ভোটে এগিয়ে , ক্ষমতায় পিছিয়ে
পান্নালাল রায়
উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে নির্বাচনে মহিলাদের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও ক্ষমতার বৃত্ত থেকে তারা কিন্তু অনেক অনেক দূরেই রয়ে যান।এই অঞ্চলের কোনো কোনো রাজ্যে সংখ্যায় বেশি মহিলা ভোটার। কোথাও বা ভোটদানের হারেও পাল্লা ভারী তাদের দিকেই। তারপরও দেখা যায় বিধানসভায় মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব পুরুষদের তুলনায় অনেক অনেক কম।কম মন্ত্রীর সংখ্যাও। বর্তমানে পূর্বোত্তরের কোনো কোনো রাজ্যে আবার কোনো মহিলা মন্ত্রীও নেই।
বর্তমানে ত্রিপুরা,মেঘালয় ও নাগাল্যান্ড- উত্তর পূর্বাঞ্চলের এই তিন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন ঘিরে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলোতে
চরম ব্যস্ততা চলছে। গোটা দেশের নজরও নিবদ্ধ রয়েছে এই তিন রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফলের দিকে।আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে দেশে লোকসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।বিধানসভার নির্বাচনের সঙ্গে অবশ্য লোকসভার অনেক ফারাক।বিধানসভার নির্বাচনে সাধারণত প্রাধান্য পায় স্থানীয় ইস্যু,লোকসভায় ভোটারদের কাছে বিবেচ্য হয় সর্বভারতীয় প্রসঙ্গ।কিন্তু তারপরও দেশের লোকসভা ভোটের আগে অনুষ্ঠিত রাজ্যগুলোর বিধানসভা ভোটের ফলাফলের এক পৃথক গুরুত্ব রয়েছে।সেজন্য ২০২৩ সালের বিভিন্ন রাজ্য বিধানসভার ভোটের ফলাফলে দেশের আমজনতার মনোভাব নিশ্চিত কিছুটা প্রতিফলিত হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।এই দৃষ্টিকোণ থেকেই চলতি জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিতব্য পূর্বোত্তরের তিন রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফল সারা দেশের প্রেক্ষিতেই কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ বললে ভুল বলা হবে না। যাইহোক,বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল ইতিমধ্যে নির্বাচনী ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।সর্ব ভারতীয় দলের পাশাপাশি বিভিন্ন আঞ্চলিক দলেরও প্রভাব রয়েছে এই রাজ্য গুলোতে।সব দলেরই ভিন্ন ভিন্ন ইস্যু,ভিন্ন ভিন্ন রণ কৌশল। রাজনৈতিক সমীকরণও পৃথক। তা সত্ত্বেও নির্বাচনী ফলাফলে মানুষের মনোভাব কিছুটা বুঝতে অসুবিধা হবেনা।বিভিন্ন দল তাদের সুবিধা মতো কৌশল ঠিক করেছে,কেউ কেউ ঢালাও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে,কোনো কোনো দল সুবিধা মতো জোটবদ্ধ হচ্ছে। ত্রিপুরাতে সৃষ্টি হয়েছে চমকপ্রদ উদাহরণ।শাসকদল বিজেপিকে ঠেকাতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস ও সিপিএম জোট করেছে। সংশ্লিষ্ট দুটি দল থেকেই বলা হচ্ছে ত্রিপুরায় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার সহ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তারা কাছাকাছি এসেছে। আবার রাজ্যে কংগ্রেস ও সিপিএম'র জোটকে কটাক্ষ করছে বিজেপি।
পূর্বোত্তরের তিন রাজ্যের ফলাফলের জন্য ২রা মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষায় থেকে এবার আসা যাক ভোটে মহিলাদের অংশ গ্রহণ এবং বিধানসভায় মহিলা প্রতিনিধিত্বের প্রসঙ্গে।সমানাধিকার,সংরক্ষণ সহ মহিলাদের এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য নানা প্রকল্প আর প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি সত্ত্বেও বাস্তবটা কি? পূর্বোত্তরের কোনো কোনো রাজ্যে ভোটার ও ভোটদানের হারে মহিলাদের আধিক্য সত্ত্বেও বিধানসভায় মহিলা প্রতিনিধিত্বের সংখ্যা তুলনায় অনেক কম।পূর্বোত্তরের অরুণাচল প্রদেশ,মিজোরাম, নাগাল্যান্ড প্রভৃতি রাজ্য সমূহে পুরুষদের তুলনায় মহিলা ভোটারদের সংখ্যা বেশি।ভোটদানের হারেও মহিলাদের দিকে পাল্লা ভারী পরিলক্ষিত হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে মেঘালয়,নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরায় এই চিত্র দেখা গেছে।আর শুধু পূর্বোত্তর কেন, দেশের অন্যান্য অংশেও এই চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে।গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের হারেও সংখ্যাধিক্য ছিল মহিলাদের। মহিলাদের ভোট পড়েছিল ৬২.২৪ শতাংশ এবং পুরুষ ৫৯.৫৬ শতাংশ। কিন্তু এসব সত্ত্বেও রাজ্য সমূহে মহিলাদের প্রতিনিধিত্বের সংখ্যা নিতান্তই কম এবং তা কোথাও কমেই চলেছে।পূর্বোত্তরের ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায় যে,২০১৮ সালের নির্বাচনে ত্রিপুরায় ২৯৭ জন প্রার্থীর মধ্যে ২০ জন মহিলা প্রার্থী ছিলেন। বিজয়ী হয়েছিলেন ৩ জন। ত্রিপুরায় অবশ্য গত বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় এবার প্রতিদ্বন্দ্বী মহিলা প্রার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে মেঘালয়ে ৩৬১ জন প্রার্থীর মধ্যে ৩১জন মহিলা প্রার্থী ছিলেন। এর মধ্যে বিজয়ী হয়েছিলেন ৩ জন। কিন্তু ২০১৩ সালের নির্বাচনে এই সংখ্যা ছিল ৫। ২০১৮ সালের নির্বাচনে নাগাল্যান্ডে মোট ১৯৬ জন প্রার্থী ছিল। এর মধ্যে ৫ জন মহিলা প্রার্থী থাকলেও কেউ জয়ী হতে পারেননি।পূর্বোত্তরের অসম,মণিপুরেও একই চিত্র। মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব কম। কিন্তু কেন এমনটা হবে?
বিভিন্ন ক্ষেত্রে আজ মহিলাদের সাফল্য ও দক্ষতা তর্কাতীত ভাবেই প্রতিষ্ঠিত।চাকরি ও ব্যবসাক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত তারা।গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও মহিলারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছেন।পঞ্চায়েত ও পুর নির্বাচনের ক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য যা আসন সংরক্ষণ রয়েছে তার ইতিবাচক প্রভাবও পড়ছে সামাজিক ক্ষেত্রে। বিভিন্ন রাজ্যে সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত মহিলারা অনেক ক্ষেত্রেই দক্ষতার নজির রাখছেন। সংশ্লিষ্ট ওয়াকিবহাল মহল থেকে তাদের কাজের ভূয়সী প্রশংসাও করা হচ্ছে। কিন্তু এরকম ইতিবাচক সম্ভাবনা সত্ত্বেও বিধানসভার নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থী চয়নের ক্ষেত্রে মহিলাদের তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়না কেন এটাই প্রশ্ন।তথ্য অনুসারে পূর্বোত্তরের বিভিন্ন রাজ্যে বিধানসভার ভোটে মোট প্রার্থীর ১০ শতাংশও মহিলা প্রার্থী দেখা যায় না। এবার অবশ্য ত্রিপুরায় এই হার কিছুটা বেড়েছে। ত্রিপুরায় এবার তা প্রায় ১২ শতাংশ। কিন্তু কোনও রাজ্যে এই হার ৫ শতাংশেরও কম থাকে কখনো। কেন এমনটা হবে? যেখানে নানা ক্ষেত্রেই মহিলাদের অবদান ও দক্ষতা স্বীকৃত সেখানে বিধানসভায় প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে তারা অনেক অনেক পেছনে পড়ে থাকবেন কেন?এটাই আশ্চর্যের ব্যাপার যে,বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মহিলাদের জন্য গালভরা প্রতিশ্রুতি দেয়,ভোট চায় ,কিন্তু প্রার্থী হিসেবে মহিলাদের বিবেচনা খুবই কম পরিলক্ষিত হয়।
চলতি জানুয়ারি মাসে ত্রিপুরা,মেঘালয় ও নাগাল্যান্ডের বিধানসভা নির্বাচনের পর এবছরের শেষ দিকে পূর্বোত্তরের আরও একটি রাজ্য মিজোরামে বিধানসভার ভোট হবার কথা।পূর্বোত্তরের এই রাজ্যগুলোতে ভোটে মহিলাদের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।কারণ পরম্পরাগত ভাবেই এই অঞ্চলের রাজ্য সমূহে সামাজিক নানা ইস্যুতে মহিলাদের অবস্থান সামনের সারিতে।কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এটাই যে ভোটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও এই অঞ্চলে ক্ষমতার অলিন্দ থেকে মহিলারা কিন্তু অনেক দূরে। মহিলা ভোটারের সংখ্যা বেশি, প্রদত্ত ভোটের হারেও আধিক্য মহিলাদের।কিন্তু তারপরও বিভিন্ন দলের প্রার্থী তালিকায় মহিলাদের উপস্থিতি একেবারেই নগণ্য। স্বাভাবিক ভাবেই বিধানসভায় মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব আরও কয। একটি তথ্যে প্রকাশ পূর্বোত্তরের সাত রাজ্যে বিধানসভার মোট ৪৬৬টি আসনে বর্তমানে ৫ শতাংশ মাত্র মহিলা প্রতিনিধি রয়েছেন।যেখানে বিধায়ক খুবই কম,কিংবা নেই, সেখানে মন্ত্রী থাকবেন কি ভাবে!বর্ত্তমানে মেঘালয়,মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল প্রদেশে কোনো মহিলা মন্ত্রী নেই।সমাজ ও দেশের অগ্রগতির পক্ষে এটা যে মোটেই সুলক্ষণ নয় তাতে নিশ্চই সবাই একমত হবেন।
পূর্বোত্তরের বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুর ক্ষেত্রে মহিলাদের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে।অনেকেই এমনটা বলেন যে,যদি মহিলারা রাজনৈতিক ক্ষমতা পান তবে অনেক সমস্যাই দক্ষতার সঙ্গে তারা মোকাবেলা করতে পারবেন। বিশেষত পূর্বোত্তরের বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সমাধান হতে পারে মহিলাদের হাত ধরে।এখানে প্রাসঙ্গিক ভাবেই মণিপুরের কথা উল্লেখ করা যায়।অতীতে আমরা দেখেছি নানা ইস্যুতে মণিপুরে মহিলারা এগিয়ে এসেছেন।তারা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে পথে নেমেছেন। সেই মণিপুরেও পুরুষদের তুলনায় মহিলা ভোটারের সংখ্যা বেশি হলেও তুলনায় বিধানসভায় প্রতিনিধিত্ব অনেক কম।গত বছর মণিপুর বিধানসভার নির্বাচনে মোট প্রার্থী ছিলেন ২৬৫ জন।এর মধ্যে মহিলা প্রার্থী ছিলেন ১৭জন। অবশ্য এর মধ্যে জয়লাভ করেছিলেন ৫ জন। মণিপুরের রাজনৈতিক ইতিহাসে অবশ্য এটি এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা।যাইহোক, শুধু পূর্বোত্তর নয়,গোটা দেশেই মহিলা প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে কম বেশি একই চিত্র। কোনো কোনো সমাজকর্মী বলছেন, সংসদ ও বিধানসভায় মহিলাদের জন্য যথোপযুক্ত আসন সংরক্ষণ না হলে এই অবস্থার অবসান হবেনা।নির্বাচনে তখনই মহিলা প্রার্থীর সংখ্যা বাড়বে। প্রশ্ন হচ্ছে, ভোটার বেশি,ভোটদানেও এগিয়ে,এগিয়ে নানা ক্ষেত্রেই, কিন্তু তারপরও ক্ষমতার বৃত্ত থেকে তারা দূরে থাকবেন কেন!