সজল নীল পৃথিবী যেন অগ্নিবলয়ে পরিণত না হয়
শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ
কবি বিষ্ণু দে লিখেছিলেন,- “মনে পড়ে একদিন সে – গ্রামে উনুনে / আগুন নিবন্ত, আগুন আকাশে তোলা, আগুন মাটিতে ঢালা। / যেতে হবে পুবগ্রামে, সদরালা নই, নই নায়েব নবাব, সুতরাং সকালেই যাত্রারাম্ভ। সে কী মাঠ। মাইল – মাইল / অনেক শতাব্দী ধরে হাজার – হাজার খুনে/পৃথিবীকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে মেরে গেছে যেন, / আম – জাম – কাঁঠাল – পিপুল কিছু নেই, দীঘি কুয়া/খাল বিল মজানদী কিছু নেই। শুধু নীরক্ত শ্বেতাঙ্গ রৌদ্র। (নিজস্ব সংবাদদাতা, বিষ্ণু দে) কবিরা নিঃসন্দেহে ত্রিকালদর্শী। পৃথিবী যে ক্রমেই শুস্ক হয়ে উঠছে - এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কবির চোখে আগেই ধরা পড়েছিল এই নিষ্ঠুর বাস্তবতার প্রতিচিত্র। সত্যিই তো, পৃথিবীর নদনদী, জলাভূমিগুলি ধীরে সব শুকিয়ে যাচ্ছে। ক্ষয়ে যাচ্ছে অরণ্য । কমছে বৃষ্টিপাত। বাড়ছে তাপমান। অশনি সংকেতময় এই শ্বেতাঙ্গ রৌদ্রগ্রস্থ দিনই কি তবে আমাদের ভবিতব্য!
অরণ্য ধ্বংসের প্রকোপ পড়ছে পশুপাখির ওপরও। নির্বিচারে গাছপালা কেটে ফেলার পাশাপাশি এমনিতেই মানুষ উন্মত্ত উল্লাসে প্রতিদিন মেরে ফেলছে বহু পশুপাখি। পৃথিবীর বুক থেকে সম্পূর্ণভাবে লুপ্ত হয়েছে কত প্রজাতি। অবশিষ্টাংশ যা-ও বা কিছু রয়েছে - অরণ্য হ্রাসের ফলে বিপন্ন হয়ে পড়েছে তাদের অস্তিত্ব। ভুললে চলবে না, গোটা বিশ্বে উদ্ভিদ আর পশুপাখির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশের বাসস্থান হল অরণ্য। সর্বোপরি, একশো কোটিরও বেশি মানুষ কোনও না কোনওভাবে অরণ্য সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে রয়েছে আবার সম্পূর্ণভাবে অরণ্য সম্পদের ওপর নির্ভরশীল ছয় কোটি অরণ্যচারী জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ। অরণ্য হ্রাসের সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পৃথিবীর এক কোটি জনজাতির ওপর। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বৃষ্টি অরণ্যে বাসরত জনজাতিরা। বৃষ্টি অরণ্যে চাষবাসের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক জড়িয়ে আছে জৈব বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ সে অঞ্চলের প্রকৃতি এবং পরিবেশের নিবিড় আন্তঃসম্পর্কের ওপর। বিরল প্রজাতির পশুপাখি এবং পতঙ্গ বৃষ্টি অরণ্যের মাটিকে উর্বর এবং শস্যকে পরাগায়িত করে তুলতে সাহায্য করে। অনবরত অরণ্য ধ্বংস এবং ভূমিক্ষয়ের ফলে ধ্বস্ত হচ্ছে এখন জনজাতিদের জীবন। নগরায়নের ফলে দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে সেসব অঞ্চলের অরণ্য। হারিয়ে যাচ্ছে চিরতরে বিরল প্রজাতির পশুপাখি এবং উদ্ভিদ।
বিপন্ন প্রকৃতি এবং পরিবেশের বিষয়ে জনমানসে তাই সচেতনতা গড়ে তোলা জরুরী হয়ে পড়েছিল। এখন প্রতি বছর ২২ এপ্রিল পালিত হয় ‘ধরিত্রী দিবস’। অ্যামেরিকান সেনেটর গেলর্ড নেলসন ছিলেন এই দিবসের উদ্গাতা। ১৯৭০’র ২২ এপ্রিল প্রথমবারের মতো অ্যামেরিকায় পালিত হয়েছিল ধরিত্রী দিবস। লাগামহীন পরিবেশ দূষণের ফলে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল সাধারণ অ্যামেরিকানদের ! পরিবেশ দূষণে কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতায় ক্ষুব্ধ এবং বিরক্ত হয়েছিল তখন অ্যামেরিকার জনগণ। অধিক ফসলের আশায় চাষাবাদে নির্বিচারে ব্যবহৃত হচ্ছিল ক্ষতিকর কীটনাশক, রাসায়নিক পদার্থ। দূষিত হয়ে পড়েছিল নদ নদী। অজস্র গাড়ি এবং কলকারখানা থেকে নির্গত ক্ষতিকর ধোঁয়ায় ছেয়ে গিয়েছিল সেই সময় অ্যামেরিকার শহর এবং গ্রাম। অ্যামেরিকার জন সাধারণের স্বাস্থ্যের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও - বায়ু দূষণ যেন তখন সমৃদ্ধি এবং উন্নতির প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
এদিকে পরিবেশ সংরক্ষণে কার্যকরী কোনও আইন ছিল না সেই সময় । পরিবেশ দূষণের বিষয়টি তখন সংবাদ মাধ্যমের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। উন্নয়নের নামে শিল্প সংস্থাগুলি তাই যথেচ্ছার পরিবেশকে দূষিত করে তুলছিল। অ্যামেরিকার সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠলেও প্রকৃতি এবং পরিবেশ সংরক্ষণে কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে নি তখনও। এরই মধ্যে ১৯৬৯’এ সান্টা বারবারা’য় তেল ছড়িয়ে পড়ার দুর্ঘটনা ঘটে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ে জলজ প্রাণীর ওপর। মারা যায় প্রায় ৩,৫০০’র মতো সামুদ্রিক পাখি সহ অনেক ডলফিন, সীল এবং সী লায়ন। বাতাসেও ছড়িয়ে পড়ে দূষণ। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় প্রতিবাদে সোচ্চার হয় স্থানীয় জনগণ। প্রচার মাধ্যমও সরব হয়।
আন্দোলন দানা বাঁধতে এরপর সময় লাগে নি। পরিবেশ দূষণ হ্রাসের জন্য কর্তৃপক্ষ যাতে সক্রিয় হয় - সেই দাবীতে ১৯৭০’এ ২ কোটি অ্যামেরিকান পথে নেমেছিল। উল্লেখ্য, এমন একটি আন্দোলনের জন্য প্রেক্ষাপট কিন্তু আগেই তৈরি হয়েছিল। ১৯৬২’এ প্রকাশিত হয়েছিল পরিবেশবিদ র্যাচেল কার্সন’এর ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’। এই বইতে র্যাচেল বিস্তৃত ব্যাখ্যা সহকারে বলেছিলেন, পরিবেশ দূষণের ফলে পৃথিবীর তামাম উদ্ভিদ এবং প্রাণীকূল কী রকম বিপন্ন হয়ে পড়েছে। বলেছিলেন, প্রকৃতি পরিবেশ সম্পর্কে এখনই সচেতন না হলে পৃথিবীর ধ্বংস অনিবার্য । র্যাচেল কার্সন’এর এই বই সাড়া ফেলেছিল পাঠকমহলে। ২৪টি দেশে ৫০০,০০০’র বেশি বিকিয়েছিল ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’। পরিবেশ রক্ষায় শিল্পোন্নত দেশের জনগণ তখন থেকেই সচেতন হতে শুরু করেছিল। ১৯৭০’এর ২২ এপ্রিল অ্যামেরিকায় সেনেটর গেলর্ড নেলসন’এর নেতৃত্বে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল - আজ তার বিস্তৃতি ঘটেছে গোটা বিশ্বে। এখন ১৯২টি দেশের ৭৫ কোটিরও বেশি মানুষ প্রতি বছর ২২ এপ্রিল ধরিত্রী দিবস পালন করে। ২০০৯’এ রাষ্ট্রসংঘ ২২ এপ্রিলকে বিশ্ব ধরিত্রী দিবস হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়।
‘রেস্টর আওয়ার আর্থ’ অর্থাৎ ক্রমাগত দূষণের হাত থেকে পৃথিবীকে পুনরুদ্ধার করাই হল ২০২১’র বিশ্ব ধরিত্রী দিবসের মূল থীম। এই থীমের মাধ্যমে বলা হচ্ছে নিছক দূষণ হ্রাসই আমাদের মূলোদ্দেশ্য হতে পারে না। এই পৃথিবীতে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সুস্থ পরিবেশ গড়ে তোলার আর্তি এখন অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর কোনও বিকল্প নেই ! ক্ষতিকর কৃত্রিম বা রাসায়নিক পদার্থের পরিবর্তে প্রাকৃতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। ক্রমাগত পরিবেশ দূষণের জেরে এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে অশনি সংকেতের চিহ্নগুলি। ভয়াবহ ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে পৃথিবীর তাপমান। পুড়ে ছাই হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া এবং ব্রাজিলের অরণ্য, নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে ফসল বিনষ্টকারী পঙ্গপালের বাড়বাড়ন্ত। আর এখন কোভিড-১৯’এর ফলে অতিমারিতে আক্রান্ত গোটা বিশ্ব। অবশ্যই দিশেহারা অবস্থা এখন মানুষের!
গত শতকের নব্বুই দশক থেকেই পৃথিবীকে দূষণ মুক্ত করার বিষয়ে শুরু হয়েছিল ব্যাপক চিন্তা ভাবনা। ২০১৫’এ (৩০ নভেম্বর – ১২ ডিসেম্বর) প্যারিসে রাষ্ট্রসংঘের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় ক্লাইমেট চেঞ্জ বা জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন। এই সম্মেলনে বিশ্ব উষ্ণায়ন হ্রাসের জন্য প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। নিউ ইয়র্ক শহরে ২০১৬’র ২২ এপ্রিল অর্থাৎ ধরিত্রী দিবসে সেই প্রস্তাবে আনুষ্ঠানিক ভাবে সম্মতি প্রদান করে ১৭৪টি দেশ। এই প্রস্তাবের চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী প্রতিটি দেশই বিশ্ব উষ্ণায়ন হ্রাসের জন্য রাজী হয় যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণে। বিশ্বের বর্তমান তাপ প্রবাহ যাতে আরও ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস হ্রাস পায় তার জন্য প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থার কথাও বলা হয়। উল্লেখ্য, প্রকৃতি এবং পরিবেশ সংরক্ষণে প্যারিস সম্মেলনের আগে ১৯৯২’এ ( ৩ জুন -১৪ জুন) সালে ব্রাজিলের রিও শহরে বিশ্বে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়েছিল বসুন্ধরা সম্মেলন। সব মিলিয়ে ১৭৮টি দেশ এই সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করেছিল।
এই সময়ে বিশ্বের জনমানসে পরিবেশ বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যই ধরিত্রী দিবস পালনের প্রাসঙ্গিকতা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা ১৮৮১’র পর প্রতিবছর গড়ে ১.৫ ডিগ্রি বেড়েছে। অ্যান্টার্কটিকার হিমবাহ ১৯৮১’র পর প্রতি দশকে হ্রাস পেয়েছে ১৩.৪ শতাংশ হারে। সমুদ্রতলের উচ্চতা গত ১০০ বছরে ১৫ সেমি বেড়েছে। ধ্বংস হয়েছে গত ৫০ বছরে বিশ্বের ২৭ শতাংশ প্রবাল প্রাচীর। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমছে শঙ্কাজনক ভাবে। শুকিয়ে যাচ্ছে বিশ্বের সর্বত্র ভূগর্ভস্থ জলাধার। অদূর ভবিষ্যতে তীব্রতর হবে পানীয় জলের সংকট। ভয়ংকর খরায় মরছে মানুষ।
বিশ্ব উষ্ণায়ন হ্রাস এবং পরিবেশ দূষণ বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলি সম্পন্ন করার মাধ্যমেই অর্থপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বিশ্ব ধরিত্রী দিবস পালনের সার্থকতা। এ বিষয়ে জনমানসে সচেতনতা গড়ে তোলা আশু কর্তব্য। নগরায়নের স্বার্থে পৃথিবীর সর্বত্র যে নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস চলছে - তা বন্ধ করতে হবে। জরুরী এখন বৃক্ষরোপণ। বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ কমানোর জন্য পেট্রোল, ডিজেল চালিত যানবাহনের পরিবর্তে সিএনজি, ব্যাটারি অথবা সৌর শক্তির মাধ্যমে চালিত যানবাহন ব্যবহার বিধেয়। ব্যবহার করতে হবে প্লাস্টিকের পরিবর্তে পুনর্ব্যবহারযোগ্য দ্রব্য। গুরুত্ব দিতে হবে জৈব বৈচিত্র্য সংরক্ষণের ওপর।
আমাদের সজল নীল পৃথিবী যেন অগ্নিবলয়ে পরিণত না হয়। এই অঙ্গীকার বাস্তবায়িত না করতে পারলে বিশ্ব ধরিত্রী দিবস পালন অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। মহাত্মা গান্ধী একদা বলেছিলেন, ‘‘মানুষের সার্বিক চাহিদা মেটানোর জন্য প্রকৃতির পর্যাপ্ত সম্পদ রয়েছে। কিন্তু মানুষের লালসা পূর্ণ করার ক্ষমতা প্রকৃতির নেই।’’ মুনাফার স্বার্থে প্রকৃতিকে শোষণ করার লালসা ত্যাগ করতে হবে। বজায় রাখতে হবে পরিবেশের ভারসাম্য। নইলে রুষ্ট প্রকৃতির অভিশাপে মানুষের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে আগামী দিনে।