ইয়ে তিরপুরা হ্যায় কাঁহা !

শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ

দেড় দশক আগের কথা। বিভিন্ন রিয়েলটি টি ভি’র অনুষ্ঠান সবে শুরু হয়েছে এদেশে। সর্ব ভারতীয় চ্যানেলগুলির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলার বেশ কয়েকটি বিনোদনমূলক টিভি’ও নৃত্য, গীত মূলক তাদের রিয়েলেটি শো চালু করে। এমনই একটি বহিঃরাজ্যের টিভি শো’য়ে ত্রিপুরার একটি ছেলে গায়ক হিসেবে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল। ত্রিপুরাবাসী হিসেবে আমরা অনেকেই তখন খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু অনুষ্ঠানে সেবার নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে সেই ছেলে নিজেকে ভিন্ রাজ্যের বাসিন্দা বলে পরিচয় দিয়েছিল। অন্যদের কথা বলতে পারবো না; আমি কিন্তু বেজায় চমকে গিয়েছিলাম ত্রিপুরার ছেলেটির এমন আচরণে। ব্যথিত হয়েছিলাম। তবে এমন অভিজ্ঞতা নতুন কিছু নয়। গত শতকের আশির দশকে উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রথমবারের মতো বহিঃরাজ্যে গিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ‘’ত্রিপুরা’’ প্রায় অস্তিত্বহীন। শুধু ত্রিপুরা নয়; বলতে গেলে গোটা উত্তরপূর্বই বাকি ভারতের মানুষের কাছে অপ্রাসঙ্গিক। বুঝতে পেরেছিলাম ত্রিপুরা তথা উত্তরপূর্ব নিয়ে ভারতীয় মূল ভূখণ্ডের মানুষেরা অনেক ভিত্তিহীন ধ্যানধারণা পোষণ করে। আর এগুলির বেশির ভাগই আমাদের পক্ষে ঠিক শোভন বা মর্যাদাকর নয়। সম্ভবত এমন সব নেতিবাচক ধ্যানধারণার ফলেই ত্রিপুরার অনেকেই বহিঃরাজ্যে গিয়ে আজও অবলীলায় ভিন রাজ্যের বাসিন্দা বলে নিজেদের পরিচয় দিয়ে স্বস্তিলাভ করে।

ত্রিপুরা তথা উত্তরপূর্ব ভারতের বাইরে না গেলে সর্ব ভারতীয় প্রেক্ষাপটে আমাদের অস্তিত্বহীনতার কথাও বোঝা অসম্ভব। গত শতকের আশির শেষার্ধে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছিলাম যখন, আমাকে অনেকেই বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করতেন। আমি আগরতলার ছেলে বললে অনেকেই তখন ভ্রূ কুঁচকে বলতেন, ‘’ওটা কী আসলে আগরপাড়া ! ‘’ আগরতলা আর আগরপাড়া যে এক নয় - এ কথা ওদের বোঝাতে গিয়ে আমি রীতিমতো স্বেদজলে একসা হতাম ! রেহাই ছিল না হিন্দিভাষী অঞ্চলেও। নিজস্থানের পরিচয় দেওয়ার পর শুনেছি বিস্মিত কণ্ঠে সেই সজ্জন ব্যক্তি বলছেন, ‘’ইয়ে তিরপুরা হ্যায় কাহাঁ !’’ শিল্পের অহল্যা ভূমি বলে কথিত মাত্র ৩৬ লক্ষ লোকের এই তৃতীয় ক্ষুদ্রতম রাজ্যকে চেনা বা বোঝার কী দায় রয়েছে ভারতীয় মূল ভূখণ্ডের মানুষের কাছে !

এমতাবস্থায় যে ত্রিপুরার অনেকেই বহিঃরাজ্যে গিয়ে নিজেদের ভিন অঞ্চলের বাসিন্দা হিসেবে পরিচয় দিয়ে যে স্বস্তি লাভ করবেন - তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। একজন আত্ম সচেতন মানুষ হিসেবে আমার পক্ষে তা ছিল একেবারেই অবাঞ্ছনীয়। আমি বহিঃরাজ্যে গিয়ে নিজের স্থান পরিচয় দিতে গিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে আগরতলা, ত্রিপুরার কথাই বলেছি। শচিন দেববর্মণ, রাহুল দেববর্মণের কথা বলেছি। ত্রিপুরার কথা একেবারেই না জানলে আমি বুঝিয়ে বলেছি আমার রাজ্যটা ভারতের মানচিত্রে কোথায় বা কোন অঞ্চলে অবস্থিত। সর্ব ভারতীয় স্তরে ত্রিপুরার এমন ‘বেনামা’ অবস্থান কিন্তু আমার মনে কিছু কমপ্লেক্স’ও তৈরি করেছিল। এই কমপ্লেক্স আসলে প্রায় আইডেন্টিটি ক্রাইসিসের সমতুল্য। অনস্বীকার্যভাবে ব্যক্তি মানসেও এর প্রভাব পড়েছিল। উপলদ্ধি করতে পেরেছিলাম যথোপযুক্ত প্রচারের আলো থেকে বঞ্চিত বলে ত্রিপুরার কথা সে রকম ভাবে ভারতীয় মূল ভূখণ্ডের মানুষ জানেন না। ত্রিপুরার সন্তানেরাও বাইরে গিয়ে নিজ রাজ্যের পরিচয় না দিয়ে ভিন রাজ্যের পরিচয় দেওয়ায় সমস্যা আরও বেড়েছে। অধরাই রয়ে গিয়েছে সমাধান।

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসের অন্ধকার থেকে আলোকের ঝর্ণাধারায় অবগাহন এবং উত্তরণের জন্য ভেবেছি সর্বত্র নিজের কথাই ঢাক পিটিয়ে বলা ভালো। অবশ্য নিজের ঢাক কে না পেটায় ! এই পৃথিবীতে আমরা কে না এই 'নার্সিসিজম' থেকে মুক্ত ! এমন কেউ কী আছেন যে নিজেকে ভালোবাসেন না! নিজেকে সুন্দর দেখেন না ! এগুলি যে কোনও মানুষের মানসিক অবস্থানের মূল স্তম্ভ। তাই মনস্তত্বের বইগুলি পড়লে আসলে নিজের তো বটেই, অপরের মানসিক অবস্থানের কথাও বুঝতে সুবিধা হয়। আজকাল সামাজিক গণ মাধ্যমে দেখি অনেকেই অন্যদের গালিগালাজের মাধ্যমে হেয় করার চেষ্টা করছে। আত্মপ্রচার করছে এমন অভিযোগ তুলে একজন আর একজনকে দুষছে। প্রতিপক্ষকে নার্সিসিস্ট বলে গালি দিয়ে বলছে, ‘’আমায় দ্যাখ, আমি কখনও তোর মতো আত্মপ্রচার করি না !’’ যথার্থই। এই এক লাইনেই তো শুধু ‘’আত্মপ্রচার’’এর কথাই বলা হয়েছে !

সামাজিক গণ মাধ্যমের ইতিবাচক দিকটির কথাও কিন্তু আমাদের ভাবতে হবে। অনাদৃত এবং উপেক্ষিত ত্রিপুরার কথা বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমরা সামাজিক গণ মাধ্যমকে যথাযথভাবে ব্যবহার করতেই পারি এবং গত দেড় দশক ধরে আমি এই কাজটাই করে চলেছি। প্রফেশন এবং প্যাশনের মাধ্যমে ত্রিপুরার কথাই তুলে ধরছি। আমি যদি বিদেশের কোনও অনুষ্ঠানে ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নিই, সেখানে দেশের কথা বলি। ত্রিপুরার কথাও বলি। সামাজিক গণ মাধ্যমে সেই কথা ছবি সহ বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই লিখে প্রকাশ করি। ত্রিপুরা ভিত্তিক উপন্যাস বইমেলায় গ্রন্থ হিসেবে বেরোলে বা সর্ব ভারতীয় ম্যাগাজিনে আমার ওপর কভার স্টোরি বেরোলে তা ত্রিপুরার মানুষ হিসেবে সামাজিক গণ মাধ্যমে লিখে সবার সঙ্গে শেয়ার করি। কোনও সফলতা পেলে, তা আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বেনেট কোলম্যান সংস্থার পুরস্কারই হোক, বিশ্ব বিদ্যালয়ের সিলেবাসে দুটো বইয়ের অন্তর্ভুক্তই হোক বা দূরদর্শনের ন্যাশনেল নেটওয়ার্কে ছয় এপিসোডের সিরিয়ালই প্রদর্শিত হোক, ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ (ICSSR)’এর উত্তরপূর্ব ভারতের জনজাতি এবং সংস্কৃতি বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ বইয়ে আমার নামোল্লেখ হোক - এমন আরও বেশ কিছু খবর ত্রিপুরার মানুষ হিসেবে সামাজিক গণ মাধ্যমে প্রচার করতে কালক্ষেপ করি না। জানি, দেশ, রাজ্য এবং সমাজের কাছে শেষ পর্যন্ত যে কোনও ব্যক্তিই গৌণ। মুখ্য হয়ে উঠে শুধু তার কাজ। পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত সাফল্যের মালিক আসলে ওই দেশ, রাজ্য এবং সমাজ। মানুষের ইতিবাচক এবং গঠনমূলক কাজগুলি কালক্রমে জাতীয় দেশবাসীর সম্পদ কিম্বা ঐতিহ্য হয়েই থাকে। আমরা সকলেই সেই সম্পদের ভাঁড়ারকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টায় ব্যাপৃত থাকি মাত্র।

সুতরাং হাজার অসফলতার পর একটিই সফলতা হাসিল হয় যখন তা দেশ, রাজ্য এবং সমাজের স্বার্থেই প্রচার করা বিধেয় বলে মনে করি। এর মধ্যে নিছক আত্মপ্রচারের মোহ খুঁজতে যাওয়া বৃথা। সার্বিক ভাবে ত্রিপুরার মতো রাজ্যকে আমাদের সবারই যে কোনও ইতিবাচক এবং গঠনমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সর্ব ভারতীয় স্তরে উজ্জ্বল করে তোলার জন্য সচেষ্ট থাকা উচিত। এর জন্য অবশ্যই সর্বাগ্রে নিজভূমির প্রতি সংযুক্তি বোধের মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। ভালবাসতে হবে নিজের মাটিকে। ভিন রাজ্যের ওকালতি না করে তুলে ধরতে হবে নিজ অঞ্চলের সাহিত্য, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে। সর্ব ভারতীয় প্রেক্ষাপটে ত্রিপুরাকে উজ্জ্বল করে তুলে ধরতে হলে নিজ রাজ্যের পৃথকীকৃত অথচ বিশিষ্ট আইডেন্টিটির কথা ভাবতেই হবে। নইলে আজও বহিঃরাজ্যে গিয়ে অকস্মাৎ আমাদের শুনতে হতে পারে, ইয়ে তিরপুরা হ্যায় কাঁহা ! ভাবতে হবে প্রচারের এমন ধুম ধাড়াক্কার যুগেও আজও কেন ত্রিপুরা এমন অনুজ্জ্বল হয়ে আছে। আমাদের আত্ম সমীক্ষণ প্রয়োজন অবশ্যই।

ত্রিপুরা পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা পেয়েছিল ২১ জানুয়ারি, ১৯৭২। অর্ধ শতকের বেশি হল আজ সেই ক্ষণ । এর মধ্যে সুবিশাল এই বিশ্ব দরবারে কিছুটা হলেও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ত্রিপুরার উপস্থিতি। লেখালিখির মাধ্যমে ত্রিপুরার ঊনকোটি, নীরমহল এবং উজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদকে ইউনেস্কো’র বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবী জানিয়ে এসেছি বারবার। এও এক স্বপ্ন। আজ সেই স্বপ্ন আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে। এমন সব কাজে যথারীতি রাজনৈতিক দল সমূহ নিয়ে নিক যাবতীয় কৃতিত্ব। এতটুকু আপত্তি নেই এতে। আসলে তো জনমানসের গতিপ্রকৃতি বুঝে নিয়েই পার্টিজান স্বার্থে কাজ করে রাজনৈতিক দল সমূহ। এর বিপ্রতীপে আমাদের মতো সৃজনশীল ব্যক্তিরা সর্বদা কাজ করে যাবে ত্রিপুরার স্বার্থে ।

প্রিয় এই রাজ্যটিকে ঘিরেও স্বপ্ন তো অনেক। ভূমিপুত্র হিসেবে আমরা স্বপ্ন না দেখলে আর কে দেখবে ! আজ ত্রিপুরার একান্নতম পূর্ণ রাজ্য দিবসে ফের স্বপ্ন দেখি নীরমহল ইউনেস্কো’র বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পাচ্ছে। স্বপ্ন তো একদিন না একদিন পূরণ হবেই। এইভাবেই গোটা বিশ্বে একদিন মুখরিত হয়ে উঠবে ত্রিপুরার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের প্রভায়। সেদিন কী আর কেউ সবিস্ময়ে বলবেন, ‘’ ইয়ে তিরপুরা হ্যায় কাঁহা !’’


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.