১৯৭১ - হলুদ পাতার ভাঁজে ইতিহাস কথা বলে
পিয়াল সরকার
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। এই লেখা সেই মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ভাসা ভাসা স্মৃতি নিয়ে। আমাদের মধ্যে কারো কারো মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ অভিজ্ঞতা অথবা ধারণা আছে। তখন আমি খুবই ছোট, বয়েস বছর ছয়েক। তাও কিছু স্মৃতি এখনও মনের মাঝে আছে।
থাকতাম ত্রিপুরা রাজ্যের তেলিয়ামুড়া নামে এক ছোট শহরে। বাবা বন বিভাগে চাকরি করতেন। বিভাগের কার্যালয় ও কর্মীদের সরকারি বাসস্থান ছিল নদীর ধারে ঘিরে দেওয়া একটা এলাকার মধ্যে। ত্রিপুরার সঙ্গে পরিচিত না হলে 'খোয়াই' শব্দটা শুনলে শান্তিনিকেতনের কথা মনে আসে। তবে ত্রিপুরা রাজ্যে খোয়াই নামে একটা শহর আছে যেটা খোয়াই নামে নদীর তীরে। তেলিয়ামুড়া শহরও একই নদীর ধারে। সেখানকার বন বিভাগের দপ্তর ছিল খোয়াই নদীর ঠিক পাশেই।
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় বাড়িতে বাড়িতে ট্রেঞ্চ (trench) এবং / অথবা বাঙ্কার (bunker) তৈরি করা হয়েছিল। কারা বানিয়ে দিয়েছিলেন মনে নেই। তৈরি করতে কুশলী ও অভিজ্ঞ অর্থাৎ সেনা বাহিনীর সদস্যরাই স্থানীয় মানুষদের সাহায্য করেছিলেন খুব সম্ভবত। আমাদের বাসার পেছনে ইংরেজি "V" অক্ষরের আকারে ট্রেঞ্চ (trench) কাটা হয়েছিল। পরিবারে আমরা ছিলাম তিন জন। সদস্য সংখ্যা বেশি হলে ট্রেঞ্চ (trench) হত "W" অথবা অন্য কোনো ইংরেজি অক্ষরের মত।
আমরা ওই বয়েসেই কাঁচের জানালা ঢেকে দেওয়ার কাজে বড়দের সাথে হাত লাগিয়েছিলাম যাতে রাত্রিবেলা বাড়ির বাইরে আলো না আসে। খবরের কাগজ কেটে কেটে জানালার কাঁচ ঢাকা হয়েছিল।
এক বিশেষ দিনের কথা আমার আজও মনে পড়ে। স্কুল থেকে ফিরেছি দুপুর বেলা। রেডিও চলছিল। দেড়টার সময় আকাশবাণী দিল্লি কেন্দ্র থেকে বাংলা খবর শুরু হল..."আকাশবাণী, খবর পড়ছি অনিল চট্টোপাধ্যায়"। উনি দিল্লি থেকে সেই সময় ভরাট গলায় নিয়মিত বাংলা খবর পড়তেন। একই নামে বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেতা অন্য মানুষ। বিশেষ বিশেষ খবর শুরু হল কিছুটা এই ভাবে "... সীমান্তে লড়াই বেঁধে গেছে..."।
এর মধ্যেই এক দিন রাজ্যের রাজধানী আগরতলা শহরে শেল (Shell) পড়ার খবর শোনা গিয়েছিল। কিছু মানুষজন দেখতে পান তাঁদের মাথার ওপর দিয়ে কামানের গোলা যাচ্ছে। সন্ত্রস্ত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা ঘরে ফেরার চেষ্টা করেন। পরে জানা যায় নানা ঘটনা। শেলের স্প্লিন্টার (Splinter) ছিটকে ছিটকে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই স্প্লিন্টার এসে পড়েছিল কিছু বাড়ির দেওয়ালে। বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর চেয়েও অনেক বেশি মর্মান্তিক ছিল ছিটকে লাগা স্প্লিন্টারের আঘাতে মানুষের জীবনহানির খবর। কিছু পরিবার সেই ক্ষত বহন করে চলেছেন বহু দিন, বহু বছর।
আগরতলা শহর তখন নিরাপদ ছিল না। তাই অনেকেই উদয়পুর বা রাজ্যের অন্যান্য অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থানে আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি চলে যেতে বাধ্য হন। আমার অনেক বন্ধুই বেশ কিছু দিন এভাবে নিজেদের বাড়ি থেকে দূরে ছিল। সম্প্রতি অতিমারীর জন্য অনেক দিন স্কুল কলেজ বন্ধ ছিল, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরীক্ষা নেওয়া যায়নি। ১৯৭১ সালেও আমাদের স্কুল (ও বড়দের কলেজ) বন্ধ করতে হয়েছিল, সেই বছরের বার্ষিক পরীক্ষাও হয়নি।
এই বিভীষিকাময় স্মৃতিকথার মধ্যেই একটা ছোট মজার গল্প বলি। শুনেছি ওই শেল পড়ার দিন জন্ম বলে একটি মেয়ের নাম রাখা হয়েছিল শেলী, শেল (Shell) শব্দ থেকে। পরে ভদ্রমহিলা নিজের নাম বদলে নিয়েছিলেন বলে শুনেছি।
সেই সময় ভারতের সেনা বাহিনীর প্রধান ছিলেন ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ (Field Marshal Sam Manekshaw)। তাঁর নাম সবার মুখে মুখে ঘুরত। বাড়ির বড়রা তাঁকে নিয়ে প্রচুর আলোচনা করতেন। ছোট্ট আমি নামটা যেন শুনতাম মানিকশ। ওই বয়সে কোনটা নাম, কোনটা পদবী সেই সব কিছুই ভাল করে বুঝতাম না। আমার নিশ্চিত ধারণা ছিল, ওঁর বাড়ির লোক ওঁকে 'মানিক' বলে ডাকেন কারণ মানিকশ যখন নাম, ডাকনাম তো মানিক হতেই হবে। সাত রাজার ধন যে 'মানিক' আমাদের মন প্রাণ জুড়ে আছেন অর্থাৎ সত্যজিৎ রায়, সেই মানিকের নাম জেনেছি আরো বছর দুয়েক পরে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশর জীবন অবলম্বনে একটি চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে। "স্যাম বাহাদুর" নামে ছবিটির পরিচালক মেঘনা গুলজার। নামভূমিকায় অভিনয় করছেন ভিকি কৌশল। ছবিটির মুক্তি পাওয়ার কথা ২০২৩ অর্থাৎ এই বছরের ডিসেম্বর মাসে।
সেই সময় যাঁরা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি থাকতেন, তাঁদের হয়ত মনে পড়বে - আকাশে যুদ্ধ বিমান, সেনা বাহিনীর কর্ম তৎপরতা। রাতের পর রাত নিকষ কালো অন্ধকার অর্থাৎ ব্ল্যাকআউট (blackout), শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বহু দিন বন্ধ...
সময় চলে যায়। পঞ্চাশ বছরের বেশি পার হয়ে গেছে। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সেই সব শিশুসুলভ হালকা হালকা স্মৃতি মাঝে মাঝেই ফিরে ফিরে আসে - হলুদ পাতার ভাঁজে ইতিহাস কথা বলে।