দেশে দেশে আত্মহত্যা, অতীত ও বর্তমান
পান্নালাল রায়
কিছুদিন আগের ঘটনা।আগরতলার আমতলীর রানিখামারে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ আশ্রমে এক এগারো বছরের স্কুলছাত্রের ঝুলন্ত দেহ পাওয়া গেল শৌচালয়ে।চমকে উঠলো সবাই।জয় দাস নামে মাত্র এগারো বছরের ছেলেটি আত্মহত্যার মতো চরম পথ বেছে নিল কেন?শিলচর থেকে তার মা বাবা পড়াশোনা করতে তাকে পাঠিয়েছিল আমতলীতে।কিশোর বয়সের এই ছেলেটির পরিণতি নিয়ে নানা কথা উঠেছে।কেন এমনটা হলো?জীবন সম্পর্কে ন্যূনতম কোনও ধারণা গড়ে উঠার আগেই কেন সে জীবনটা শেষ করে দিল?
ভারত সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মহত্যার ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে।সবচেয়ে উদ্বেগজনক খবর হল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ভারতে আত্মহত্যা এখন 'একটি জরুরি এবং গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা'য় পরিণত হয়েছে।সম্প্রতি লোকসভায় এক প্রশ্নোত্তরে প্রকাশ যে, ২০১৯ থেকে ২০২১ এই তিন বছরে দেশে আত্মঘাতী হয়েছেন ১লাখ ১২ হাজার দিন মজুর।২০১৯ থেকে মন্দা,কোভিডের কারণে কাজ হারান অসংখ্য মানুষ। কোভিড পরবর্তী পরিস্থিতিতে তাদের অনেকেই পূর্বাবস্হায় ফিরতে পারেননি।এ অবস্থায় বহু দিনমজুর আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। লোকসভায় কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী ভূপেন্দর যাদব ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য উদ্ধৃত করে আরও জানিয়েছেন,এই সময়কালে ৬৬,৯১২ গৃহবধূ, ৫৩,৬৬১ স্বনিযুক্ত ব্যক্তি,৪৩,৪২০ জন বেতনভুক ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছেন। এছাড়াও ২০১৯-২১ বছরের মধ্যে ৩৫,৯৫০ জন পড়ুয়া, কৃষিক্ষেত্রে যুক্ত ৩১,৮৩৯ জন শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন।
প্রায়ই খবরের কাগজের পৃষ্ঠার এক কোণে পড়ে থাকে গ্রাম-শহরের আত্মহত্যার খবরাখবর।কখনও কীটনাশক ওষুধ খেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ঋণগ্রস্ত কৃষক,গলায় দড়ি দেয় প্রেমে ব্যর্থ অথবা পরীক্ষায় অকৃতকার্য কিশোরী কিংবা কখনও বেকারত্বের জ্বালায় অতিষ্ঠ যুবক ঝাঁপ দেয় ট্রেনের তলায়।আবার প্রায়ই ঘটে যায় রোগে জর্জরিত বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার স্বেচ্ছামৃত্যুর ঘটনা।এরকম নানা কারণে নানা ভাবে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে চলেছে দেশে বিদেশে।সাম্প্রতিক কালে ভারতে এর মাত্রা বাড়ছে এবং জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে তা এক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।গোটা বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় আট লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে আত্মহত্যার কারণে। ২০২১ সালের তথ্যে প্রকাশ,এর মধ্যে ১ লাখ ৬৪ হাজার ৩৩ টি আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ভারতেই।২০২০ সালে সেই সংখ্যা ছিল ১৫৩,০৫২ এবং ২০১৯ সালে তা ছিল ১৩৯,০০০।পরিসংখ্যানে এটা স্পষ্ট যে,বছরকে বছর ভারতে আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েই চলেছে।ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী আগের বছরের তুলনায় ২০২১ সালে ভারতে আত্মহত্যার কারণে মৃত্যুর হার বেড়েছে ৭.২ শতাংশ।গত তিন বছরে ভারতে প্রতি এক লাখে আত্মহত্যার হার বেড়েছে ১০.২ থেকে ১১.৩। আত্মহত্যার কারণে ভারতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে মহারাষ্ট্রে।২০২১ সালে মহারাষ্ট্রে ২২,২০৭টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।তারপর রয়েছে তামিলনাড়ু,মধ্যপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ। এই তিন রাজ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা যথাক্রমে ১৮,৯২৫ ,১৪,৯৬৫ এবং ১৩,৫০০।দেখা যাচ্ছে ভারতে পুরুষদের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার প্রবণতা মহিলাদের তুলনায় অনেক বেশি।২০২১ সালের তথ্যানুযায়ী পুরুষ ও মহিলাদের আত্মহত্যার অনুপাত ৭২.৫ : ২৭.৪।আত্মহত্যার কারণ সমূহের মধ্যে রয়েছে বেকারত্ব, সম্পর্কের টানাপোড়েনে মানসিক অবসাদ ইত্যাদি।অবশ্য এই তালিকায় ছাত্র,দিনমজুর,কৃষক,শ্রমিক সবাই রয়েছে।২০২০ সালে কোভিডের কারণে দেশজুড়ে লকডাউন প্রভাব ফেলেছিল মানসিক স্বাস্থ্যের উপর।সে বছর আত্মহত্যার ঘটনা এসব কারণেও বৃদ্ধি পেয়েছিল। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর রিপোর্ট অনুসারে ২০২১ সালে যে সব আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিল তার দুই তৃতীয়াংশের কারণ ছিল বেকারত্বের জ্বালা।সাম্প্রতিক কালে কৃষকদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে।২০২০ সালে আত্মহত্যার কারণে মৃত্যুর হার যেমন কৃষকদের মধ্যে বেশি ছিল ২০২১ সালেও তা আরও বেড়ে যায়।দেশের মধ্যে মহারাষ্ট্রে কৃষকদের মধ্যে এই ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে।১৯৯৫-২০১৪ সালের মধ্যে দেশে মোট ২,৯৬,৪৩৮ জন কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।এর মধ্যে মহারাষ্ট্রেই ৬০,৭৫০ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। এরপর রয়েছে ওড়িশা,তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, ছত্তিশগড়।
আত্মহত্যার কারণে জনস্বাস্থ্য সমস্যা শুধু ভারতে নয়,সারা বিশ্বেই তা রয়েছে।উন্নত বিশ্বে তা আরও প্রকট বললে ভুল বলা হবেনা।এর ইতিহাসও অনেক পুরোনো। ইউরোপে আত্মহত্যার সর্বোচ্চ হার পরিলক্ষিত হয়েছে।গোটা দুনিয়ায় লক্ষ লক্ষ আত্মহত্যার চেষ্টার ঘটনাও ঘটে যা কিনা শেষপর্যন্ত আর সফল হয়না।তবে এদের বেশিরভাগই গুরুতর ভাবে আহত হন,পঙ্গু হয়ে পড়েন সারা জীবনের জন্য। পশ্চিমী দুনিয়ায় যুব সমাজ আর মহিলাদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি পরিলক্ষিত হয়।
পার্থক্য রয়েছে আত্মহত্যার পদ্ধতির মধ্যেও।যেখানে যে মাধ্যম সহজলভ্য সেখানে তাই বেছে নিতে দেখা যায় আত্মহননকারীদের।তবে এজন্য ফাঁসি,কীটনাশক ওষুধ ও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার সাধারণ ভাবে রয়েছে সব দেশেই। বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন, ১৫ থেকে ৩০ এবং ৭০ বছরের ঊর্ধ্ব বয়স্কদের ক্ষেত্রে বেশি ঘটছে আত্মহত্যার ঘটনা।মোটামুটি এটা দেখা গেছে যে,প্রতি এক লাখ জনসংখ্যার মধ্যে ১২ জনের মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা।ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে এর হার সবচেয়ে বেশি।মোটামুটি ভাবে বলা যায়,পৃথিবীতে যত মৃত্যুর ঘটনা ঘটে তার প্রায় ১.৫ শতাংশ আত্মহত্যার কারণে ঘটে থাকে।
সুপ্রাচীন কাল থেকেই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে আসছে।একদা প্রাচীন এথেন্স নগরীতে রাষ্ট্রের অনুমতি ব্যতিরেক আত্মহত্যায় মৃতের স্বাভাবিক সৎকারে অনুমতি ছিল না।নগরীর বাইরে জনহীন অবস্হায় হতো তার সৎকার। অবশ্য যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকদের ক্ষেত্রে তা ছিল গ্রহণযোগ্য। প্রাচীন রোমে প্রথমে আত্মহত্যার অনুমতি থাকলেও পরবর্তী সময়ে তা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এক অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়।আত্মহত্যার বৈধতা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক চলছে সুপ্রাচীন কাল থেকেই। গ্রীক দার্শনিক এরিস্টোটল যেখানে সর্বপ্রকার আত্মহত্যার নিন্দা করেছেন সেখানে প্লেটো ছিলেন এবিষয়ে দোদুল্যমান।যাইহোক, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে পশ্চিমী দুনিয়ার বৃহৎ অংশে বৈধতা পায় আত্মহনন।
এবার আসা যাক জনস্বাস্থ্য সমস্যার প্রসঙ্গে।যেহেতু এটি এক সমস্যা,তাই এর সমাধানও আছে।তবে হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা এই সমস্যা নির্মূল হয়ে যাবে এটা আশা করা যায় না।আইন করে,বৈধ বা অবৈধ ঘোষণা করে এই সমস্যার সমাধানও হবে না।এজন্য প্রয়োজন সাবধানতা,সচেতনতা,মানসিক ভারসাম্য ও অবসাদ জনিত অসুস্থতার সুচিকিৎসা এবং সর্বোপরি আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন।সামাজিক ক্ষেত্রে সম্পর্কের টানাপোড়েন,জীবনের নানা ক্ষেত্রে ব্যর্থতা,মানসিক বা শারীরিক অসুস্থতা ইত্যাদির পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আর্থিক ক্ষেত্রটি।প্রসঙ্গত বেকারত্বের জ্বালা এবং কৃষকদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করা যায়।তাই আর্থ সামাজিক উন্নয়ন এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসবের মাধ্যমে পুরোপুরি নির্মূল না হলেও আত্মহত্যার ঘটনার কিছুটা লাগাম টানা যাবে নিশ্চিত। তবে আর্থিক ক্ষেত্রটি ছাড়াও মানসিক অবসাদ এবিষয়ে এক বিরাট ভূমিকা নিয়ে থাকে।সম্প্রতি গুয়াহাটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসকের আত্মহত্যার ঘটনায় চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে।৫১ বছরের এক চিকিৎসক অধ্যাপিকার ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়েছে তাঁর নিজ বাসভবনে।মৃত চিকিৎসকের টেবিলে পাওয়া গেছে সুইসাইড নোট।তাতে এই চরম সিদ্ধান্তের জন্য তিনি কাউকে দায়ী করে যাননি।এই চিকিৎসকের স্বামীও চিকিৎসক।তাই আর্থিক প্রসঙ্গ এখানে অবান্তর।পারিবারিক সূত্রে বলা হয়েছে,মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন এই চিকিৎসক-অধ্যাপিকা।যদি তাঁর আত্মহত্যার কারণ মানসিক অবসাদ হয়ে থাকে,তবে আগরতলার আমতলীর কিশোরটির ক্ষেত্রে এর কারণ কি? মাত্র এগারো বছরেই অবসাদ এসে গেল তাঁর জীবনে?