গ্রাম সভা- একটি সাংবিধানিক অধিকার

প্রীতম ভট্টাচার্যী

ভারতবর্ষ একটি গ্রামভিত্তিক দেশ যেখানে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। সেইক্ষেত্রে ভারতবর্ষের সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন অনেকাংশেই গ্রামের উপর নির্ভরশীল। শহরের পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকার সার্বিক উন্নয়নের মাধ্যমেই পুরো দেশের উন্নয়ন সম্ভব। জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীজীও মনে করতেন যে ভারতবর্ষের সার্বিক উন্নয়ন তখনোই সম্ভব যখন গ্রামের উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। তিনি গ্রাম স্বরাজের উপর জোর দিয়েছিলেন যার মূল উদ্দেশ্য গ্রাম পঞ্চায়েতগুলিকে প্রশাসনিক এবং আর্থিক স্বাধীনতা দেওয়া যাতে করে পঞ্চায়েত নিজ এলাকার সমস্যাগুলি নিজেরা খুঁজে বার করে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমস্যাগুলির নিরসন করতে পারে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার স্ব-শক্তিকরনের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিশেযজ্ঞদের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়েছিল এবং এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- অশোক মেহেতা কমিটি, বলবন্ত রাই মেহেতা কমিটি, এল এম সিঙ্ঘভি কমিটি, জি ভি কে রাও কমিটি ইত্যাদি। এই কমিটিগুলির সুপারিশগুলিকে ভিত্তি করে পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ১৯৯২ সালে সংবিধানের ৭৩ তম সংশোধনী পাশ হয় এবং তা ১৯৯৩ সালের ২৪শে এপ্রিল কার্যকর হয়। এই দিনটিকে মর্যাদা দেওয়ার জন্য বর্তমানে ২৪শে এপ্রিল দিনটিকে জাতীয় পঞ্চায়েত রাজ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এই ৭৩তম সংশোধনীর মাধ্যমেই ত্রি-স্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা অর্থাৎ গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি এবং জিলা পরিষদের গঠন হয়। সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে পঞ্চায়েত গঠন, পঞ্চায়েতকে ক্ষমতা প্রদান, পঞ্চায়েত নির্বাচনে মহিলা এবং অনগ্রসর শ্রেণীর জন্য সংরক্ষণ, রাজ্য অর্থ কমিশন গঠন, ইত্যাদির বিধানও এই সংশোধনীর মাধ্যমেই শুরু হয়। এই ৭৩তম সংশোধনীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল প্রতিটি পঞ্চায়েতে গ্রাম সভার গঠন যা ৭৩তম সংশোধনীর ধারা ২৪৩ (বি) দ্বারা নির্ধারিত করা হয়েছে।

গ্রাম সভা হচ্ছে গ্রামের সকল ভোটারদের নিয়ে গঠিত সভা যার মাধ্যমে গ্রামের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উন্নয়নে পরিকল্পনা গ্রহণ এবং অনুমোদন করা হয়। এটি একটি মঞ্চ যার মাধ্যমে গ্রামের সকল স্তরের জনগণ নিজেদের সমস্যাগুলি পঞ্চায়েতের কাছে তুলে ধরতে পারে এবং তার পাশাপাশি সমস্যাগুলি নিরসনে কি ব্যবস্থা নেওয়া যায় সেইক্ষেত্রেও সমান ভূমিকা রাখে। গ্রাম সভা গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ, গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণকে শক্তিশালী করেছে। গ্রাম সভার বিনা সন্মতিক্রমে কোনও সিদ্ধান্ত পঞ্চায়েতে কার্যকর করা সম্ভব নয়। গ্রাম সভা উন্নয়নযজ্ঞে জনগণের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করেছে। বার্ষিক গ্রাম সভাতে বিগত আর্থিক বছরের পুরো আয়-ব্যয়ের হিসেব গ্রাম সভাতে পেশ করতে হয় যা স্থানীয় সরকারকে আরও স্বচ্ছ এবং মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ করছে। আমাদের রাজ্য ত্রিপুরাতে গ্রাম সভার পাশাপাশি জনগণের অংশীদারিত্বকে আরও তৃণমূলস্তরে নিশ্চিত প্রসার ঘটানোর জন্য ত্রিপুরা পঞ্চায়েত আইনের মাধ্যমে গ্রাম সংসদ গঠনের বিধান রাখা হয়েছে এবং পঞ্চায়েতে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধাভোগী সহ কাজের জায়গা ইত্যাদি নির্ধারণ করার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে গ্রাম সংসদ।

গ্রাম সভা ও গ্রাম সংসদের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারের পঞ্চায়েত মন্ত্রক এর বিধান অনুযায়ী ত্রিপুরার প্রতিটি পঞ্চায়েতে মহিলা সভা এবং শিশু সভার আয়োজন করা বাধ্যতামূলক করার মাধ্যমে মহিলাদের স্বশক্তিকরণ, শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, সুরক্ষা, সার্বিক উন্নয়ন, উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে।



গ্রাম সভা সংবিধান প্রদত্ত একটি অধিকার। যখন প্রতিটি মানুষকে গ্রাম সভা বা সংসদে কথা বলার অধিকার দেওয়া হবে, যখন জনগণের দ্বারা উত্থাপিত বিষয়গুলি নিরসনে জনগণের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, যখন গ্রামের প্রতিটি মহিলা এবং শিশুদের দাবিগুলি পেশ করার সুযোগ দেওয়া হবে তখনই একটি পঞ্চায়েতকে সার্বিক ভাবে উন্নত করা সম্ভব। জনগণের সার্বিক অংশীদারিত্ব উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি আর সেটা একমাত্র সম্ভব শক্তিশালী গ্রাম সভার মাধ্যমে।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.