অস্কারে হাতি মানুষ সম্পর্কের জয়গাঁথা
পান্নালাল রায়
সাম্প্রতিক কালের দুটি ঘটনা প্রবল ভাবে পশুপ্রেমীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।এরমধ্যে একটি ঘটেছে ত্রিপুরায় এবং অপরটি রাজ্য তথা দেশের গন্ডী ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক স্তরেও পশুপ্রেমীদের নজর কেড়ে নিয়েছে।
ত্রিপুরায় একটি কুকুরকে চলন্ত গাড়ির পেছনে বেঁধে টেনে নিয়ে যাবার পৈশাচিক ঘটনা দেখে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন সবাই। সামাজিক মাধ্যমে ভাইরেল হয়েছে এই দৃশ্য।অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।পশুপ্রেমী সহ সাধারণ মানুষের মধ্যেও প্রবল ক্ষোভ দেখা দিয়েছে এ নিয়ে।শেষপর্যন্ত অভিযুক্ত ব্যক্তিটিকে গ্রেপ্তার করে ত্রিপুরা পুলিশ বিবৃতি প্রচার করেছে।অপর ঘটনাটি হচ্ছে তথ্যচিত্রে ভারতের অস্কার লাভ।ভারতীয় তথ্যচিত্র 'দ্য এলিফ্যান্ট হুইসপারার্স' এবার সেরা তথ্যচিত্র হিসেবে অস্কার জিতে নিয়েছে।এতে রয়েছে এক অনাথ হস্তিশাবক ও মানুষের সম্পর্কের কাহিনি।তামিলনাড়ুর এক দম্পতি হস্তীশাবকটিকে উদ্ধার করে নিজেদের সন্তানের মতো বড় করে তুলেছিলেন।এই তথ্যচিত্রের মাধ্যমে মানুষ ও পশুর সম্পর্কের কাহিনি বিশ্ব দরবারে তুলে ধরা হয়েছে।বলা হয়েছে মানুষ ও প্রকৃতির নিবিড় বন্ধনের কথা।মানুষ ও পশুদের সহাবস্থান কথা।
সাধারণ ভাবে সব মানুষ পশুপ্রেমী বললে ভুল বলা হবেনা।মানুষ তার জীবন জীবিকার জন্য সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই পশুপালন করে আসছে।আবার বন্যজন্তুর আক্রমণ থেকে নিজেদের সুরক্ষা করতে মানুষও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে এর বিরুদ্ধে।মানুষ ও বন্যপ্রাণীর মধ্যে সংঘাত এড়াতে অবশ্য সময়ে সময়ে নানা উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে।বিভিন্ন প্রাণী সংরক্ষণ,সংরক্ষিত বনাঞ্চল,সচেতনতা মূলক নানা অনুষ্ঠান ইত্যাদি হচ্ছে।তারপরও মাঝে মাঝেই ঘটে যায় নানা অনভিপ্রেত ঘটনা।আবার মানুষই এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে।কয়েক বছর আগে কেরালায় একটি গর্ভবতী হস্তিনীর মৃত্যুর ঘটনা ঘিরে গোটা দেশ জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল।
উত্তর পূর্বাঞ্চলের নানা এলাকাতে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর সংঘাত এড়াবার উদ্দেশ্যে নানা উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। বেশ কয়েক বছর ধরে অসমের কাজিরাঙ্গায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে অভিনব হস্তি উৎসব। ত্রিপুরায় সাম্প্রতিক কালে শুরু হয়েছে গজরাজ উৎসব। উত্তর পূর্বাঞ্চলের সমাজ,সংস্কৃতি,ইতিহাস ও কিংবদন্তীতে রয়েছে হাতির গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান। বলা যায় হাতি হচ্ছে এই অঞ্চলের অরণ্যের অলঙ্কার।অতীতে মোগলরা এই অঞ্চলের হাতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। সেদিনের যুদ্ধক্ষেত্রে হাতি যেন ছিল এক জীবন্ত ট্যাঙ্ক।মোগলরা সেজন্য উত্তর পূর্বাঞ্চল থেকে হাতি সংগ্রহে সচেষ্ট ছিল।সম্রাট আকবরের মন্ত্রী আবুল ফজলের মতে সম্রাটের পিলখানার উৎকৃষ্ট হাতি ছিল ত্রিপুরার।এই হাতির জন্য সপ্তদশ শতকের শুরুতে মোগলদের হাতে প্রথম ত্রিপুরা আক্রান্ত হয়।মোগলদের আগেও হাতির লোভে বঙ্গের মুসলমান শাসকদের হাতে ত্রিপুরা আক্রান্ত হয়েছে।অসমেও হাতি ঐতিহ্যের সাথী।মহাভারতের যুগ থেকেই বহমান তা।
পূর্বোত্তরের রাজ্য সমূহের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হাতি রয়েছে অসমে।অবশ্য অতীতের তুলনায় বর্তমানে এই সংখ্যা দারুণ ভাবে কমে এসেছে।একদা রাজাদের শক্তির অন্যতম মাপকাঠি ছিল হাতি।অসমের ইতিহাস, প্রাচীন কাব্য সাহিত্য এবং চৈনিক পরিব্রাজকদের ভ্রমণ বিবরণীতে অসমের হাতির উল্লেখ রয়েছে।এমনকি মহাভারতেও অনুল্লেখ্য নয় অসমের হাতি।কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পান্ডব সেনাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল প্রাগজ্যোতিষের নৃপতি ভগদত্তের হাতি সুপ্রতীক।সুদূর অতীতে কামরূপ নৃপতি কুমার ভাস্করবর্মণ কণৌজের বৌদ্ধ সম্মেলনে যোগদানের সময় পাঁচশ হাতির মিছিল নিয়ে গিয়েছিলেন। হিউয়েন সাঙ্গ তাঁর ভ্রমণ বিবরণীতে অসমের সমৃদ্ধ হাতির উল্লেখ করেছেন। যুদ্ধ বিজয়ের পর মোগল ও কোচরা সন্ধির শর্ত অনুসারে এই অঞ্চল থেকে হাতি নিয়ে গেছে।ষোড়শ শতকে কোচ আক্রমণে যখন আহোমরা পর্যুদস্ত হয় তখন তাদের হাতি আর দ্রুতগামী অশ্ব কোচদের কর হিসেবে দিতে হয়েছিল। আর ডিমাছা রাজা কোচ আক্রমণের ভয়ে আগেভাগেই বশ্যতার নিদর্শন হিসেবে কোচদের এক হাজার স্বর্ণ মোহর সহ ৬০টি হাতি দিতে সম্মত হয়েছিলেন। আবার মোগল সম্রাটকে হস্তী উপঢৌকন দিতে হয়েছে কোচ রাজাকেও।কোচ নৃপতি নরনারায়ণ সম্রাট আকবরের কাছে অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রীর পাশাপাশি ৫৪টি হাতিও পাঠিয়েছিলেন উপঢৌকন হিসেবে।সপ্তদশ শতকে মোগল সেনাপতি মীরজুমলার সঙ্গে শান্তি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী মোগল সম্রাটকে আহোমদের বিপুল পরিমাণ সোনারূপার পাশাপাশি ৯০টি হাতিও দিতে হয়েছিল।
অসমের মতো ত্রিপুরার ইতিহাসেও উজ্জ্বল হাতির উপস্থিতি।ত্রিপুরার রাজাদের মাণিক্য উপাধি ধারণের সঙ্গেও হাতির এক ক্ষীণ যোগসূত্র রয়েছে।এক সময় ত্রিপুরার সিংহাসনে রাজা বদলের কারণ হয়ে উঠেছে হাতি।সম্রাট আকবরের মন্ত্রী আবুল ফজলের মতে সম্রাটের পিলখানার উৎকৃষ্ট হাতি ছিল ত্রিপুরার। আইন-ই-আকবরিতে উল্লেখ রয়েছে যে ত্রিপুরার রাজা বিজয় মানিক্যের এক হাজার হাতি ছিল।এই হাতির জন্য মোগল এবং মোগলদের আগেও মুসলমান শাসকদের হাতে বারবার ত্রিপুরা আক্রান্ত হয়েছে।কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন, ত্রিপুরার রাজা গোবিন্দ মাণিক্য তাঁর সিংহাসন সুনিশ্চিত করার জন্য মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবকে হাতি উপঢৌকন দিয়েছিলেন। আবার এই রাজাই হাতির বিনিময়ে তাঁর রাজ্যে লবণ আমদানি করেছিলেন। সব মিলিয়ে ত্রিপুরার ইতিহাসকে দারুণ ভাবে প্রভাবিত করেছে হাতি।
ইতিহাস ঐতিহ্যে যখন হাতির এই উজ্জ্বল অবস্থান তখন অসম সহ পূর্বোত্তরের নানা অংশে মানুষ আর হাতির মধ্যে সংঘাত চলছে।এই সংঘাতের ফলশ্রুতিতে একদিকে মানুষ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনই বিপন্ন হচ্ছে হাতি।সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। সাম্প্রতিক এক তথ্যে প্রকাশ,২০১৯-২০ থেকে ২০২১-২২ এই তিন বছরে অসমে হাতির আক্রমণে ২২৯ জনের মৃত্যু ঘটেছে।আর প্রাণ হারিয়েছে ২২৫ টি হাতি।হাতি আর মানুষের মধ্যে এই সংঘাতের জন্য দায়ী করা হচ্ছে বনভূমির পরিমাণ কমে যাওয়াকে।কারণ খাদ্য আর অবাধ বিচরণের জন্য পর্যাপ্ত বনভূমি না থাকায় লোকালয়ে হানা দিচ্ছে হাতির দল।মানুষের জীবন ও সম্পদ হানি ঘটছে।অনিবার্য হয়ে উঠছে হাতি আর মানুষের সংঘাত। ত্রিপুরার কিছু এলাকাতে মাঝে মাঝে বন্য হাতির তান্ডব চলে।আঠারোমুড়া ও বড়মুড়া পাহাড় থেকে বেরিয়ে এসে বন্য হাতির দল লোকালয়ে মানুষের ঘরবাড়ি,ফসলের খেত তছনছ করছে।কখনও পিষে মেরে ফেলছে মানুষকেও।
উত্তর পূর্বাঞ্চলের অরণ্য সম্পদ হাতির সংখ্যা এখন অতীতের তুলনায় অনেক কমে গেছে।কয়েক বছর আগের(২০১৭ সালের) এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় গোটা দেশে হাতির সংখ্যা ২৭,৬৬২। পশ্চিমবঙ্গ সহ সমগ্র উত্তর পূর্বাঞ্চলে রয়েছে এর ৩০ শতাংশ। অসমে রয়েছে ৫,৭১৯ হাতি,অরুণাচল প্রদেশে ১,৬১৪,মিজোরামে ৭ ,নাগাল্যান্ডে ৪৩২,মেঘালয়ে ১,৭৫৪ এবং ত্রিপুরায় রয়েছে ২০৩ টি হাতি।দেশের মোট হাতির ৪৪ শতাংশ রয়েছে কর্ণাটক,কেরালা,অন্ধ্রপ্রদেশ ও তামিলনাড়ু-দক্ষিণ ভারতের এই চার রাজ্যে।
যাইহোক,হাতি আর মানুষের মধ্যে সংঘাত এড়ানো সহ সামগ্ৰিক ভাবে বন্য প্রাণী ও বন সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একদিন কাজিরাঙ্গায় হস্তী উৎসবের সূচনা হয়েছিল। ত্রিপুরাতে গজরাজ উৎসব সহ পশুপাখির নামে বন ও বন্যপ্রাণী সম্পর্কে সচেতনতামূলক নানা উৎসবের আয়োজন হচ্ছে সাম্প্রতিক কালে। এইসব উদ্যোগ নিশ্চিত সমাজে এক ইতিবাচক বার্তা পৌঁছে দেবে।মানুষের সচেতনতা বাড়বে।কিন্তু সমস্যা সমাধানে ,মানুষ ও বন্যপ্রাণীর সুরক্ষায় আরও অনেক কিছু চাই।বনাঞ্চল হ্রাস পেয়ে যাতে বন্যপ্রাণীদের খাদ্য ও বাসস্থানের ক্ষেত্রে সংকট সৃষ্টি না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।খাদ্যের অন্বেষণে তাদেরকে যাতে জনপদের দিকে চলে না আসতে হয় তা দেখতে হবে।সব মিলিয়ে মানুষের নিরাপদ ভবিষ্যতের স্বার্থেই প্রকৃতির সুরক্ষা সহ পশুপাখির নিরাপদ অবস্হান সুনিশ্চিত করতে হবে।এটা মনে রাখতে হবে পশুপাখি না থাকলে মানুষও বিপন্ন হবে।মানুষের প্রয়োজনেই এদের সুরক্ষা প্রয়োজন। ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্য, পুরাণ সহ দেবদেবীর উপাখ্যানে পশুপাখির গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান যেন আমাদের ঐতিহ্য আর সেই চিরন্তন সত্যের কথাই মনে করিয়ে দেয়।এবারের অস্কার জয়ী ভারতীয় তথ্যচিত্রে মানুষ ও পশুর সেই সম্পর্কের কথাই বিশ্ব দরবারে তুলে ধরা হয়েছে।