ত্রিপুরায় রবীন্দ্র বিরোধিতা
শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিন্দুকের অভাব কম নয়! তাঁর চরিত্র, পরিবার, বংশ, দেশপ্রেম, সাহিত্য প্রতিভা নিয়ে বহু নিন্দা সমালোচনা হয়েছে। প্রশ্ন তোলা হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য প্রতিভা নিয়ে । তাঁকে সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবেও সব সময়ই অপদস্থ করার চেষ্টা চালানো হয়েছে । জীবদ্দশায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সাহিত্য কৃতির জন্য বঙ্গদেশের স্বীকৃতি পান নি। ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার না পেলে এই বঙ্গদেশে আজ তাঁর কী হাল হতো কে জানে ! নোবেল পাওয়ার পর বাংলার বিদ্বজ্জন সমাজ তাঁকে সম্মানিত করতে চাইলে তিনি তখন শুধু এই কথাই বলেছিলেন, ‘আমি এই সম্মানের পাত্রকে ওষ্ঠ পর্যন্ত তুলব কিন্তু গলা পর্যন্ত যেতে দেবনা’। মৃত্যুর পরেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রেহাই পান নি। আজও তাঁর বিরুদ্ধে নিরন্তর কুৎসা রটানো হচ্ছে। তবে এই সময়ে বেশির ভাগ মানুষই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধে এমন সব নিন্দা, অপপ্রচার আর কুৎসায় প্রভাবিত হন না। এসব যে আদতে এক শ্রেণীর ধান্দাবাজ লোকের অপকর্ম, তা শুধু বাংলার নয় - ত্রিপুরার জনগণও বুঝে গিয়েছে। হ্যাঁ, রাজন্য ত্রিপুরাতেও এক সময় রবীন্দ্র বিরোধিতা তুঙ্গে পৌঁছেছিল। উথলে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধে তীব্র বিষোদ্গার। এর কেন্দ্রে ছিল কিছু বাঙালি রাজ পারিষদ। সেই কথা জানতেন ঠাকুর কর্তা পরিবারের অনেকেই !
মহারাজা বীরচন্দ্রের দেহাবসানের পর ত্রিপুরার সিংহাসনে বসেন পুত্র রাধাকিশোর মাণিক্য। সময়টা ছিল ১৮৯৬ । সিংহাসনে যখন বসেন রাধাকিশোর মাণিক্যের বয়স তখন চল্লিশ ছুঁয়েছে । রবীন্দ্রনাথেরও বয়স তখন প্রায় চল্লিশ। সমবয়সী হওয়ার দৌলতে দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে সময় লাগে নি। এদিকে রাধাকিশোরের রাজত্বের ছয় মাসের মধ্যেই বিধ্বংসী ভূমিকম্পে ধ্বস্ত হয়েছিল গোটা উত্তরপূর্বাঞ্চল। কেঁপে উঠেছিল ত্রিপুরাও। ধ্বংস হয়েছিল আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা। ত্রিপুরার জনগণের তখন দুর্দশার অন্ত ছিল না। রাজ্যের এই দুরাবস্থার সুযোগ নিতে তৎপর হয়ে উঠেছিল লোভী এবং দুর্নীতিগ্রস্থ রাজ পার্ষদেরা। পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকায় রাধাকিশোর উপায়ন্তর না দেখে সুহৃদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুপরামর্শ চেয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুমিত্র রাধাকিশোর মাণিক্যকে তৎক্ষণাৎ সহায়তা করতে দ্বিধান্বিত হন নি। তিনি রাধাকিশোরের আমন্ত্রণে প্রথমবার ত্রিপুরায় এসেছিলেন। সে ১৮৯৯ সালের কথা। এরপর এসেছিলেন আরও ছয়বার। আবেক্ষণ করেছিলেন ত্রিপুরার পরিস্থিতি। ত্রিপুরার রাজ প্রশাসনের বিভিন্ন বিচ্যুতি স্পষ্ট হয়ে উঠে তাঁর সামনে। স্বভাবসুলভ কাব্যগত আবেগকে দূরে সরিয়ে প্রিয় সুহৃদের স্বার্থে ত্রিপুরার রাজনীতির জটিলাবর্তে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। সঙ্গত কারণেই তাঁর মনে হয়েছিল "স্বরাজ্যে পারিষদবর্গ কর্তৃক বেষ্টিত থাকিয়া স্বেচ্ছাধীন রাজকার্যে যথার্থ মহত্ত্বলাভ করা কঠিন।" কেননা পার্ষদেরাই রাজাকে অনেক সময় ভুল তথ্য এবং কুবুদ্ধির দ্বারা বিপথে চালিত করে। এমন সব ভ্রষ্ট পার্ষদদের সঙ্গ ত্যাগ করাই যে রাজ্যের পক্ষে মঙ্গলদায়ক তা তিনি উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন। কেননা এদের কুমন্ত্রণাতেই বৃদ্ধি পায় রাজাদের ‘’প্রভুত্ব-বিলাস ও স্বেচ্ছাচারিতার চর্চা .. রাজধর্মের বিকার।"
তাই সংগোপিত চিঠির মাধ্যমে রাধাকিশোর মাণিক্যকে অবহিত করার জন্য লিখেছিলেন তিনি, "রাজ্যের মধ্যে দুইটি স্বাভাবিক ভাগ আছে। একটি মহারাজের স্বকীয় আর একটি রাষ্ট্রগত। উভয়কে জড়ীভূত করিয়া রাখিলে পরস্পর পরস্পরকে আঘাত করিতে থাকে। এই উপলক্ষ্যে প্রভূত অনিষ্ট উৎপন্ন হয় এবং এই দুটি বিভাগের সন্ধিস্থলে নানা প্রকার দুষ্ট চক্রান্তের অবকাশ থাকিয়া যায়।" সুতরাং এমন ভ্রষ্ট স্বার্থান্বেষী রাজ পার্ষদদের চক্রান্ত থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে তিনি মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্যকে মন্ত্রী সহ রাজ পার্ষদদের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাসের পরামর্শ দেন। তিনি এই বিষয়ে রাধাকিশোরকে লিখেছিলেন, "যাহা মহারাজের স্বকীয় -- অর্থাৎ সংসার বিভাগ, নিজ তহবিল, পরিচরবর্গ এবং মহারাজের ভ্রমণাদি ব্যাপার যাহার অন্তর্গত তাহার উপর মন্ত্রী বা আর কাহারো হস্তক্ষেপ করিবার অধিকার দেওয়া চলে না। এই জন্য মহারাজার স্বকীয় বিভাগকে মন্ত্রীর অধিকার হইতে স্বতন্ত্র করিয়া মন্ত্রীর প্রতি রাষ্ট্রবিভাগের সম্পূর্ণ ভারার্পণ করা আবশ্যক হইবে।"
রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার রাজ প্রশাসনে মন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা অস্বীকার করেন নি। তিনি শুধু চেয়েছিলেন মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্য যাতে তাঁর মন্ত্রীর ওপর মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে নির্ভরশীল না হয়ে পড়েন। একই সঙ্গে তিনি এও বুঝতে পেরেছিলেন রাজ প্রশাসকদের মধ্যেও বৈরিতা রয়েছে। মন্ত্রীর হাতে সামান্য ক্ষমতা তুলে দিলেও আর একদল তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে। ত্রিপুরায় সেই সময় তাই রাজ প্রশাসনে ভারসাম্য রক্ষা করাটা জরুরী হয়ে উঠেছিল।
অজ্ঞাত থাকে নি মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্যকে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোপন চিঠি। ত্রিপুরার রাজ প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর যারপরনাই ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে ত্রিপুরায় তখন ফেনিয়ে উঠেছিল নিন্দা আর কুৎসার ঢেউ। এমন পরিণতির কথা পূর্বাহ্ণেই আঁচ করতে পেরেছিলেন দূরদর্শী রবীন্দ্রনাথ। তিনি এরপর রাধাকিশোর মাণিক্যকে লিখেছিলেন, "মন্ত্রীর প্রতি রাজ্যভার অর্পণ করিয়া মহারাজা নিজের রাজক্ষমতার সঙ্কোচ করিতেছেন এ কথা যাহারা নানা কৌশলে ও নানা আভাসে মহারাজার মনে মুদ্রিত করিতেছে তাহারা স্বার্থান্বেষী ও মহারাজার শত্রুদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সাংঘাতিক। মঙ্গলের প্রতি লক্ষ্য করিয়া নিজের নিয়মের দ্বারা নিজকে সংযত করাই রাজোচিত। তাহাই রাজধর্ম।"
এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ স্বজন কর্নেল মহিম ঠাকুর আরও কিছু আলোকপাত করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘’ ত্রিপুর রাজ্যের মঙ্গলামঙ্গলের প্রতি রবিবাবুর আন্তরিক দৃষ্টি ছিল - মন্ত্রী নির্বাচনেও মহারাজা তাঁর মতামত গ্রহণ করিতেন। এসব ব্যাপারে লিপ্ত থাকায় এ রাজ্যের কর্মচারী মহলে তাহাঁর সঙ্গে এ রাজ্যের সম্বন্ধ লইয়া নানা কথা উঠিয়া আগরতলার মত ক্ষুদ্র স্থানকেও তোলপাড় করিত। সে জন্য কবির মনে সব সময় চাঞ্চল্য এবং রাজ্য সম্বন্ধে বীতস্পৃহ উপস্থিত হইত, কিন্তু রাধাকিশোরের অকৃত্রিম বন্ধুতা, এবং স্নেহ তাঁহাকে ত্রিপুরার সম্বন্ধ হইতে বিচ্যুত হইতে দেয় নাই। সেই জন্যই এই দুই মহানুভবের বন্ধুত্বের গভীরতা ক্ষুদ্র দলাদলির ফাঁকা সোরগোলে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত হইত না। বাংলাদেশের রাজা, বাঙালি কর্মচারী চালিত ত্রুটি বিচ্যুতি, বাঙালির কলঙ্কের পরিচায়ক বলিয়া রবিবাবুর মনকে আঘাত দিতো। সেজন্যই তিনি ত্রিপুরার মঙ্গল এবং উন্নতির জন্য সর্বদা উৎসুক এবং চেষ্টিত আছেন। এ রাজ্যেই বাঙালি মস্তিষ্কের সু-ব্যবহার হইবে, বাঙালি প্রতিভা পূর্ণ বিকশিত হইয়া অন্যান্য রাজ্যের দৃষ্টান্তস্থল হইবে, এ আশা এখনো তিনি হৃদয়ে পোষণ করিয়া থাকেন। (দেশীয় রাজ্য, কর্নেল মহিমচন্দ্র ঠাকুর দেববর্মা, পৃষ্ঠা ৮৮-৮৯ )