।। কৃষ্ণ-কলঙ্কেরি জ্বালা ।।

অরিন্দম নাথ

বিশাল ইমারত । ছয় তলা । মাটির নিচেও একতলা । কার পার্কিং । পর্যাপ্ত পরিমাণ লিফট । মুহুর্মুহু উঠানামা করছে । সারাক্ষণের ব্যস্ততা । হাসপাতাল বিল্ডিং । ডাক্তার । স্বাস্থ্য-কর্মী । সহায়ক কর্মী । রুগী । রুগীর আত্মীয়-স্বজন । শুভানুদ্ধায়ী । ব্যবসায়ী । এমনি লোকের ভিড় । তবে নিয়ন্ত্রিত ।

ভদ্রলোক অসুস্থ থাকেন । মাঝ বয়স পেরিয়েছে । তবে এযাত্রা তিনি রুগী নন । তাঁর স্ত্রী অসুস্থ । শল্য চিকিৎসকের চিকিৎসাধীন । একটি অপারেশন হয়েছে । ছেলে বাইরে থাকে । সে আসার জন্য বায়না ধরেছিল । তাকে আশ্বস্ত করা হল, "চিন্তার কারণ নেই । তোর জীবনের প্রথম আবাসটি একটু খারাপ হয়ে গেছে । একটি অংশ ভেঙ্গে ফেলা হবে । দু-এক দিনের মধ্যে ছুটি দিয়ে দেবে ।"

সে আসার পক্ষেই ইচ্ছে প্রকাশ করলো । আবারও বলা হল, তারাহুরোর কারণ নেই । সুস্থির হয়ে আসতে । একটি কেবিনে স্থান মিলেছে । চার তলায় । খুবই আকর্ষণীয় পজিশনে । জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখা যায় । ভীষণই মনোরম । এখানে এখনও আশপাশ অনেকটা মুক্ত । উঁচু ইমারত কম । সুন্দর বনানী । বিশেষত ফুলে ভরা কৃষ্ণচূড়া গাছগুলি সারাক্ষণ নজর কেড়ে রাখে । এমন একটি রুম পেয়ে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই খুশি । আশা, দ্রুত আরোগ্য হবে । তাঁরা দুটো পাস পেয়েছেন । একটি সারাক্ষণের জন্য । রুগীর সঙ্গে একজন থাকার । অন্যটি সকাল ন'টা থেকে রাত্রি সাতটা অবধি ভিজিট করার । দ্বিতীয়দিন বিকেলবেলা । তিনি নীচে লবিতে বসেছিলেন । বেশ কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব এসেছেন । তাঁর স্ত্রীকে দেখতে । দুটো পাস কাজে আসছিল । পালা করে দর্শনার্থীরা রোগীর কাছে যাচ্ছিলেন । সহমর্মিতা জ্ঞাপন করছিলেন । সঙ্গে দ্রুত আরোগ্য কামনা ।

ঢুকতেই লক্ষী-নারায়ণের মূর্তি । পূজার জায়গা । পুরোহিত দৈনিক নির্ঘণ্ট মেনে পূজা করেন । তখন সন্ধ্যা বেলা । পুরোহিত পূজা করছিলেন । সঙ্গে খুব সুন্দর ঘন্টার আওয়াজ । একটা দারুন ছন্দ ‌। তাঁর মনে হচ্ছিল সম্ভবত মোবাইলে ইউটিউবের সাহায্য নিয়েছেন । বন্ধুর কাছে সেই সন্দেহ প্রকাশ করলেন । তারাও সহমত পোষণ করলেন । তথাপি এক বন্ধু ওঠে গিয়ে দেখলেন । আসলে পুরোহিত একহাত দিয়ে ঘন্টাটি বাজাচ্ছিলেন । অন্য হাত দিয়ে পূজা দিচ্ছিলেন। তবে ঘন্টার মধ্যে কিছু একটা স্পেশালিটি থাকবে ‌। যান্ত্রিক আওয়াজটার মধ্যে অন্য শব্দের অনুরণন । সবমিলিয়ে প্লিজিঙ । এক বন্ধু বললেন, সব হাসপাতালেই এরকম মূর্তি পূজা হয় । তিনিও তা দেখেছেন ।

তাঁর মন চলে গেল স্যোসাল মিডিয়ায় পাওয়া একটি অডিও ক্লিপিংসে । মোবাইল ঘেঁটে সেটি আবার শুনলেন । এপিজে আবদুল কালাম তাঁর অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করছিলেন । দুই হাজার নয় সালের পহেলা জানুয়ারির কথা । তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে ডক্টর শৈলেশ মেহতার । বরোদার বিখ্যাত কার্ডিয়াক সার্জন । ঊনসত্তর বছর বয়স । দীর্ঘ চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতা । তাঁর অধীনে বিভিন্ন শহরে কমপক্ষে একশোজন ডাক্তার কাজ করেন । এর কয়েকদিন আগে ডিসেম্বরে শেষ দিকে ডঃ মেহেতার একটি অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছে । একদিন ছয় বছরের একটি বাচ্চা মেয়েকে তাঁর সামনে নিয়ে আসা হল । মেয়েটির হার্টের সমস্যা । তার কেইসহিস্ট্রি দেখে বুঝতে পারলেন মেয়েটির আয়ু বড়জোর আরও একমাস । অপারেশন করতে হবে । অপারেশনে সাকসেস হওয়ার সম্ভাবনা ত্রিশ শতাংশ । মেয়েটির অভিভাবকদের তিনি বললেন । তাঁরা মেয়েটির দ্রুত অপারেশনের জন্য মতামত দিলেন । অপারেশন টেবিলে নিয়ে যাওয়ার আগে ডঃ মেহেতা মেয়েটিকে কাউন্সিলিং করছিলেন । হঠাৎ, মেয়েটি বলল, "আঙ্কেল, তুমি আমার হার্ট খুলবে! মা বলেছে আমাদের হার্টে ভগবানের বাস । তুমি ভগবানকে দেখে রাখবে । আমি যদি সুস্থ হই, আমাকে বলবে । ভগবান কেমন দেখতে ।"

মেয়েটির কথায় ডঃ মেহতা কিছুটা আবেগগ্রস্থ হয়ে পড়লেন । তিনি মেয়েটিকে কোনও সান্ত্বনা দিতে পারলেন না । যাহোক অপারেশন টেবিলে হৃদয় উন্মোচন করলেন । আধঘন্টা ধরে অনেক চেষ্টা চরিত্র করলেন । সফল হলেন না । হৃদপিন্ডে কোনও রক্ত চলাচল নজরে এলো না । এই অবস্থায় রক্তনালিকার রিপেয়ার করা অর্থহীন। তিনি সহযোগী ডাক্তারদের বললেন স্টিচ করার জন্য । আর তখনই তাঁর মনে এলো মেয়েটির শেষ কথাগুলো । তিনি বললেন, আমি আবার একটু তাকিয়ে দেখি । আবার খোলা হল । তখন দেখা গেল হৃদপিন্ডে রক্ত চলাচল শুরু হয়েছে । দ্রুত চিকিৎসা করলেন । আরও প্রায় চার ঘন্টা লাগলো অপারেশন শেষ করতে । তারপর মেয়েটি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলো । ডঃ মেহতার বিশ্বাস, সে অন্তত আরো ষাট বছর বাঁচবে । সুস্থ হয়ে মেয়েটি তাঁকে জিজ্ঞেস করল, "আঙ্কেল ভগবান কিরকম দেখতে ?"

- বেটি! তাঁকে দেখা যায় না । শুধু অনুভব করা যায় ।

ঘোর কাটিয়ে ভদ্রলোক ভাবছিলেন এই যে লক্ষ্মীণারায়ন মূর্তির কথা । এটাই কী ভগবানের স্বরূপ ? তাঁর বয়স ষাট পেরিয়েছে । আজকাল অসুস্থ থাকেন । একটি বড় অপারেশন হয়েছে । মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন । তিনি তখন হাসপাতালে ছিলেন তাঁর স্ত্রী মরণপন সেবা করেছিলেন । এখন তাঁর স্ত্রী অসুস্থ । প্রথম রাতে স্ত্রীকে সঙ্গ দিতে পারেননি । তাঁর অসুস্থতার কথা ভেবে স্ত্রী সম্মতি দেননি । দ্বিতীয় রাতে তাঁর নজরুলের একটি গানের পঙক্তি মনে এলো :

"তুমি যদি রাধা হতে শ্যাম

শ্যাম তুমি যদি রাধা হতে শ্যাম।"

তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, এই অভিজ্ঞতা হারালে চলবে না । তাঁর স্ত্রীর সাথে কেবিনে রয়ে গেলেন । সেখানে আলাদা একটি বিছানা ছিল ‌। রুমটি যথেষ্ট বড় । জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে প্রকৃতির নৈসর্গিক রূপ ধরা দিল । অদ্ভুত রকমের সুন্দর । তাঁদের সম্প্রতি ইউরোপে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল । কিন্তু অসুস্থতার কারণে এবং দেরিতে অনুমতি আসায় যাওয়া হয়নি । ইনফ্যাক্ট যেদিন অপারেশন হলো সেদিনই তাঁর স্ত্রী জানতে পারলেন দপ্তরের অনুমতি মিলেছে। দুজনে এই অপার্থিব সৌন্দর্য উপভোগ করছিলেন । তাঁদের মনে হলো তাঁরা যেন বিদেশের কোন রিসোর্টে অবস্থান করছেন ।

গভীর রাত্রিতে তাঁর ঘুম ভেঙ্গে গেল । তাঁর স্ত্রী তখন ঘুমে । তিনি বাইরের প্রকৃতির দিকে আবার তাকালেন । বৈদ্যুতিক আলো এবং চাঁদের আলো মিলে সিম্ফনি রচনা করেছে । কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো যেন হাসছিল । তাদেরই রাজ । তিনি কৃষ্ণচূড়া ফুলকে রাধা প্রতিভূ ভাবেন । মেঘ যেন শ্যাম । কৃষ্ণ কালো । কিন্তু আকাশেতে কালো মেঘের দেখা নেই । গ্রীষ্মের উত্তপ্ত দিনের রাত্রি । তিনি আবার নজরুলের গানে ফিরে এলেন :

"কৃষ্ণ-কলঙ্কেরি জ্বালা,

মনে হ'ত মালতী-মালা।।

চাহিয়া কৃষ্ণ-প্রেম জনমে জনমে।।

আসিতে ব্রজধাম।।"

কবি কেন বললেন, 'কৃষ্ণ-কলঙ্কেরি জ্বালা' । এই প্রকৃতির সঙ্গে সাজুয্য খোঁজার চেষ্টা করেন । তাঁর মনে আসে রবি ঠাকুরের কবিতার একটি লাইন : "মরণ রে, তুঁহু মম শ্যামসমান।"

মরণ এবং শ্যাম সমতুল্য । মৃত্যু এবং কৃষ্ণ এক। তাই কি কলঙ্কেরি জ্বালা ? তিনি তাঁর ভাবনাকে এগিয়ে নিয়ে যান । শ্যামের সঙ্গে জরাকে মেলান । জীবনের সমীকরণ তাঁর অনেক সহজ মনে হয় । আমাদের জীবন যেন একটি জলভরা গ্লাস । কারো দিকে যখন তাকাই বলতে পারি না, জীবন সম্পূর্ণ না অর্ধপূর্ণ ! তবে নিশ্চিত বলতে পারি আংশিক পূর্ণ । আংশিক খালি আমরা জন্মদিন পালন করি । প্রশান্তি অনুভব করি । সাথে সাথে কিন্তু জরা বা বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে যাই । শ্যামের দিকে আকৃষ্ট হই । রাধা তাই দৃশ্যমান প্রকৃতি । এখানে রাধারই রাজ । বিপরীতে জরা । বার্ধক্য জরার জয়গান । কৃষ্ণ তাই কলঙ্কের জ্বালা ।



ভদ্রলোকের স্ত্রী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.