।। পুস্তক পর্যালোচনা ।।

- ড. রবীন্দ্র কুমার দত্ত, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ।

ত্রিপুরা সরকারের আরক্ষা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত আইজিপি সুলেখক অরিন্দম নাথের সুনাম শুধু ত্রিপুরার মধ্যেই নয়, ত্রিপুরার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে । বাংলা ও ইংরেজিতে এযাবত প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বিভিন্ন স্বাদের পনেরটি গ্রন্থ । এবারের আগরতলা বইমেলায় (২০২৩) প্রকাশিত হতে যাচ্ছে তাঁর আরও একটি আকর্ষণীয় রম্যকথামূলক গ্রন্থ 'লকডাউনের দিনলিপি' । নামকরণ থেকেই বোঝা যায় যে, গ্রন্থটি রচিত হয়েছে একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বত্রাস করোনা মহামারীর প্রেক্ষাপটে । রচনাকাল - ৮ মে, ২০২০ থেকে ১১ আগস্ট, ২০২১ পর্যন্ত । মাঝখানে অবশ্য মাস দেড়েক অসুস্থতার কারণে তাঁর লেখা বন্ধ ছিল । সুস্থ হয়ে আবার লিখতে শুরু করেন । গ্রন্থটিতে প্রায় পঁচিশটির মত দিনলিপি স্থান পেয়েছে এবং তাতে রয়েছে ছোট-বড় বেশকিছু আকর্ষণীয় উপাখ্যান ।

কী নেই তার এই গ্রন্থে ? চর্যাপদ থেকে আধুনিক বিজ্ঞান, কঠিন-কঠোর বাস্তব থেকে স্বপ্নের জগৎ, মর্ত্যের ছাদবাগান থেকে স্বর্গের নন্দনকানন পর্যন্ত লেখকের দৃষ্টি প্রসারিত ৷ তিনি শুধু দেখেনইনা, দেখতে-দেখতে ভাবেন, ভাবতে-ভাবতে লেখেন; আর পাঠককে পড়তে-পড়তে ভাবান ৷ উল্লেখ্য, তাঁর দৃষ্টি সত্যিকার অর্থেই পুলিশেরই দৃষ্টি ৷ সাধারণ মানুষের মতো শুধুমাত্র চর্মচক্ষু দিয়েই তো তিনি দেখেন না, মনশ্চক্ষু দিয়েও দেখেন ৷ তাঁর দৃষ্টিতে যেন এক্সরে যন্ত্রের মত মানুষের বাহ্য ও আভ্যন্তরীণ ছবি একই সঙ্গে ধরা পড়ে, এবং ব্যঞ্জনাময় হয়ে ওঠে ৷

লেখকের বর্ণিত কাহিনিগুলোও বেশ বৈচিত্র্যময় ৷ লকডাউনের কারণে দ্বিতলঘরের জানালায় বসে বসে তিনি তাঁর আশেপাশে যে-সব দৃশ্য দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন তা-ই তুলে ধরেছেন হাস্যমধুর রম্যভাষায় ৷ গ্রন্থের সূচনা হয়েছে ২৫ শে বৈশাখ রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠান না হবার কথা দিয়ে, পরক্ষণেই এসেছে গাছপালা তথা অরণ্যের সৌন্দর্য ও উপকারিতার কথা এবং বন-বিনষ্টিজনিত লেখকের বেদনার্ত হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি ৷ পরবর্তী কাহিনিগুলোর মধ্যে ছেলেদের খেলাধুলো আর রান-আউটের মীমাংসার জন্যে ছুটে আসা রেফারির সংখ্যাধিক্যের কারণে অতি সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্টের মত ব্যাপার-স্যাপার ৷ তারপর একে একে এসেছে লেখকের মৌতাতের প্রসঙ্গ, পরলোকে গমন, দ্বাররক্ষক শুম্ভ-নিশুম্ভ এবং বিধাতা পুরুষের সঙ্গে সাক্ষাৎকার ও অকল্পনীয় সব কথোপকথন, ঘুঘু পাখিদের স্বভাব বর্ণনা, ঘুঘু সাবানের বিজ্ঞাপনী অর্থ, কুকুরের স্বভাব বর্ণনা, শেয়ালের ডাকের তাৎপর্য, মহাশূন্যের এয়ারপোর্টের বর্ণনা, চিত্রগুপ্ত ও বিশ্বকর্মার সঙ্গে সাক্ষাতে কথোপকথন, নকল-বিদ্যায় চীনাম্যানদের পারদর্শিতার প্রসঙ্গ, করোনা ভাইরাস শনাক্তকরণ পদ্ধতি, অরণ্য ও জোৎস্নাস্নাত রাত্রির সৌন্দর্য বর্ণনা, শারদীয়া দুর্গাপূজার উদ্ভব কাহিনি, সমুদ্রমন্থন, বনের সঙ্গে রামায়ণে বর্ণিত পাষাণী অহল্যার তুলনা, লকডাউন কালে ত্রিপুরায় করোনাক্রান্ত রোগীর ক্রমবর্ধমান সংখ্যার বিবরণ, মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গলের খেলায় যে-বছর পদপিষ্ট হয়ে ১৬ জন দর্শকের মৃত্যু হয়েছিল তার বিবরণ, ফর্ম ইলেভেন ঠিকেদার গুষ্ঠীর কুকীর্তি - কাঠের সেতুর শালের মজবুত পিলার রাতের অন্ধকারে কেটে দেওয়া এবং কৌশলে নতুন সেতু বানানোর বরাত পেয়ে ‘নন-শাল’ পিলার লাগিয়ে অর্থবান হওয়ার প্রচেষ্টা, ঘুড়ির মাঞ্জার উপকরণ ও লাগানোর টেকনিক, প্রেমে পড়ে বোকার বুদ্ধিমানে এবং বুদ্ধিমানের বোকায় পরিণতি, পাখি কর্তৃক অ্যাম্বুলেন্সের শব্দানুকরণ, ঘুঘু ও পায়রা ইত্যাদির বৈশিষ্ট্য, শালিকসহ কিছু পাখিদের ডাকাডাকির অর্থ আবিষ্কার, রবীন্দ্র সঙ্গীতে কোন ফুল মোট কতবার ব্যবহৃত হয়েছে তার বিবরণ, এবং গ্রন্থের শেষের দিকে জাদু-প্রদর্শন এবং বাটি চালানের মতো অলৌকিক বিশ্বাসের বিচিত্র সব কথাও বেশ রসালো ভাষায় বর্ণিত হয়েছে ।

অরিন্দম বাবু কোন জাদুমন্ত্রবলে পাঠককে ঘন্টার পর ঘন্টা সম্মোহিত করে রাখতে পারেন - সেই প্রশ্নের জবাবে অবশ্যই তাঁর সংক্ষিপ্ত, সরস ও নিটোল রচনাশৈলীর কথা বলা যেতে পারে । উদাহরণস্বরূপ তাঁর রচনাশৈলীর কয়েকটি নমুনা এখানে তুলে ধরছি :

(১) “দেবতারা সবাই অসুখের ভয়ে সেল্ফ কোয়ারেন্টাইনে ৷ চিত্রগুপ্তের বয়স হয়েছে ৷ তাঁর আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ৷ তিনি অজানা স্থানে বসে অন-লাইনে অফিস করছেন ৷ শুম্ভ-নিশুম্ভ এদিকের অফিস সামলাচ্ছে ৷”

(২) “Dove Soap” বা ঘুঘু সাবানের একটি বিজ্ঞাপন মনে আসে । শ্যামলা দেখতে এক মহিলা হেসে বলেন, ‘ঘুঘু সাবান’ ব্যবহার করে ওনার গাল ভীষণ তুলতুলে হয়ে গেছে ৷ ওনার হাসবেন্ডের ভাষায়, “রসগোল্লা ! রসগোল্লা !”

(৩) “পৃথিবীতে ভাইরাস ছাড়াও আরও দুটি রোগ আছে ৷ অর্থ আর স্বার্থ৷ অর্থ থাকলে সবাই থাকে ৷ আর স্বার্থ ফুরালে সবাই চলে যায়৷”

(৪) “আমার বিচারে কুকুর তিন প্রকার ৷ সবাক, নির্বাক আর অবাক ৷ সবাকরা সন্দেহ বাতিকগ্রস্থ হয় ৷ অপরিচিত ব্যক্তি কিংবা স্বজাতীয় চতুষ্পদ দেখলে ভৌ ভৌ করে ৷ ইনফিওরিটি কমপ্লেক্সে ভুগে । আত্মবিশ্বাস কম । সবকিছুতেই বিপদ দেখতে পায় । বিপদ কেটে গেলে আত্মতুষ্টি অনুভব করে৷ গৃহস্থরা এদের পছন্দ করে ৷ নির্বাক সবসময় ঘুমিয়ে কাটায় ৷ পাশ দিয়ে হাতি চলে গেলেও রা করে না ৷ অবাক সজাগ হয়ে সবকিছু দেখে ৷ ইনট্রুডার চলে গেলে বসে থাকে ৷ সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভুগে ৷”

এসব উদ্ধৃতি থেকেই বইটি কেমন জনপ্রিয়তা পাবে তা সহজেই আন্দাজ করা যায় ৷ ঝকঝকে ছাপাই, মজবুত বাঁধাই এবং সুদৃশ্য প্রচ্ছদে সুশোভিত এমন একটি আকর্ষণীয় গ্রন্থ পাঠককে উপহার দেবার কারণে আমি এর লেখক সুপ্রিয় অরিন্দম নাথ এবং নীহারিকা প্রকাশনার কর্ণধার তীর্থঙ্কর দাসকে অশেষ ধন্যবাদ ও সাধুবাদ জানাই ৷

লকডাউনের দিনলিপি - অরিন্দম নাথ

প্রচ্ছদ - অর্পিতা মাল

নীহারিকা পাবলিশার্স

বিনিময় — ২০০ টাকা


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.