ত্রিপুরার বাঁশ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্থাপত্য ভাবনা
শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ
আজকাল স্থাপত্য শিল্পে পরিবেশ বান্ধব উপকরণের গুরুত্ব বেড়েছে। ক্রমাগত বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং পরিবেশ দূষণের ফলে স্থাপত্য শিল্পে পরিবেশ বান্ধব উপকরণ পুনর্ব্যবহারের উপায় ছাড়া ভিন্ন বিকল্প আর কী হতে পারে! শহর আর গ্রাম এখন ভরে উঠছে ইঁট কাঠ আর কংক্রিটের জঙ্গলে। জলাভুমি বুজিয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে ঘরবাড়ি। দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে অরণ্য। এর প্রভাব পড়ছে পশুপাখির ওপর। স্বাভাবিক বাসস্থান ধ্বংস হওয়ার ফলে কমছে পশুপাখির সংখ্যা। পরিবেশের ভারসাম্য বিঘ্নিত হওয়ার ফলে ভুগতে হচ্ছে মানুষকেও। খরা, বন্যা এবং মহামারীর ধাক্কায় মানুষ এই সময়ে নাজেহাল। অথচ প্রকৃতিকে ধ্বংস না করে মানুষ যদি আগেই পরিবেশ বান্ধব উপকরণের সাহায্যে স্থাপত্য শিল্প কিম্বা গৃহ নির্মাণের কার্যে মনোনিবেশ করতো - আজ এই পৃথিবীর জলবায়ু হয়তো এতোটা বিষিয়ে উঠতো না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিন্তু বহুকাল পূর্বেই স্থাপত্য শিল্পে পরিবেশ বান্ধব উপকরণের ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিয়েছলেন। যে কোনও নির্মাণকে সৃষ্টিমুখী করে গড়ে তুলতে হবে, এই ছিল তাঁর বিশ্বাস। তাঁর কাছে স্থাপত্য ছিল আকারের মহাযাত্রা! রবীন্দ্রনাথ গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন যে, শুধু প্রযুক্তি দিয়ে স্থাপত্যের মুক্তি ঘটবেনা। বরং প্রকৃতি নির্ভর সাহিত্য- সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগের মধ্য দিয়েই যে স্থাপত্যের পূর্ণতা সম্ভব তা তিনি উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন। বস্তুত পূর্ববঙ্গের শিলাইদহই ছিল শান্তিনিকেতনের প্রাককথন ৷ রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন আলো-বাতাস ও পরিসর হল স্থাপত্যের আত্মা। তিনি আধুনিকতার নামে উদগ্রতা এবং বিশালতাকে স্থাপত্যের গুণ হিসেবে দেখার পক্ষপাতী ছিলেন না ।
আলো-বাতাস ও পরিসরকে স্থাপত্যের আত্মা মনে করতেন রবীন্দ্রনাথ। প্রকৃতির প্রতি রবীন্দ্রনাথের যে ব্যাকুলতা ছিল তা পূর্ববঙ্গে এসে পূর্ণতা পায়। আর তার স্থাপত্যিক বিকাশ তিনি ঘটান শান্তি নিকেতনে সেখানকার গৃহনির্মাণকলা থেকে শুরু করে শিক্ষা-পরিসর পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় লগ্নতার সাধনা করেছেন। শুধু প্রযুক্তি দিয়ে যে স্থাপত্যের মুক্তি ঘটবে না বরং সাহিত্য-সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগের মধ্য দিয়েই স্থাপত্যের পূর্ণতা সম্ভব, তা রবীন্দ্রনাথ গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই শিল্পরীতির ভাবনার প্রতিফলন ঘটে শান্তি নিকেতনের স্থাপত্যে সিংহসদন থেকে কলাভবনের নন্দন, তার অদূরেই মাটি ও আলকাতরায় মেশানো গৃহ সহ দিনান্তিকা, চিনাভবন, হিন্দিভবন, সংগীতভবন, রতনকুঠি, উত্তরায়ণ চত্বরের উদয়ন, কোণার্ক, শ্যামলী, পুনশ্চ, উদীচী এবং তৎসংলগ্ন বাগানে। প্রকৃতি পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে না বলে এই সময়ে ফের এই ধরণের গৃহ নির্মাণের দিকেই অনেকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন। গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে ইকো ট্যুরিজমের ওপর। দেশ বিদেশের বিভিন্ন জনপ্রিয় পর্যটন স্থলে পর্যটকদের থাকার জন্য গড়ে তোলা হচ্ছে সর্ব প্রকার অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধা সহ বাঁশবেতের ঘর বা টঙ ঘর! দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই বাঁশবেতের এমন ঘর বা টঙ ঘর পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। আমাদের দেশে রাজস্থান সহ উত্তরপূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পর্যটকদের জন্য এমন ঘর বানানো হয়েছে। ত্রিপুরায় বাঁশগ্রাম নামেই এমন একটি পর্যটন স্থল গড়ে তোলা হয়েছে যেখানে বাগান থেকে শুরু করে বাসগৃহ - সবই বাঁশের। টেকসই এবং মজবুত বলে এসব ঘরের নিরাপত্তাও সন্দেহাতীত।
উল্লেখ্য, ত্রিপুরার আদিবাসী জীবনে বাঁশের গুরুত্ব অপরিসীম। আজও পাহাড়ে সদ্যোজাত শিশুর নাভিরজ্জু কাটা হয় ধারালো বাঁশের সাহায্যে। বাঁশের পাত্রে তৈরি হয় খাবার। বাঁশের কুড়ুল খেয়ে বেঁচে রয় বহু মানুষ। থাকার জন্যও তৈরি করা হয় আরামপ্রদ বাঁশের টঙঘর। মৃত্যুর পর শুকনো বাঁশ আর লতাপাতার সাহায্যে দাহ করা হয় দেহ। বাঁশকে ঘিরে গড়ে উঠেছে একাধিক ত্রিপুরি লোককথা । গোটা উপমহাদেশে ১৩০ প্রজাতির বাঁশ রয়েছে। তার মধ্যে ৩০টি প্রজাতির বাঁশ এই ত্রিপুরাতেই জন্মে। বাঁশবেতের সাহায্যে তৈরি ত্রিপুরার হস্তশিল্প গোটা বিশ্বে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। দেশের ধুপকাঠি শিল্পের ৬০ শতাংশ বাঁশকাঠি তৈরি হয় ত্রিপুরাতেই। অর্থকড়ির দিক থেকেও ত্রিপুরার আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বাঁশের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বাঁশঝাড় সহজে ধ্বংসও হয় না। বাঁশ কেটে ফেললেও পুনরায় সেখানে নতুন বাঁশগাছ বেড়ে উঠে। এতে যথারীতি বহাল থাকে পরিবেশের ভারসাম্য।
আজ এ কথা ভেবে বিস্মিত হই যে, সেই কতযুগ আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ত্রিপুরার বাঁশবেতের গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন। তিনি সর্বার্থেই ছিলেন দূরদর্শী। ১৩১২ বঙ্গাব্দের (১৯০৫ খ্রীঃ) ২রা আষাঢ়। রবীন্দ্রনাথ সেদিন জগদীশচন্দ্রের পরীক্ষার জন্য ত্রিপুরার বাঁশ চেয়ে মহারাজা রাধাকিশোরকে লিখেছিলেন... ত্রিপুরায় যে মূলীবাঁশ জন্মে - শিশু অবস্থায় তাহার বৃদ্ধি অতিশয় দ্রুত। এই গাছের চারা তাঁহার পরীক্ষার জন্য অত্যাবশ্যক হইয়াছে। সদ্য অঙ্কুরিত মুলীবাঁশের চারা মহারাজ যদি সত্বর তাঁহার ঠিকানায় পাঠাইয়া দিতে আদেশ করিয়া দেন তবে তাঁহার বিশেষ উপকার হইবে।.....
গৃহ নির্মাণেও বাঁশের মতো পরিবেশ বান্ধব এবং মজবুত এই প্রাকৃতিক উপাদানকে ব্যবহারের বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিস্তৃত চিন্তাভাবনা ছিল। আর গুণগতভাবে ত্রিপুরার বাঁশ যে শ্রেষ্ঠ সে বিষয়েও তাঁর মনে কোনও সংশয় ছিল না। শুধু বিজ্ঞান গবেষণা নয়,গৃহ নির্মাণের উপকরণ হিসেবে ও যে ত্রিপুরার বাঁশ খুবই উপযোগী সেটাও জানা যায় কবির চিঠি থেকে। ১৩১০ বঙ্গাব্দের ৭ ফাল্গুন। রাজপুরুষ কর্ণেল মহিম ঠাকুরকে কবি লিখেছিলেন, "আমাদের বোলপুর বিদ্যালয়ের একটা বড় ঘর তোমাদের দেশের মুলিবাঁশের দরমার দ্বারা ছাউনি করিতে চাই। খবর পাইলাম কুমিল্লা হইতে ছাইবার উপকরণ সস্তায় পাওয়া যায়।.... আমাদের হেড মাস্টারবাবু বলিতেছেন তোমাদের দেশের বাঁশের কাজ আমাদের প্রয়োজনের পক্ষে অতি সুন্দর ও স্থায়ী হইবে।"
আজ রবীন্দ্রচিন্তার আলোকে স্থাপত্যকে যদি আমাদের মানবীয় ভাবনার অংশী করে তুলতে পারি তবে দেখব স্থাপত্যের ভেতর প্রকৃতির স্পন্দন জাগানোতেই এর মহিমা নিহিত। তার সাহিত্যকর্মের মতোই স্থাপত্যচিন্তাও ব্যতিক্রমী এবং মৃত্তিকালগ্ন যা আজকের দিনেও আমাদের জন্য সমান প্রাসঙ্গিক।