলেন, কোন খাবারই, বিশেষতঃ শক্ত খাবার একপাশের দাঁত দিয়ে খেতে নেই । দাঁতের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর ।"
আমরা তখন সন্তর্পনে রাস্তার শেওলাপড়া অংশ অতিক্রম করছিলাম । আমি তাঁর কথায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি না । তিনি একটি আখ্যান শোনান, "আমার এক দিদির ছেলে ভীষণ চটপটে । বছর ছয়েক বয়স । খুব ভাল গান করে । স্টেজেও গান করতে ভয় পায় না । হ্যারিডিটারি । দিদিও ভাল গান করতেন । ছোটবেলা থেকেই সে টিভিতে গানের রিয়ালিটি শো দেখতে পছন্দ করত । একপাশে বালিশে কান রেখে, ঘন্টার পর ঘন্টা বিছানায় শুয়ে প্রোগ্রাম দেখত । দিদিও কম্ফোর্টেবল ফিল করতেন । নির্বিবাদে ঘরের অন্য কাজ সারতে পারতেন । হঠাৎ তারা লক্ষ্য করলেন, তিন চার বছর হতে চলল, অথচ সে ঠিক করে কথা বলতে পারে না । প্রায় বোবা ।"
- ভেরি ইন্টারেস্টিং! কী করে বাকশক্তি অর্জন করলো ।
- আগরতলার বড়দোয়ালির কাছে একজন স্পিচ থেরাপিস্টের কাছে নিয়ে গেলেন ।
- জয়া আহসান !
- না, একজন পুরুষ ডাক্তারবাবু ।
- আচ্ছা ।
একদিন 'কণ্ঠ' সিনেমার গল্প তাঁকে বলেছিলাম। নায়িকা জয়া আহসানের অভিনয়ের প্রশংসা করেছিলাম ।
- ডাক্তারবাবু ভীষণই অভিজ্ঞ । তিনি খুব সহজেই এই অসম্পূর্ণতার কারণ অনুধাবন করতে পারলেন । আমার দিদিকে জিজ্ঞেস করলেন, ভাগ্নে একপাশে শুয়ে শুয়ে টিভির প্রোগ্রাম দেখে কি না । দিদি হ্যা বললেন । থেরাপিস্ট আৎকে উঠে বললেন যে আর কয়েকটা দিন দেরী করে এলে রোগী চিরতরে বোবা হয়ে যেত । কিছু ঔষধ দিলেন । আর বললেন বিছানায় শোবার সময় দুপাশে পালা করে করট দিয়ে ঘুমাতে । বিশেষকরে আগে যে পাশটা নেগলেক্টেড হয়েছে সেদিকটার প্রতি নজর দিতে হবে । ভাগ্নে যখন কথা বলতে শিখল, ওকে পুরো বাক্যটি বলতে বলা হত । সে ধীরে ধীরে কথা বলতে শিখল ।
- এক মিনিট, একটি মজাদার কথা মনে এসেছে । ছোটবেলায় আমাদের পাড়াতে একটি পরিবার ভাড়া এল । ওরা দুই ভাই । বড়ভাইটি বয়সে আমার চেয়ে বড় হবে । ছোট ভাইটি আমার চেয়ে ছোট । ওদের বাবা হয়তো ধর্মনগরে কোন অফিসে বদলি হয়ে এসেছিলেন । ছোট ভাইটি আমাদের সাথে ফুটবল খেলার জন্য বায়না ধরতো । আমরা ওকে তার নাম জিজ্ঞেস করতাম,"তোমার নাম কি?"
- আমার নাম ? আমার নাম তপন কুমার খাসনবীশ ।
তারপর কলের পুতুলের মত বলে যেত, "বাবার নাম ? রতন কুমার খাসনবীশ । দাদার নাম ? অলক কুমার খাসনবীশ ।"
তার শুদ্ধ-ভাষায় কথা বলা এবং বিচিত্র পদবির জন্য প্রতিদিন বেশ কয়েকবার আমরা একই প্রশ্ন করতাম । অসীম ধৈর্য্য সহকারে ছেলেটি বারবার একই উত্তর দিত । এখন মনে হচ্ছে বেচারার উপর আমরা অজান্তে অত্যাচার করেছি । সে হয়তো অনেক পরে কথা বলতে শিখেছিল ।
- স্যার, আমার মনে হয় সে 'অটিজম'-এ ভুগছিল । দেরিতে কথা বলা শেখার ফলে বাচ্চারা যেসব সমস্যায় ভুগে তা-ই হচ্ছে 'অটিজম' । আমার ভাগনেও এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছে । এখন সে খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারে ।
- দের আয়ে, দুরস্ত আয়ে !