রবীন্দ্র স্নেহধন্য নৃত্য শিক্ষক নীলেশ্বর

পান্নালাল রায়

কৈশোরে যিনি রবীন্দ্রনাথকে নাচ দেখিয়ে পুরস্কার পেয়েছিলেন,যৌবনে যিনি শান্তিনিকেতনে মণিপুরী নৃত্যশিক্ষক ছিলেন,একদিন সাক্ষাত পেয়েছিলাম রবীন্দ্র স্নেহধন্য সেই নীলেশ্বর মুখার্জীর।শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে প্রথম সাক্ষাতে কবি তাঁকে বলেছিলেন,'মন দিয়ে শিখিয়ে দিস,লুকোচুরি করিসনা কিন্তু।'

মশাউলি ত্রিপুরার এক নিস্তরঙ্গ গ্রাম।পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা মণু।দু'পাশে যেমন আছে উর্বরা শষ্যভূমি আর নবান্ন,তেমনই মাঝেমধ্যে আছে খরা-বন্যায় অজন্মার পদধ্বনিও।নদীর তীর ঘেষে হাঁটতে হাঁটতে একদিন সন্ধ্যায় হাজির হয়েছিলাম নীলেশ্বর মুখার্জীর বাড়িতে।সে প্রায় অর্ধশত বছর আগেকার কথা।ঘরের মেঝেতে লণ্ঠনের আলোয় বসেছিলাম পৌঢ় মানুষটির মুখোমুখি।গুরুদেব এবং শান্তিনিকেতনের কথা তুলতেই তিনি যেন ঝলসে উঠেছিলেন।মুহূর্তেই ফিরে গিয়েছিলেন নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদার যুগে।

ত্রিপুরা-সিলেটে মণিপুরী নৃত্য দেখে রবীন্দ্রনাথ প্রবল ভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন।আলোড়িত হয়েছিল কবির নৃত্যচেতনা।তিনি শান্তিনিকেতনের শিক্ষা ধারায় নৃত্যচর্চা সংযোজন করেছিলেন। অবশ্য নৃত্য তখন সাধারণ শিক্ষিত বাঙালি সমাজে ব্রাত্য। তাই সেদিন শান্তিনিকেতনে 'নৃত্য'কে বলা হয়েছিল 'সাংগীতিক ব্যায়াম'।যাইহোক,অনেক বিরূপ সমালোচনার মধ্যেও নৃত্যচর্চার এক ভিত্তি সেদিন তৈরি হয়ে গিয়েছিল শান্তিনিকেতনে।বাংলাদেশে অপেশাদারি নৃত্যচর্চার সূত্রপাত ঘটে এ ভাবেই। শান্তিনিকেতনের নৃত্য ধারায় মণিপুরী নৃত্য সংযোজনে ত্রিপুরার এক বিশেষ ভূমিকা ছিল।সেখানকার শিক্ষা ব্যবস্থায় নৃত্য প্রবর্তনের কথা চিন্তা করে রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরা থেকে কয়েকজন নৃত্য শিক্ষক নিয়ে গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে।প্রথমে রাজকুমার বুদ্ধিমন্ত সিংহ,তারপর একে একে ঠাকুর নবকুমার সিংহ,নীলেশ্বর মুখার্জী,বসন্ত সিংহ,রাজকুমার চন্দ্রজিৎ সিংহ প্রমুখ। তারা সেদিন শান্তিনিকেতনের নৃত্য ধারায় মণিপুরী নৃত্য সংযোজনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। আর এসবের ফলশ্রুতিতে মণিপুরী নৃত্যশৈলীর মাধুর্যও ছড়িয়ে পড়েছিল বৃহত্তর অঙ্গনের রসিকজনের কাছে।

১৩২৬ বঙ্গাব্দে মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোর রাজকুমার বুদ্ধিমন্তকে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়েছিলেন। তিনি গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে ছেলেদের নৃত্য শিক্ষা দিয়েছিলেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথও সেসময় নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সকলকে উৎসাহ দিতেন।নৃত্যানুশীলন পর্যবেক্ষণ করতেন।বুদ্ধিমন্তকে শান্তিনিকেতনে পাঠাবার জন্য কবি রাজার কাছেও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন। যে ছাত্রদল সেদিন বুদ্ধিমন্তের কাছে নৃত্য শিক্ষা নিত সেই দলে শান্তিদেব ঘোষও ছিলেন।শান্তিনিকেতনে নৃত্য শিক্ষার গোড়াপত্তন ঘটেছিল এই বুদ্ধিমন্ত সিংহের মাধ্যমেই।১৩৩২ বঙ্গাব্দে ঠাকুর নবকুমার নৃত্য শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন শান্তিনিকেতনে।মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্র কিশোর রাজপরিবারের নৃত্য শিক্ষক নবকুমারকে পাঠিয়েছিলেন সেখানে।শান্তিনিকেতনের নৃত্য ধারায় মণিপুরী নৃত্য কৌশল সংযোজনে ঠাকুর নবকুমারের ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে আছে।'নটির পূজা' ও 'শাপমোচন'-এ নৃত্য রচনার ক্ষেত্রে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল।কবির পরিকল্পনা আর নবকুমারের উদ্যম মিলে সেদিন এক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে গিয়েছিল। শান্তিনিকেতনের এই নৃত্য ধারা নিঃসন্দেহে পুষ্ট করেছে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকেও।সব মিলিয়ে শান্তিনিকেতনের নৃত্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল ভূমিকা ছিল ঠাকুর নবকুমারের। 'শাপমোচন' নৃত্যনাট্য দল নিয়ে কবির সিংহল সফরের সময় নবকুমারও ছিলেন সেই দলে।শুধু তাই নয়,নবকুমারের কাছে নাচ শেখাকে দুর্লভ সুবিধা বলে কবি তাঁর কনিষ্ঠা কন্যার কাছে এক পত্রে উল্লেখ করেছিলেন।

এবার আসা যাক নীলেশ্বর মুখার্জীর কথায়।১৯৩৫ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে যোগ দেন।তবে বুদ্ধিমন্ত কিংবা নবকুমারের মতো নীলেশ্বর রাজপরিবারের মাধ্যমে শান্তিনিকেতনে যাননি।সেখানে তিনি কাজের সুযোগ পেয়েছিলেন কবিগুরুর ব্যক্তিগত সচিব অনিল চন্দের মাধ্যমে।কবি তখন চিত্রাঙ্গদা মঞ্চস্হ করার ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করেছিলেন। এই চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যের সঙ্গে বিশেষ ভাবে জড়িয়ে আছে নীলেশ্বর মুখার্জীর নাম।১৮৯২ খ্রীস্টাব্দে কাব্যনাট্য 'চিত্রাঙ্গদা' প্রকাশের ৪৪ বছর পর ১৯৩৬ সালে নবরূপ পায় 'চিত্রাঙ্গদা' নৃত্যনাট্য। কলকাতার নিউ এম্পায়ার থিয়েটারে ১৩৩৬ সালের ১১-১৩ মার্চ এটি প্রথম মঞ্চস্থ হয়। তারপর কবিগুরু ৭৫ বছর বয়সে স্বয়ং অভিনয়ের এই দল নিয়ে উত্তর ভারত সফর করেন।বিভিন্ন শহরে মঞ্চস্থ হয় এই নৃত্যনাট্য। নীলেশ্বর মুখার্জী এই দলে ছিলেন। ১৯৩৮ সালে পূর্ব বঙ্গে মঞ্চস্থ হয় 'চিত্রাঙ্গদা'। তখনও দলে ছিলেন নীলেশ্বর।

বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সম্প্রদায়ের কুলিন ব্রাহ্মণ নীলেশ্বর মুখার্জীর জন্মভূমি শ্রীহট্টের ভানুগাছ সংলগ্ন বালিগাঁও।পড়াশোনা শ্রীহট্টের কমলগঞ্জ,ত্রিপুরার কৈলাসহর এবং পরবর্তী সময়ে শিলচর।খোলবাদক হিসেবে যৌবনে চারদিকে নাম ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর। মণিপুর গিয়ে তিনি মৃদঙ্গবাদন সহ সঙ্গীত শিক্ষা লাভ করেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে বৈষ্ণব পদাবলী গানের সঙ্গে সুরারোপ প্রভৃতি বিষয়ে তিনি অভিজ্ঞ হয়ে উঠেন।ত্রিপুরা-শ্রীহট্ট অঞ্চলের মণিপুরী সমাজে গায়ক বাদক হিসেবে নীলেশ্বর তখন এক উজ্জ্বল নাম।এক সময় আমন্ত্রণ পেয়ে ত্রিপুরার রাজদরবারেও তিনি প্রতিভার সাক্ষর রাখার সুযোগ পেয়েছিলেন। নীলেশ্বরবাবুর শান্তিনিকেতনে যোগদানের আগে রয়েছে এক পশ্চাৎপট। ১৩২৬ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে সিলেট সফরকালে রবীন্দ্রনাথ মণিপুরী তাঁতে শিল্প নৈপুণ্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। শহর উপকণ্ঠে টিলার উপর কবি যে বাংলো বাড়িতে অবস্থান করছিলেন তাতে দরজায় টানানো পঞ্চাশ বছরের পুরনো একটি মণিপুরী তাঁতে তৈরি আচ্ছাদন বস্ত্র দেখে কবি প্রথম আকৃষ্ট হন।মণিপুরীদের শিল্প নৈপুণ্যের পরিচয় পেয়ে কবি তাদের জীবনযাত্রা প্রণালী এবং তাঁত দেখার প্রবল ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তারপর সিলেটের মণিপুরী পল্লী মাছিমপুর পরিদর্শন করেন কবি। সেখানে মণিপুরী বালকদের রাখালনাচ উপভোগ করেন তিনি। এই নাচের অগ্রনী ভূমিকায় ছিলেন নীলেশ্বর। সেখানেই কবির সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ।কবি খুশি হন নাচ দেখে।নগদ পাঁচ টাকা দিয়ে পুরষ্কৃত করেন নীলেশ্বরকে।মাছিমপুরে মণিপুরী মেয়েদের তাঁতে বোনা কাপড় দেখে পছন্দ হওয়ায় সেখান থেকে কিছু কিনেও এনেছিলেন কবি।রাতেও মণিপুরী ছেলে মেয়েরা বাংলোতে এসে নাচ দেখিয়েছিল কবিকে।

যাইহোক, নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদায় এক বিশেষ ভূমিকা ছিল নীলেশ্বরবাবুর।কবিগুরুর স্নেহ স্পর্শে শান্তিনিকেতনে কয়েকটি বছর কাটিয়েছেন তিনি।ছিলেন নৃত্য শিক্ষক। এমনকি শান্তিনিকেতনের সেই দিনের ছাত্রী ইন্দিরা গান্ধীও তাঁর কাছে নাচের তালিম নিয়েছিলেন। বিভিন্ন সংগীতে মণিপুরী নৃত্য কৌশল সংযোজনেও তাঁর অবদান ছিল।এই কাজে শান্তিদেব ঘোষও তাঁর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। যে মঞ্চ সজ্জার দায়িত্বে ছিলেন নন্দলাল বসু,কবিগুরু যে মঞ্চের সামনে বসেছিলেন সেই মঞ্চে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা চিরদিন নীলেশ্বরবাবুর মনের মনিকোঠায় উজ্জ্বল ছিল। কয়েক বছর কাজের পর নীলেশ্বরবাবু অসুস্থ হয়ে শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে আসেন দেশের বাড়িতে।এরপর আর নানা ঝামেলায় সেখানে ফিরে যাওয়া হয়নি।১৯৫০ সালে তিনি সপরিবারে চলে আসেন কৈলাসহর মহকুমায়।বসবাস করতে থাকেন কাঞ্চনবাড়ির মশাউলি গ্রামে।আমৃত্যু সেখানেই ছিলেন। শেষ বয়সেও ব্যস্ত ছিলেন নৃত্যগীত নিয়ে।তাঁর মুখেই শুনেছি মাসিক ত্রিশ টাকা বেতনে শান্তিনিকেতনের কাজে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। পরে বেতন আরও দশ টাকা বেড়েছিল।মন দিয়ে শেখাতে বলেছিলেন কবিগুরু।গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি তাই করে গেছেন।শুধু শান্তিনিকেতনের কয়েকটি বছরে নয়,কবিগুরুর কথা মনে রেখেছিলেন সারাটা জীবন।মশাউলি গ্রামে জীবন সায়াহ্নেও তিনি নৃত্যগীতের চর্চা করে গেছেন। শিক্ষা দিয়েছেন বহু ছাত্রছাত্রীকে।তাঁর বাড়ির উঠোনের মন্ডপ সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাক্ষ্য বহন করছে।সকাল সন্ধ্যায় অনেক ছাত্রছাত্রী আসত।নীলেশ্বরবাবু তাদের দরদ দিয়ে শেখাতেন।১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বরে অনন্ত ঘুমের দেশে পাড়ি দেন রবীন্দ্র স্নেহধন্য চিত্রাঙ্গদার এই কুশলী শিল্পী।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.