।। ঐ উজ্জ্বল দিন ।।

অরিন্দম নাথ

আমার আলমা ম্যাটার বিবিআই । ধর্মনগরের বীর বিক্রম ইনস্টিটিউশন । আমরা মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলাম ১৯৭৮ সালে । এর দুই বছর আগে আমাদের স্কুলে কো-এডুকেশন চালু হয় । একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণীর জন্য । এর আগে পর্যন্ত বিবিআই ছিল চিরকুমার সভা । এমনকি আমরা কোন দিদিমনিকেও পাইনি । আমরা ছিলাম মাধ্যমিকের তৃতীয় ব্যাচ । এর আগের দুটো ব্যাচের ছাত্ররা পড়াশুনায় ভীষণ ভালো ছিল । প্রথম ব্যাচের পরাগদা অর্থাৎ পরাগ বরণ ভট্টাচার্য বোর্ডে স্ট্যান্ড করেন । পরাগদা মাধ্যমিকে তৃতীয় হয়েছিলেন । দ্বাদশেও তৃতীয় হন । এখন সম্ভবত গুজরাটের একটি মেডিকেল কলেজে পড়ান । দ্বিতীয় ব্যাচের অলক চক্রবর্তীও স্ট্যান্ড করেছিলেন । যতদূর মনে আছে দ্বাদশে দশম হয়েছিলেন । একজন প্রকৌশলী হিসেবে অবসরে এসেছেন । তিনি খুব ভালো গান গাইতেন । বিশেষ করে তাঁর গলায় :

"ঐ উজ্জ্বল দিন, ডাকে স্বপ্ন রঙীন,

ছুটে আয় রে লগন বয়ে যায় রে মিলন বীন,

ওই তো তুলেছে তান - শোনো ওই আহ্বান।"

গানটি স্কুলের যেকোনও অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী সংগীত হিসাবে রিজার্ভ ছিল । তুলনায় আমাদের ব্যাচে কোনও আউটস্ট্যান্ডিং ছেলে ছিল না । তবে সবাই মধ্য-মেধার ঊর্ধ্বে ছিলাম । বাকিটা বাঁদরামি দিয়ে মিটিয়ে দিতাম । বিশেষ করে নিচের ক্লাসে । নীল-ডাউন হওয়া কিংবা বেঞ্চের উপর দাঁড়ানোকে আমরা প্রাইড মনে করতাম । জোড়ায় জোড়ায় নীলডাউনের মজাই ছিল আলাদা । দরজার সামনে একজনের পিঠে অন্যজনের পিঠ ঠেকিয়ে নীলডাউনে খুব মজা লাগতো । উৎসাহী দর্শকদের ভেংচি কাটা যেত । কখনও সখনও বেত্রাঘাতও পড়তো । সঙ্গে শিক্ষকদের আদর মিশ্রিত গালি ।

মাধ্যমিকে আমাদের কেউ স্ট্যান্ড করেনি । সবাই পাস করেছিলাম । ডিভিশনের সংখ্যা আনুপাতিক হারে আগের দু বছরের বরাবর ছিল । আমার উপর কেউ কেউ হয়তো ভরসা করতেন । সবচেয়ে বেশি নাম্বার পেলেও দিল্লি অনেকটা দূরে ছিল ।আমাদের ব্যাচের ছাত্রদের একতা ছিল উল্লেখ করার মত । দ্বাদশে সায়েন্সের ক্লাসে সাতজন মেয়ে সহপাঠিনী পেয়েছিলাম । এরমধ্যে নন্দিতা ভট্টাচার্য প্রাইমারি ক্লাসে আমার সঙ্গে পড়তো । পরে সে কলেজেও আমার সহপাঠিনী হয় । অন্যরা আমার অপরিচিত । ওই সময় আমি এক অদ্ভুত আরষ্টতায় ভুগতাম । মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে জড়তা বোধ করতাম । আমার অন্য বন্ধুদের কথা বলতে পারব না, অনেকেরই হয়তো কমবেশি এরকম আরষ্টতা ছিল । আমার কোন প্রাইভেট টিউটর ছিল না । ফলে ক্লাসের বাইরে মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা কিংবা কথা বলার সুযোগ ছিল না । তবে ঘরোয়া পরিবেশে মা-মাসি, কাকিমা এবং বোন সম্পর্কের মেয়েদের সঙ্গে কথা বলায় কোনও অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম না ।

এই সাতজন সহপাঠিনীর বাইরে আমরা একজন দিদিমণিকে পেয়েছিলাম । যতদূর মনে আছে তাঁর নাম ছিল তাপসী পাল । তিনি বায়োলজি পড়াতেন । ম্যাডাম ছোটখাটোর মধ্যে খুবই সুন্দরী ছিলেন । মিষ্টি করে দেখতে । বিশেষ করে গায়ের রং ছিল টুকটুকে ফর্সা । বয়সে হয়তো আমাদের চেয়ে খুব একটা বড় ছিলেন না । আমাদের প্রাকটিক্যাল ক্লাসও করাতেন । অনেক সময় তাঁর মুখে একটি আরক্ত ভাব লক্ষ্য করতাম । তাঁর লজ্জার কারন কি জানতাম না । আমরা তাঁকে নাম দিয়েছিলাম 'টিনটিন' । বোর্ডের পরীক্ষার সময় তাঁর প্রিয় একজন প্রফেসর এক্সটার্নাল হয়ে এসেছিলেন । অপর্ণা ম্যাডাম । ফলে আমাদের খুব ফায়দা হয়েছিল ।

এহেন আমরা, মেয়েদের নিয়ে একটি ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিলাম । আমাদের ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন তিনজন । প্রদীপ চৌধুরী । বিকাশ বরণ ভট্টাচার্য বা বিকিউব । সুরেশ চন্দ্র চক্রবর্তী । তিনি আমাদের প্রধান শিক্ষক ছিলেন । তাঁর বেশ কয়েকটি নিকনেম পড়েছিল । সিআরপি । কারণ সিআরপির মত লম্বা ছিলেন । সঙ্গে কদমছাট চুল । সারাক্ষণ একটি বেত নিয়ে ঘুরতেন । যদিও কারো পিঠে বেত পড়ত না । আরেকটি নাম ছিল বিশপ । কারণ তিনি অদ্ভুত নাটকীয় ভঙ্গিতে 'বিশপস ক্যান্ডেলস্টিকস' পড়াতেন । বেশি প্রচলিত ছিল হ্যাডুস্যার নাম । আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন । কারণ আমি একাদশ-দ্বাদশে বিজ্ঞানের পেপারগুলোর ইংলিশ মিডিয়ামে উত্তর করতাম । আমাদের পড়ানোর মাধ্যম ছিল বাংলা । স্কুলের সাংসদ নির্বাচনের সময় আমি ইংরেজিতে ভাষণ দিয়েছিলাম । ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে দেখি তিনি দাঁড়িয়ে আছেন । মনোযোগ সহকারে আমার ভাষণ শুনেছিলেন । খুব অ্যাপ্রিসিয়েট করেছিলেন । পুলিশের চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর বার তিনেক তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল । শিবনগর এলাকায় । প্রতিবারই আমি পা ছুঁয়ে নমস্কার করি । তিনি দুহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে ড্রেসের দিকে তাকিয়ে দেখতেন । বলতেন যে পুলিশের পোশাকে আমাকে দারুন দেখায় । তিনি চার্লস ডিকেন্সের ডেভিড কপারফিল্ড পড়াতেন তাঁর স্বকীয় ভঙ্গিতে । নাটক করে । প্যান্ট কোমর থেকে নেমে যেত । একহাতে ধরে রাখতেন । ইনসিস্ট করতেন সিম্পল সেন্টেন্স লেখার জন্য । ইংরেজিতে কিছু লিখতে গেলে আজও তাঁর প্রভাব অনুভব করি ।

আমাদের পোয়েট্রি ও প্রোজ পড়াতেন প্রদীপ চৌধুরী স্যার । হাংরি জেনারেশনের কবি । তিনি এখন প্রয়াত । তাঁর মধ্যে আমরা মাইকেল মধুসূদন দত্তকে দেখতাম । তিনি আমাদের মননে ডিরোজিয়ের ঝড়ের মত প্রভাব ফেলেছিলেন । স্যারের একটি ডায়লগ ছাত্র মহলে খুব প্রচলিত ছিল । তিনি তখন ফোর্সড ব্যাচেলর । স্ত্রী পুত্র অন্য শহরে । স্যারকে কলা বিভাগের কোন এক সুন্দরী ছাত্রীর সঙ্গে নাকি দুই এক জায়গায় দেখা গিয়েছিল । এই নিয়ে শুরু হয় ফিসফিসানি। তাঁর কানেও সেই কথা পৌঁছায় । তিনি একটি সার্বজনীন উক্তি করেন, "এই যে শুয়োরের বাচ্চারা ! আমার নামে কুৎসা রটাচ্ছে । তারা জানে না আমার একটি বউ আছে । সুন্দরী । একটি ছেলেও আছে । দ্বিমিত্রী ... ।"

আমাদের ছোট্ট রক্ষণশীল শহরের জন্য স্যার ছিলেন বেমানান । তিনি অর্থ বই বা নোটস বুকের কাছ দিয়েও যেতেন না । ইংরেজি কবিতার প্রতিটি লাইনের একাধিক ভাব ব্যক্ত করতেন । আমাদের উৎসাহিত করতেন চিন্তার সংযোজন করার জন্য । তাঁর মত শিক্ষক পাওয়া সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার ।

বিকিউব ছিলেন বেঁটেখাটো । পান খেতেন । টিফিনের পরের পিরিয়ডে তাঁর ক্লাস পড়তো । এর আগে সম্ভবত ক্যারাম খেলতেন । ক্লাসরুমে ঢুকতেন ঝড়ের বেগে । ব্রেক-নেক স্পিডে । তারপর টেবিলের উপর বসে বা হেঁটে আমাদের ইংরেজি গ্রামার পড়াতেন । আমরা ভালোই পারতাম । ফলে পিরিয়ডের শেষ দিকে গল্প করতেন । সেদিন ছিল শুক্রবার । কিছুটা অফ বিট কথা বললেন । কখনো মনে হলো দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ । কখনো মনে হল কমনরুমে কারো সঙ্গে তর্ক করে এসেছেন । মোদ্দাকথা তাঁর বক্তব্য ছিল

প্রকৃতির মধ্যে অন্তর্নিহিত স্ব-বিরোধ বর্তমান । এই স্ববিরোধের ফলে বস্তুজগতের পরিবর্তন ও বিকাশ ঘটে । পরস্পর-বিরোধী কিছু কাজের উদাহরণ দিলেন । আমার বিচারে, এমনিতেই বেঁটে লোকেরা একটু হীনমন্যতায় ভোগে । তাই নিজেদের ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে । খুব দ্রুত কথা বলে । দ্রুতলেয়ে অনেক কথা বলে গেলেন । তালা লাগানো হয় কেন ? খোলার জন্য ? জল ঢালা হয় কেন ? খেয়ে খালি করার জন্য । জল গরম করা হয় কেন ? ঠান্ডা করে তাপ অনুভব করার জন্য। স্কুলে আসা হয় কেন? স্কুল থেকে ফিরে যাওয়ার জন্য । আমরা খাই কেন ? খিদে নিবৃত্তির জন্য ? ইত্যাদি সিত্যাদি ।

পরদিন টিফিনের ঘন্টা বাজলে মেয়েরা চলে গেল তাদের কমনরুমে । কয়েকজন মিচকে শয়তান সক্রিয় হল । তাদের বাড়িঘর ছিল স্কুলের কাছাকাছি । মেয়েদের রঙিন ছাতাগুলি সিলিং ফ্যানের সঙ্গে সুন্দর করে বাঁধলো । খুবই সুন্দর ডেকোরেশন হল । ঠিক যেমন দুর্গা পূজার প্যান্ডেলে আজকাল ছাতা ঝুলিয়ে সাজসজ্জা করা হয় । ইতিমধ্যে টিফিন শেষের ঘন্টা বাজল । আমরাও যে যার বেঞ্চে বসে পড়লাম । মেয়েরাও নিজেদের সীটে বসলো । প্রায় সবাই হতবিহ্বল । শুধু নন্দিতাকে দেখলাম মিটিমিটি হাসছে । সে অংকে ভাল ছিল। হয়তো এরমধ্যে কোন জ্যামিতির সূত্র খুঁজে পেয়েছিল ।

বিকিউব সুপারসনিক স্পিডে ক্লাসে ঢুকলেন । পরক্ষণেই তাঁর নজর গেল উপরের দিকে । তিনি ব্রেক কসলেন । এবাউট টার্ন হয়ে কমনরুমের দিকে চলে গেলেন । ছাত্ররা তখন বলছে, "ছাতা ফ্যানে লাগানো হয় কেন ? খোলার জন্য ।"

এরমধ্যে হ্যাডু স্যার এলেন । সঙ্গে বিকিউব। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে রইলাম । একে একে সবাইকে কালপ্রিটদের নাম জিজ্ঞেস করলেন । সঙ্গে ভোকাল টনিক । সবাই নিরুত্তর রইলো । সবশেষে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন । সবার ভয় ছিল আমি হয়তো বলে দেব । আমি মাথা নেড়ে বললাম জানিনা । স্যার খুব মর্মাহত হলেন । আদেশ হল, যতদিন না ছাত্ররা দোষীদের নাম বলবে ততদিন পর্যন্ত ক্লাস টুয়েলভের সায়েন্স ক্লাস সাইনে-ডাই থাকবে । আমরা মাথা নত করে বেরিয়ে গেলাম । তবে একত্রিত রইলাম । সবাই বললো, "ছাতা ফ্যানে লাগানো হয় কেন ? খোলার জন্য ।"

ততক্ষণে দপ্তরি এসে ছাতা খুলে নিয়েছে । মেয়েরা তাদের ছাতা পেয়ে গেছে । স্যারেরা চেষ্টা করলেন অন্যভাবে দোষীদের নাম বের করার জন্য। বিশেষতঃ যারা প্রাইভেট পড়তে যেত তাদের থেকে জানার চেষ্টা করলেন। কিন্তু সফল হলেন না । কমনরুমে কয়েকদিন লাগাতর মিটিং বসলো । উদ্দেশ্য আমাদের ব্যাচের ছাত্রদের বাগে আনা । গার্জিয়ানরা সম্ভবতঃ পরোক্ষে চাপ দিচ্ছিলেন । শেষ পর্যন্ত চতুর্থ কিংবা পঞ্চম দিনে অচল অবস্থার অবসান হয়। আমাদের প্রিয় স্যার সুনির্মল সোম এবং বিকাশ ভট্টাচার্য (বিকিউব নন) ছাত্রদের হয়ে ওকালতি করেন । এরমধ্যে সরস্বতী পূজা পড়েছিল । আমাদের যখন পূজার চাঁদা দেওয়ার কথা উঠলো, অনেকে নিমরাজি হয়ে রইলো । ক্লাস টিচার অমল ভট্টাচার্য স্যার বললেন চাঁদা দেওয়া না দেওয়া অপশনাল । সবাই সেবছর নাস্তিক হয়ে গেল । আবার পঠন-পাঠন শুরু হল । একসময় টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে আমরা স্কুল থেকে বেরিয়ে গেলাম । সেটা ছিল জুনের দাঙ্গার বছর । অনেকে দুবার পরীক্ষা দিয়েছিল ।

আমাদের ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রীরা রাজনীতি ছাড়া ডাক্তারি, ইন্জিনিয়ারিং থেকে শুরু করে সব মুখ্য পেশায় কাজ করার সুযোগ করে নিয়েছে । দুজন সর্বভারতীয় সেবায় কাজ করার সুযোগ পেয়েছে । সর্বোপরি সৎ নাগরিক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.