।। তৃতীয় নয়ন ।।

অরিন্দম নাথ

গতকাল আমার মৌতাত এসেছিল। অনেকটা দিন পর। আপনাদের অনেকেরই আমার মৌতাত সম্পর্কে ধারণা আছে । যারা জানেন না, তাঁদের জ্ঞাতার্থে কয়েকটি কথা ৷ আমার শরীরে একটি অ্যানামলি আছে ৷ প্রথমে জানতাম না ৷ কয়েক বছর হল বুঝতে পেরেছি ৷ আমার লিভার থেকে কখনও সখনও এক বিচিত্র এনজাইম ক্ষরণ হয় ৷ এনজাইম হচ্ছে জারক-রস । এর প্রভাবে শর্করা জাতীয় খাবার মাদকে পরিণত হয় ৷ আমার পেটের ভেতরে । ফলে অজান্তেই আমি বেশ নেশার আমেজ পাই ৷ মৌতাত আসে । এমনি মৌতাতের মুহূর্তে পৌঁছে যাই বিধাতার দরবারে ৷ এইভাবে কয়েক দফা সফর করেছি ৷ যার বর্ণনা অন্যত্র দিয়েছি ৷ তবে এই সুবাদে বিধাতা এবং তাঁর সারাক্ষণের দুই সহচরের সঙ্গে আমার সখ্যতা হয়ে গেছে ৷ মানিকজোড় । শুম্ভ-নিশুম্ভ । আসলে দুই যমজ ভাই ৷ অসুরের মত চেহারা ৷ ব্যবহার কিন্তু অমায়িক ৷ আগের জন্মে এঁদের একজন ছিলেন অংকের প্রফেসর ৷ অপরজন কলেজে পদার্থ বিজ্ঞান পড়াতেন ৷ দুই জনেই ছিলেন ডক্টরেট ডিগ্রিধারী । চিত্রগুপ্ত বিধাতার এক্সিকিউটিভ স্টাফ ৷ তিনি এবং তাঁর সহকর্মীদের মর্ত্য-ফেরত লোকদের আত্মার মধ্য থেকে নিয়োগ করা হয় ৷ সে যাক। এবারের কথায় আসি ।

বিধাতাকে দেখি ভীষণ খোশ মেজাজে । শুম্ভ-নিশুম্ভ এবং চিত্রগুপ্ত সমভিব্যাহারে গল্প করছেন । তাঁদেরকে ভীষণ রিলাক্সড লাগছিল । আমাকে দেখে বিধাতা বলে ওঠলেন, "এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে! কহ বৎস তোমার সমাচার ?"

আমি বিধাতাকে 'মেঘনাদবধ কাব্য' থেকে উদ্ধৃতি দিতে দেখে অবাক হই । আমার মনে আসে, কবি এখানে বিভীষণের বিশ্বাসঘাতকতায় লক্ষ্মণের নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে প্রবেশের ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন । পরক্ষণেই অপ্রস্তুত অবস্থা সামলে নিয়ে উত্তর দিই, " প্রভু ! আপনি ঠিকই ধরেছেন । আমি বিষাদগ্রস্ত । 'প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন, তবু প্রাণ কেন কাঁদে রে...'। রোজ মোবাইলে দুটো তিনটে করে সিনেমা দেখি । বোকা বাক্সের সামনে বসে সময় কাটে । সৃষ্টিশীল কিছুই মনে আসে না ।"

- কেন তুমিতো পত্র-পত্রিকা, গল্প, সাহিত্য পড়!

- প্রভু আপনি অন্তর্যামী ! আমি সুখী তবে বিষণ্ন ।

- সেটা কি রকম ?

- সুখ-দুঃখ আমার কাছে আপেক্ষিক বিষয় । দুঃসময়ে সময় কাটতে চায় না। মানুষ যখন বুঝতে পারে না তার সময় কিভাবে কেটে যাচ্ছে, তখনই সে প্রকৃত সুখী । আমার মনে হচ্ছে আমার দিনগুলি খুব দ্রুত কেটে যাচ্ছে । শুধু যেন অপারেশনাল এক্সপেন্ডিচার করে যাচ্ছি । রেকারিং খরচা মিটিয়ে যাচ্ছি । কোন ক্যাপিটাল এক্সপেন্ডিচার করছি না । ফলে কোন অ্যাসেট তৈরি হচ্ছে না ।

- কেন তোমারতো বৈষয়িক উন্নতি হচ্ছে !

- সে ঠিক। লিভিং স্ট্যান্ডার্ড বেড়েছে । পাশাপাশি মানসিক শক্তি যেন পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে পড়েছে । চাকুরীতে থাকাকালীন জীবনটাকে রেল সফর মনে করতাম ।

- তুমি আগেও উল্লেখ করেছ।

- ঠিক। বিভিন্ন ধরনের রেলযাত্রীর সহচর্য পেয়েছি । ভালো-খারাপ । তখন এক রকম বাধ্যবাধকতা ছিল । প্রথমে ভীষণ আগ্রহ লাগতো । যাত্রা যত এগিয়েছে অন্তরে গন্তব্যে পৌঁছার তাগাদা অনুভব করতাম । শেষের দিকে কামরার ভিতরের এবং বাইরের পরিবেশ অসহনীয় বোধ হত । অথচ, উগ্রপন্থার দিনগুলোতে, যখন বৈরীরা ট্রেনের উপর গুলি ছুড়ত । গ্রেনেড ফেলত । তখন এতটা অসহায় মনে হত না । বেশ একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব বিরাজ করত ।

- তোমার ব্যাখ্যা বেশ ইন্টারেস্টিং শুনাচ্ছে !

- এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার । সেই যুদ্ধ ছিল ন্যায়ের সঙ্গে অন্যায়ের । শৃঙ্খলার সঙ্গে উশৃঙ্খলতার । সত্যের সঙ্গে অসত্যের । নৈতিকতার সঙ্গে অনৈতিকতার । সুরের সঙ্গে অসুরের । আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে মেকি ধর্মাচরণের । খুব উপভোগ করতাম । সবসময় সামনে থাকতাম । আমি ছিলাম প্রথমপক্ষে । এই লড়াই চিরন্তন । আমি আমার গন্তব্যে নেমে যাওয়ার পড়ও লড়াই চলছে । শেষের দিকে আত্মবিশ্বাসে চরম ঘাটতি দেখা দিয়েছিল । বিশেষতঃ আমাদের নেতৃত্বের মধ্যে বিভীষণ প্রবৃত্তি বিরাজ করত । হয়তো বিপরীত ধারায়।

- তুমি সুন্দর একটি আত্মবিশ্লেষণ করেছ। বিশেষতঃ 'এই লড়াই চিরন্তন', তোমার উপলব্ধিকে সাধুবাদ জানাই । কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার পরও এই বিষাদ কেন ? এখনতো তুমি চাপমুক্ত!

- প্রভু, আক্ষরিক অর্থে কথাটি ঠিক । বাস্তবে বেঠিক। এই লড়াই করতে গিয়ে দেশের সংবিধান অনুযায়ী চলতে হয়। যার মুখ্য ভূমিকা পালন করে ট্রেনের যাত্রীরা । যাত্রা সম্পন্ন করার পর মনে হচ্ছে সমীকরণ পাল্টে গেছে । হতে পারে, আমার মনের ভুল । এতদিন যা নজরে আসেনি অনেক প্রাক্তন সহযাত্রীকে অন্যায়ের সঙ্গে আপস করতে দেখি । লোক দেখানো লড়াই করে । বিশেষত ড্রাগসের বিরুদ্ধে । পুলিশের চোখ হওয়াতে নজরে আসে। যেন সর্ষের মধ্যে ভূত । মেলামেশা করতে ভয় হয় । সমাজের বিভিন্ন পেশার লোকদের মধ্যেই সেটা দেখতে পাই ।

- এটাও লড়াইয়ের একটি পর্যায় !

- এর থেকে উত্তরণের পথ কি ?

- উপায় তোমাদেরকেই বের করতে হবে ।

- কেন আপনি তো আমাদের সৃষ্টিকর্তা ! কোন ম্যানুয়েল নিশ্চয়ই থাকবে।

- তোমরা কি আমার সৃষ্টিকে অটুট রেখেছ ? একটি প্রশ্ন করছি । আত্মার সৃষ্টি কিভাবে হয়েছিল ?

- সেটাতো আপনাকে আমার করার কথা !

- তবুও দেখতে চাইছি তুমি কি ভাব ?

- ছোটবেলায় আমরা এই নিয়ে মজা করতাম । নিউটনের চতুর্থ সূত্র বানিয়ে ছিলাম । সেটা অশ্লীল। আপনার সামনে উচ্চারণ করব না । সেই সূত্রের আলোকে বলছি । দুইটি বিপরীত সত্তার অসাবধান মিলনে প্রথম আত্মার সৃষ্টি হয়েছিল ।

- বেশ, তোমার দেওয়া সংজ্ঞাই মেনে নিচ্ছি । কারণ সৃষ্টির আদি অবস্থায় যাওয়া এখন সম্ভব নয় । অসাবধানে সৃষ্টি ।কোন ম্যানুয়াল কেউ লিখে যায়নি । মুনি-ঋষি থেকে শুরু করে আধুনিক বিজ্ঞানীরা সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে অনেক কিছু লিখে গেছেন । এরমধ্যে পরস্পর বিরোধী মতবাদও থাকতে পারে । তুমি কোনটা গ্রহণ করবে সেটাতোমার বিচার ।

- ঠিক!

- তুমি কোন মতবাদ বিশ্বাস কর ?

- অবশ্যই ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন মতবাদ ।

- কেন ?

- এর মাধ্যমে সৃষ্টির সম্পর্কিত অধিকাংশ প্রশ্নেরই কনভেন্সিং ব্যাখ্যা দেওয়া যায় ।

- তাহলেতো হয়েই গেল !

- না হয়নি ! বিবর্তন অনুযায়ী মানুষ থেকে উন্নত প্রাণী সৃষ্টি হওয়ার কথা । কিন্তু বাস্তবে বিবর্তন যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে ।

সেটা কেন ?

- আসলে তোমাদের আগুন আবিষ্কার । চাকার আবিষ্কার । ভাষার আবিষ্কার । বিদ্যুতের আবিষ্কার । মারণাস্ত্রের আবিষ্কার । কম্পিউটারের আবিষ্কার ইত্যাদি বিবর্তনের গতিপথ পাল্টে দিয়েছে । মানুষ তার জীবনযাত্রার উন্নতি ঘটিয়েছে । এর সাথে সাথে প্রকৃতির ইকো সিস্টেমকে নষ্ট করে দিচ্ছে । নির্বিচারে গাছপালা এবং অন্য প্রাণীদের ক্ষতি করছে । অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আরও অনেকগুলো বিলুপ্তির পথে ।আগে গড়ে সাত- আট বছর পর পর এল নিনো হত । এখন খুব ঘনঘন হচ্ছে । পৃথিবী অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টিতে ভুগছে । তোমাদের বিজ্ঞানীরাই বলছেন বিগত কয়েক বছরে ভূগর্ভের জল উত্তোলনের কারণে পৃথিবীর অক্ষ প্রায় এক মিটার হেলে পড়েছে । ভূগর্ভের এই জল সৃষ্টির সময় স্ফটিক হিসেবে জমা হয়েছিল । এর পরিপূরণ সম্ভব নয় । মানুষই মানুষের সর্বনাশ ডেকে আনছে । সৃষ্টি তাই আজ বিপন্ন । এক পা এগিয়ে, দুই পা পিছিয়ে পড়ার প্রবণতা।

- তাহলেতো চিত্রগুপ্তের দোকান বন্ধ হয়ে যাবে !

আমার কথায় শুম্ভ-নিশুম্ভ ও চিত্রগুপ্ত হেসে উঠে । এতক্ষণ ওরা নীরব ছিল। চিত্রগুপ্তের হয়ে বিধাতাই উত্তর দেন, "এমন পরিস্থিতি হলে বলবে। এখানে প্রতিটি প্রাণীর ম্যানুফ্যাকচারিং এবং এক্সপায়ারিং ডেট লিখে রাখার রেওয়াজ । সেটা করা হয় তোমাদের ডিএনএ প্রোফাইলিং এর মত একটি পদ্ধতিতে ।"

- গুগল প্লের স্ক্যানিঙের মত ?

- তা বলতে পার!

বিধাতার কথায় আমি উজ্জীবিত বোধ করি। ভাবতে থাকি প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি প্রাণীর, উদ্ভিদের কোষের ডিএনএ-র পাশাপাশি একটি স্ক্যানিঙ কোড থাকে । কখনও কখনও কাকতালীয়ভাবে সেটা স্ক্যান হয়ে যায়। আমরা অপরের মনের কথা জানতে পারি। টৈলিপ্যাথিক ভিশন । অতীন্দ্রিয় দূরানুভূতি । এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির কাছে বার্তা পৌঁছে যায় । আমাদের তৃতীয় নয়ন । আনন্দের আতিশয্যে আমি স্থান কাল পাত্র ভুলে যাই । আমার মৌতাত টুটে যায় ।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.