হ্যালিকোবেক্টর পাইলরি সংক্রমনঃ গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের কারন
ডঃ দেবলীনা দেব বর্মন, হিস্টোপ্যাথোলজিস্ট ও ল্যাব ইনচার্জ ( ইউনিটি )
সারা বিশ্বে প্রতিবছর ১০ লক্ষেরও বেশি মানুষ গ্যাস্ট্রিক অথবা পেপটিক আলসার এ আক্রান্ত হচ্ছেন। পাকস্থলীতে আলসার বা ক্ষত সৃষ্টি হওয়ার প্রথম কারণ হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরির সংক্রমন। ৮০% পেটের ক্ষতর মূলে এইচ. পাইলরি রয়েছে। বিভিন্ন জীবানু, ধূমপান , উপোশ, মানসিক উত্তেজনা থেকেও আলসার হতে পারে। কয়েক দশক পূর্বে ব্যারী ও মার্শালের নোবেল জয়ী গবেষনার কারনে চিকিৎক মহল এই খলনায়কের খোঁজ পান।
পেটে বেশি মাত্রায় অ্যাসিড তৈরি হলেই এই সমস্যা হয়। আলসার হয় পাকস্থলীর ও ক্ষুদ্রান্ত্রের ভেতরের দেওয়ালের স্তরে। পাকস্থলীর রক্ষায় পাতলা শ্লেষ্মার যে স্তর থাকে, তা হ্রাস পেলে দেখা দেয় আলসার। সাধারণ ভাবে ক্ষুদ্রান্তের প্রথম ভাগে এই রোগ হয়।
এই রোগের বেশ কিছু লক্ষণ খুব সাধারণ। বুকজ্বালা, পেটের উপরের দিকে যন্ত্রণা, খাওয়ার পরে পেট ফুলে থাকা বা পেট ফেঁপে থাকা, মুখ দিয়ে টক-নুন জল ওঠা, গা বমি ইত্যাদি মূলে পেপটিক আলসার হলেও হতে পারে। রক্তাল্পতা ও মলে রক্তক্ষরনের মত ভয়াবহ উপসর্গ ও কিছু সংখক ক্ষেত্রে দেখা দেয়। আরও একটি বিষয় জেনে রাখা ভাল, গ্যাস্ট্রিক আলসার কিছু ক্ষেত্রে উপসর্গবিহীন হতে পারে। গত সপ্তাহে প্রতিবেশী রীনাদি ডিওডিনাম আলসার ধরা পরেছে। বিগত কিছু সপ্তাহ ধরে নাকি দীর্ঘক্ষণ উপবাসে বুকে ও পেটে জ্বালা করত। স্থানীয় ফার্মাসী থেকে গ্যাসের ওষুধ খেয়েও শেষ রক্ষা হয় নি। গতকাল ইউনিটি তে এন্ডোস্কোপি করায় ধরা পরল রোগটি। যাক, ১৪ দিনের কোর্সেই ঠিক হয়ে যাবে। ৬ সপ্তাহর বেশী উপসর্গ থাকলে তখন বাজারের চলতি ওষুধ না খেয়ে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। পেট ফেঁপে যাওয়া ও কিন্তু আলসারের লক্ষণ। এসব উপসর্গ টানা চললে একদম অবহেলা নয়। দীর্ঘ সময় অপ্রয়োজনীয় গ্যসের ওষুধের পার্শ প্রতিক্রিয়া তো রয়েছেই। খাবার হজমের জন্য পাকস্থলী আ্যসিড তৈরি করে, বিশেষত খাদ্যের প্রোটীন অংশ।
আমাদের রাজ্যে পেটের ক্যান্সার ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। উপজাতি অংশের লোকেদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি। বয়স্কদের মধ্যে প্রাদূর্ভাব অধিক হলেও যে কোন বয়সেই হতে পারে আলসার। এইতো আমাদের মেডিকেল স্টুডেন্ট ২২ বছরের সুজিত, মৃদুভাসি ও মেধাবী ছাত্র, পড়াশোনা নিয়েই থাকতো। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে ওর অনবরত পেটে ব্যথা হয় এবং কিছু খেলেই বমি ভাব হতো বলে আসে আমাদের ইউনিটির গ্যাস্ট্রো বিভাগে পরামর্শ নিতে। একটা মাঝারি সাইজের গভীর আলসার পাকস্থলিতে পাওয়া যায়। বায়োপসিতে রিপোর্ট করতে গিয়ে ভাবলাম এ কি দেখছি! এতো ছোট বয়সে ক্যান্সার। ১০০% নিশ্চত না হয়ে এ ধরনের রিপোর্ট করা যায় না। কিন্তু রোগীর উপসর্গ ও এনডোস্কোপিষ্ট এর রিপোর্ট ক্যান্সারের দিকেই ইশারা করছিল। ঘরের রান্নার চেয়ে রাস্তার পাশের ঠেলা পরিবেসিত মসলাযুক্ত এবং সুস্বাদু খাবারের লালসা নিবারন 'নেক্সট জেনদের' ( বর্তমান প্রজন্ম ) জন্য প্রায় অসম্ভব। আজকাল ব্যস্ত জীবনে ফাস্টফুড শুধু শখ ই নয়, সাময়িক ভাবে অনিবার্য হয়ে পরে। দীর্ঘ দিনের সংক্রমন বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে আলসার ও শতকরা ২-৩ জন রোগীর ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। শুরুতে গবলেট সেল মেটাপ্লাসিয়া , ডিস্প্লেসিয়া এবং পরবর্তীকালে সংক্রমন নির্মুল না হলে ক্যান্সারের রূপ ধারণ করে। প্রাথমিক স্তরে শনাক্ত করতে পারলে বহু ক্ষেত্রে ওষুধ ও ক্ষুদ্র ( এন্ডোস্কোপির মাধ্যমে) সার্জারীর মাধ্যমে নিরাময় সম্ভব। বহু সংখক রোগী এই ধরনের প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে পুরোপুরি আরোগ্য লাভ করেছেন। তাই পেটে ব্যথা হলে শুধু গ্যাসের ওষুধ খেয়ে নিজেদের অন্ধকারে রাখবেন না। সুজিত কি একটু অবহেলা করে ফেলল না ? চিকিৎসা বিজ্ঞান কি আর একচু উন্নত হবে না ? এন্ডোস্কোপির বিকল্প কি কোন পরিক্ষা নেই ? থ্রী ইডিয়েটস্ চলচিত্রে 'বিজ্ঞানের' নামে খেতে এসে যুবকটি ধরা পরলে ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিকাশের ধারা কে অব্যহত রাখার দায়িত্ব আজকের চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের। পুঁথিগত জ্ঞানের বাইরে ব্যাতিক্রমী চিন্তা ধারা চিকিৎসার নতুন আবিস্কারকে জন্ম দিতে পারে ও অনেক সুজিতের প্রাণ রক্ষা করতে পারে।
* লেখিকা হিষ্টোলজী ও গ্যাস্ট্রো প্যাথলজী বিশেষজ্ঞ