দুই কবি রাজার কথা

পান্নালাল রায়

দুই রাজ্যের রাজার মধ্যে অনেক বৈপরীত্য, আবার মিলও কম নয়।রাজ্যাধিকার থেকে রাজ্য পরিচালনায় যখন বিতর্ক তাড়া করে একজনকে, তখন অপর রাজা সম্ভাব্য বিপদ এড়াতে চলে যান রাজ্য ছেড়ে।এক রাজা যখন তাঁর রাজ্যে ইংরেজ প্রভাব বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হন, তখন অপরজন ইংরেজদের কাছে পূর্ণ বশ্যতা স্বীকার করে নেন। তবে দুই রাজাই কবিতা ও গীত রচনা করতেন। দুজনেরই রানি ছিলেন মণিপুরী রাজকন্যা। দুই রাজাই ছিলেন বৈষ্ণব ভাবরসে সিক্ত।

ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র সিংহাসনে বসেছিলেন ১৮৬২ সালে।তার কয়েক দশক আগে ১৮১৩ সালে কাছাড়ের রাজা হয়েছিলেন গোবিন্দচন্দ্র।দুই রাজাই জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যুর পর রাজ্যাধিকারী হয়েছিলেন।কিন্তু ত্রিপুরায় বীরচন্দ্রের রাজ্যাধিকার নিয়ে অনেক বিতর্ক ও মামলা মোকদ্দমা হয়েছিল।কাছাড়ের রাজার ক্ষেত্রে এরকম কিছু না ঘটলেও গোবিন্দচন্দ্রের রাজত্বকালে ছিল দুর্যোগের ঘনঘটা।মণিপুরী ও মগদের আক্রমণে তিনি ছিলেন ব্যতিব্যস্ত।হয়েছিলেন রাজ্যভ্রষ্ট। এক সময় ব্রিটিশদের আশ্রিত হন তিনি।ব্রিটিশদের এক করদ রাজ্যে পরিণত হয় কাছাড়।শেষপর্যন্ত অবশ্য গুপ্ত ঘাতকের হাতে মৃত্যু ঘটেছিল কাছাড়ের রাজা গোবিন্দচন্দ্রের। যুদ্ধে মৃত্যুভয় ছিল রাজার।একদা গণৎকার বলেছিল অস্ত্রাঘাতে মৃত্যু ঘটবে তাঁর।তাই গোবিন্দচন্দ্র যুদ্ধ বিগ্রহ এড়িয়ে চলতেন।বহির্শত্রুর আক্রমণের মুখে রাজ্য ছেড়ে চলে গেছেন,ইংরেজদের শরণাপন্ন হয়েছেন।যুদ্ধের মুখোমুখি না হয়ে রয়েছেন নিরাপদ দূরত্বে।তবুও কাছাড়রাজের মৃত্যু ঘটেছিল গুপ্ত ঘাতকের বর্শার আঘাতে।

সেই তুলনায় বীরচন্দ্রের লড়াইটা ছিল অন্যরকম। বঙ্গদেশে ইংরেজ আধিপত্য।পার্বত্য ত্রিপুরার স্বাধীন সত্তা থাকলেও চাকলা রোশনাবাদের জন্য ত্রিপুরার রাজা ইংরেজ অধীনস্থ এক জমিদার।কিন্তু স্বাধীন রাজাও ইংরেজদের নানা চাপের মুখে।তাঁর রাজধানীতে বসানো হয় পলিটিক্যাল এজেন্ট। ইংরেজ সরকার নানাবিধ নির্দেশ পাঠায়।এছাড়াও রাজসভার আভ্যন্তরীণ দলাদলিতো আছেই। তবুও এক আশ্চর্য দক্ষতায় বীরচন্দ্র সমস্ত প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করে এগিয়ে যান।ইংরেজদের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয় বাদ দিলে মোটামুটি দাপটের সঙ্গেই রাজত্ব করেন তিন দশকের বেশি সময়।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র। তিনি একাধারে ছিলেন কবি,সঙ্গীতজ্ঞ,আলোকচিত্রী।তিনি ছিলেন ভারতের আলোকচিত্র শিল্প সূচনার এক পুরোধা ব্যক্তিত্ব।এই রাজাই তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথকে প্রথম অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।ভারতের তদানীন্তন সময়ের গুণী শিল্পীরা বীরচন্দ্রের দরবার আলোকিত করেছিলেন। বীরচন্দ্র ছিলেন সে যুগের একজন বিখ্যাত বৈষ্ণব কবি।তাঁর ছয়টি কাব্যগ্ৰন্হের কথা জানা যায়।গ্রন্হ সমূহ হচ্ছে 'হোরি' , 'ঝুলন গীতি' , 'প্রেম মরিচীকা','উচ্ছ্বাস' , 'অকাল কুসুম' এবং 'সোহাগ'।রাজার কাব্য সমূহ সেদিনের পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।বৈষ্ণব ভাবাপন্ন এই কবি রাজার অধিকাংশ কবিতাই ছিল বৈষ্ণব রসে সিক্ত।

রাধার রূপ বর্ণনায় কবি লিখেছেন -

" সমান ষোড়শী সমান রূপসী

নবীন মালা সঙ্গিনী সঙ্গে

অঙ্গের আভরণ কাঁচলী বন্ধন

সমান সমান বেণী ঝুলিছে অঙ্গে।"

রাসলীলা উপলক্ষ্য করে বীরচন্দ্র রচনা করেছেন-

"রসে ডগমগ ধনী আধ আধ হেরি,

আঁচল সঞে ফাগু লেই কুঁয়রী।

হাসি হাসি রসবতী মদন তরঙ্গে,

দেয়ল আবির রসময় অঙ্গে।

সুচতুর নাহ হৃদয়ে ধরু প্যারী,

মুচকি মুচকি হাসি হেরত গোরী।"

রাধাকৃষ্ণের যুগল মিলনের বর্ণনা দিয়েছেন কবি এই ভাবে-

"সযতনে আগুবাড়ি প্যারীর হাত ধরি,

আপন উরপর রাখি,

নিজকর পংকজে পদযুগ মুছই

হেরত অনিমিখ আঁখি।"

প্রিয়তমা রানি ভানুমতী দেবীর মৃত্যুর পর রাজা তাঁর শোকভার লাঘবে রচনা করেন 'প্রেম মরীচিকা' কাব্য। কবি লেখেন-

" সে সুখের দিন

আসিবেরে কবে,

শোক তাপ সব ধুয়ে,মরণের সুখ

শীতল কোলেতে,

ঘুমাব মাথাটি থুয়ে।"

প্রিয়তমা রানির মৃত্যুতে কবির শোকোচ্ছ্বাস যেন ধরা পড়ে কাব্যের ছত্রে ছত্রে-

"এই রূপ বর্ষ যাবে সুখ গেছে-হর্ষ যাবে

গিয়াছে হৃদয়ে

যাবে হতাশ জীবন। ।"

প্রিয়তমা পত্নী বিয়োগে শোকভার লাঘবে রাজা যখন 'প্রেম মরীচিকা' লিখছিলেন তখনই নাকি রাজার হাতে পৌঁছে তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথের 'ভগ্ন হৃদয়' কাব্য গ্ৰন্হটি।রাজার অন্তরে নাড়া দেয় তা। কবিকে অভিনন্দন জানাতে রাজা তাঁর সচিবকে পাঠিয়ে দিলেন কলকাতা।

বীরচন্দ্র ইংরেজদের চাপের মুখে ছিলেন। নানা ভাবে রাজার ক্ষমতা খর্ব করার চেষ্টা করে গেছে ইংরেজরা।তারা আগরতলায় পলিটিক্যাল এজেন্ট বসিয়েছে।সেই এজেন্টের সঙ্গে পরামর্শ করে মন্ত্রীও নিয়োগ করতে হয়েছে রাজাকে।শুধু তাই নয়, বীরচন্দ্রের আমলে ত্রিপুরার পূর্ব প্রান্তের সীমা অনেক সংকুচিত হয়েছিল। সে সময় কুকি বিরোধী অভিযানের নামে লঙ্গাই নদী থেকে ধলেশ্বরী নদী পর্যন্ত ত্রিপুরার ৮৫০ বর্গ মাইল এলাকা ব্রিটিশরা তাদের অধিকারভুক্ত করে নিয়েছিল। যাইহোক, এরকম পরিস্থিতির মধ্যেও বীরচন্দ্র সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন। কাব্য ও সঙ্গীত চর্চা করেছেন। আলোকচিত্র চর্চা করেছেন। বীরচন্দ্রের কঠোর সমালোচক ঐতিহাসিক কৈলাসচন্দ্র সিংহও রাজার কাব্য প্রতিভা সম্পর্কে লিখে গেছেন ,সেসব প্রকাশিত হলে বীরচন্দ্র যে বঙ্গীয় কবি সমাজে উচ্চ আসন পেতেন তাতে সন্দেহ নেই।

এবার আসা যাক কাছাড়রাজ গোবিন্দচন্দ্রের কথায়।জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কৃষ্ণচন্দ্রের মৃত্যুর পর ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে রাজা হলেন তিনি।প্রথম কয়েক বছর নিরুপদ্রবে কাটলেও পরবর্তী সময়ে বিষাদময় হয়ে উঠে তাঁর রাজত্ব।মণিপুরী ও বর্মীদের উপর্যুপরি আক্রমণে তিনি রাজ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়েন। অবশেষে ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের সঙ্গে সন্ধি করে তিনি তাদের আশ্রিত হন।রাজা বার্ষিক দশ হাজার টাকা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে কর প্রদানে স্বীকৃত হন।বদরপুরের কাছে হরিটিকরে নতুন ভাবে রাজপাট করে তিনি রাজত্ব করতে থাকেন। পরিত্যক্ত হয় প্রাচীন রাজধানী খাসপুর।

গোবিন্দচন্দ্র সংস্কৃত ভাষায় একজন সুপণ্ডিত ছিলেন বলে জানা যায়। পণ্ডিতদের মধ্যে তিনি তর্কযুদ্ধ আহ্বান করতেন। তিনি কাব্য ও সঙ্গীত চর্চা করতেন। তাঁর রচিত 'গোবিন্দ কীর্ত্তন' এবং 'মহারাসোৎসব-লীলামৃত' নামে দুটি গ্রন্হের কথা জানা যায়।রাজার কাব্য প্রতিভার কিছুটা উল্লেখ করা হচ্ছে এখানে-

"ভয়ঙ্কর তমসিনী, ঘোর জন্তু নিসেবিনী,

ইহ অনুচিত অবস্থান।

মধ্যক্ষীণা সুগোপিনী, নববন বিহারিণী,

ব্রজ প্রতি করহ প্রয়াণ।।"

রাজার অপর একটি কাব্য-

"যতেক রমণী বাশী রব শুনি বাহুলিনী সম ভেল।

সুত পতি তহি ত্যাগিয়া সবহি ঝটিতি গমন কেল।।

নাসায়ে সিন্দুর পরিহরি কেউ হার পরি কটিদেশ।

বাজন নূপুর ভুজে পইরে আউলাইয়া চাচর কেশ।।

একই নয়ানে কাজলের রেখা কিঙ্কিনী গলায়ে দোলে।

দাস কিশোর কহয়ী নাগরী মদনানুরাগে ভোলে।।"

গোবিন্দচন্দ্রের 'মহারাসোৎসব-লীলামৃত' গ্রন্হের অপর একটি কাব্য হচ্ছে-

"আমরা গোপিনী বিরহে তাপিনী।

বিদায় দিও না শ্যাম নিদয় হও না।।

ছাড়িয়া বন্ধুগণ লইলাম শরণ।

স্নেহ শূন্য বাক্য বলিও না।।"

রাজপরিবারকে কেন্দ্র করে যেমন ত্রিপুরায় মণিপুরী সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল তেমনই কাছাড়েও মণিপুরী প্রভাব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছিল রাসলীলা নৃত্যগীতি।রাজা গোবিন্দচন্দ্র সংস্কৃত রাস পঞ্চাধ্যায় অবলম্বনে রচনা করেন রাসগীতি।রাজ্যে রাসলীলা নৃত্যগীতি প্রবর্তন করেন।গোবিন্দ চন্দ্র রচিত রাসগীতি তাঁর পাণ্ডিত্যের পরিচয় বহন করছে বলে পরবর্তী সময়ের সমালোচকগণ উল্লেখ করেছেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা পূর্বতন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রও (১৭৭৩-১৮১৩ খ্রীঃ) একজন গীতিকার ছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকাল নানা ঘটনায় পরিপূর্ণ।বর্হিশক্তির আক্রমনে রাজাকে রাজধানী খাসপুর ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল উত্তর কাছাড়ের মাইবঙ। সেখানে অবস্থানকালে তিনি সঙ্গীত রচনা করেছেন। এরকম একটি সঙ্গীত হচ্ছে -

" ...আমি তোমার তুমি আমার সর্ব্বলোকে জানে।

গলার পলিতা যেন না ছাড়ে ব্রাহ্মণে।।

চৌদিকে অরণ্যের মধ্যে মাও তোমার নামটি জাগে।

কৃষ্ণচন্দ্র মহারাজে তোমার চরণ ভাগে।।"

এই রাজা বৈষ্ণব ভাবাশ্রিত দুটি সঙ্গীত গ্রন্হ 'রাসলীলামৃত' এবং 'বসন্ত বিহার' রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়।

কাছাড়ের কবি রাজা গোবিন্দচন্দ্রের জীবন দ্বীপ নির্বাপিত হয়েছিল খুবই করুণ ভাবে।মণিপুরের সিংহাসনে তখন গম্ভীর সিংহ অধিষ্ঠিত। কাছাড়রাজের উপর প্রতিশোধ স্পৃহায় তাড়িত তিনি।একদিন হরিটিকরে রাজবাড়িতেই গুপ্ত ঘাতকদের বর্শার আঘাতে প্রাণ হারালেন গোবিন্দচন্দ্র। ঘাতকরা রাজার ছিন্ন মস্তক নিয়ে পালিয়ে যাবার সময় অগ্নিসংযোগ করে গেল রাজবাড়িতে।১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা এটি। এ ভাবেই সুদীর্ঘকাল ব্যাপী কাছাড়ি রাজাদের রাজত্বের অবসান ঘটল। ১৮৩২ সালের ১৪ আগষ্ট এক ঘোষণা দিয়ে ব্রিটিশ সরকার কাছাড় অধিগ্রহণ করে।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.