সুদূর অতীতেও পূর্বোত্তরে বাংলা
পান্নালাল রায়
উত্তর পূর্বাঞ্চল বলে সেদিন নির্দিষ্ট কোনো ভূখণ্ড চিহ্নিত ছিল না। তবে ভারতের উত্তর পূর্ব প্রান্তে কোচ,আসাম,কাছাড়, জয়ন্তিয়া,মণিপুর, ত্রিপুরা, আরাকান ইত্যাদি স্বাধীন রাজ্য সমূহ ছিল। সেই সব রাজ্যে সংশ্লিষ্ট রাজসভার অকৃপণ পৃষ্ঠপোষকতায় সেদিন বাংলা সাহিত্যের চর্চা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারায় নিঃসন্দেহে এই চর্চার এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। কিন্তু বাংলা চর্চার প্রসঙ্গে এসে পড়ে বাঙালি বসতির প্রসঙ্গও। শুধু কাব্য সাহিত্য চর্চা নয়, প্রান্তীয় রাজ্য সমূহের রাজসভার ভাষাও ছিল বাংলা। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠে, রাজসভার ভাষা বাংলা হল কেন? রাজাগণই বা বাংলা চর্চার পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন কেন?
কোচ,আহোম,কাছাড়,জয়ন্তিয়া,ত্রিপুরা রাজসভায় সুদূর অতীত থেকেই বাংলা ভাষার প্রচলন ছিল।ষোড়শ শতকে কোচ নৃপতি নরনারায়ণ আহোম রাজা চুকামফা স্বর্গদেবকে যে পত্র দিয়েছিলেন তা বাংলা গদ্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। অষ্টাদশ দশকের প্রথম দিকে আহোমরাজ রুদ্র সিংহ ত্রিপুরার রাজাকে যে গোপন পত্র দিয়েছিলেন তার ভাষাও ছিল বাংলা।এর পূর্ববর্তী সময়েও, সপ্তদশ শতকে আহোম রাজাদের বিভিন্ন পত্রে বাংলা গদ্যের প্রাচীন রূপের পরিচয় পাওয়া যায়।কাছাড়ের রাজসভাতেও বাংলার প্রচলন ছিল।১৮১৭ সালে কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালে বাংলা গদ্যে রচিত হয়েছিল কাছাড়ি রাজাদের আইন কানুন। আহোমরাজা কিংবা ইংরেজদের সঙ্গে কাছাড়ি রাজাদের পত্র যোগাযোগের ভাষাও ছিল বাংলা।সুদূর অতীত থেকেই ত্রিপুরার রাজসভার কাজে বাংলার ব্যবহার হয়ে আসছে।পঞ্চদশ শতকে ত্রিপুরার রাজাদের প্রচারিত মুদ্রায় বাংলা অক্ষরের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়েছে।প্রান্তীয় জয়ন্তিয়া রাজ্যেও বাংলাই ছিল রাজদরবারের ভাষা।
কোচবিহার, কাছাড়,জয়ন্তিয়া,ত্রিপুরা, আরাকান প্রভৃতি বাংলার প্রান্তীয় রাজ্য সমূহের রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা সাহিত্য চর্চার ধারা আজ ইতিহাস হয়ে আছে।বাংলার মূল ভূখণ্ড থেকে দূরে আরাকানে একদিন পাখির পালকের ডগায় ঝরে পড়েছিল ভাষার মমতা।বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মগ রাজার আরাকানে রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত হয়েছিল বাংলা কাব্য। তারও অনেক আগে চট্টগ্রামের পাঠান শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাতে অনূদিত হয়েছিল মহাভারত। বাংলার অপর এক প্রান্তদেশ ত্রিপুরাতেও রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায় পঞ্চদশ শতক থেকেই বাংলা কাব্য চর্চা হয়ে আসছিল। ডিমাছা রাজ্য কাছাড়েও রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাতে অনূদিত হয়েছিল সংস্কৃত ধর্মগ্রন্থ।কোচবিহারে রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা চর্চা অর্ধ সহস্র বছরের ঐতিহ্যপুষ্ট।
কোচ রাজসভার অকৃপণ পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে বাংলা।ষোড়শ শতকে কোচ নৃপতি নরনারায়ণ আহোম রাজা চুকামফা স্বর্গদেবকে যে পত্র লেখেন সেই পত্রটি প্রাচীনতম বাংলা গদ্যের প্রথম প্রামাণ্য দলিল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে।কোচ রাজসভার উদ্যোগে অনেক ধর্মগ্রন্থ বাংলাতে অনূদিত হয়েছে। প্রান্তীয় রাজ্য সমূহের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় যে,একদা জনজাতি রাজ্যে কিংবা ভিন্ন ভাষাভাষি শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা সাহিত্যের চর্চা হয়েছে।ধর্মগ্রন্থ, মহাকাব্য অনূদিত হয়েছে বাংলায়।আবার বাংলাতে রচিত হয়েছে লৌকিক আখ্যান কাব্যও।সুদূর অতীতে প্রান্তীয় রাজ্য সমূহে কেন এমন বাংলার ব্যবহার ছিল তা নিশ্চিত আরো গবেষণার দাবি রাখে। কাছাড়ের ডিমাছা রাজমাতা চন্দ্রপ্রভা দেবী অষ্টাদশ শতকে বাংলাতে অনুবাদ করিয়েছিলেন বৃহন্নারদীয় পুরাণ।এই অনুবাদ কর্মটি করেছিলেন পন্ডিত ভুবনেশ্বর বাচস্পতি। বাংলায় রচিত হয়েছে ডিমাছা রাজ্যের দণ্ডবিধি। প্রাচীন জয়ন্তিয়া রাজ্যেও এক সময় বাংলা ছিল রাজসভার ভাষা।এমনকি জয়ন্তিয়ার শেষ রাজা রাজেন্দ্র সিং নিজেও একজন বৈষ্ণব কবি ছিলেন। আরাকানের রোসাঙ্গ রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায় সপ্তদশ শতকে বাংলা কাব্যের এক অভিনব স্ফূরণ ঘটেছিল।মধ্যযুগের বাংলা কাব্যকে সমৃদ্ধ করেছে দৌলত কাজীর 'লোর চন্দ্রানী বা সতী ময়না ',সৈয়দ আলাওলের 'পদ্মাবতী '।গৌড় সুলতান হূসেন শাহ তাঁর সেনাপতি পরাগল খাঁকে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। পরাগল খাঁর নির্দেশে তাঁর সভাকবি কবীন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারতের অতি সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করেছিলেন।পঞ্চদশ শতকের শেষ দিক থেকে ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে রচিত এই কাব্যটি 'পরাগলী মহাভারত' হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল। পরাগলের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ছুটি খাঁ চট্টগ্রামের শাসনভার গ্রহণ করেন। তিনিও পিতার মতো বাংলা কাব্যানুরাগী ছিলেন।মহাভারত অনুবাদ করাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন তিনি।ছুটি খাঁর নির্দেশে তাঁর সভাকবি শ্রীকর নন্দী মহাভারতের অনুবাদ করেন যা ছুটিখানী মহাভারত হিসেবে পরিচিত।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আলোচনায় বাংলার প্রান্তীয় রাজ্য সমূহের রাজসভার অবদান নিশ্চিত বিশেষ গুরুত্বপূর্ন প্রসঙ্গ।আর এই প্রেক্ষাপটে ত্রিপুরার ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এখানে রাজাদের কীর্তি কাহিনী নির্ভর কাব্যগাঁথা 'রাজমালা' রচিত হয়েছে বাংলাতে।রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায় হয়েছে পুরাণ চর্চাও। সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্দ্ধে ত্রিপুরার রাজা গোবিন্দ মানিক্য বাংলাতে অনুবাদ করিয়েছিলেন বৃহন্নারদীয় পুরাণ। সুদূর অতীত কাল থেকেই ত্রিপুরার রাজকার্যে বাংলার ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়।এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী পঞ্চদশ শতকে ত্রিপুরার রাজা রত্ন মানিক্য প্রথম মুদ্রা প্রচার করেছিলেন।সেই মুদ্রাতেও বাংলা অক্ষর দেখা গেছে।মুদ্রার মতো এরকম ত্রিপুরার প্রাচীন শিলালিপি আর তাম্র ফলকেও ছিল বাংলা লিপি।রাজকার্যে বাংলার ব্যবহার এবং বাংলা কাব্য চর্চায় রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি ত্রিপুরার রাজা সহ রাজপরিবারের সদস্যরাও বাংলা সাহিত্যের চর্চা করতেন। ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য(১৮৬২-৯৬খ্রী:) ছিলেন সে যুগের একজন সুবিখ্যাত বৈষ্ণব কবি।শুধু সাহিত্য চর্চা কিংবা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা নয়,রাজকার্যে বাংলা ব্যবহারের ধারা যাতে কোনও ভাবেই ব্যাহত না হয় সেজন্যও রাজা মন্ত্রীকে সতর্ক করে দিয়েছেন। বীরচন্দ্রের পর রাজা হলেন তাঁর পুত্র রাধাকিশোর। তখন রাজ প্রশাসনে বাড়তে থাকে ইংরেজির প্রভাব। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে রাজা মন্ত্রীকে লেখেন-"এখানকার রাজভাষা বাংলা।বাংলাতেই সরকারী লিখাপড়া হওয়া সংগত।..."
এই ভাবে সুদূর অতীত কাল থেকেই প্রান্তীয় রাজ্য সমূহে কেন সাহিত্য চর্চা ও রাজকার্যে বাংলার ব্যবহার চলে আসছিল তা আজকের দিনে নিঃসন্দেহে আরো বিস্তৃত আলোচনার অপেক্ষা রাখে।কোচ নৃপতি আহোম রাজাকে পত্র লেখেন বাংলায়,আরাকান রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত হয় বাংলা কাব্য,কাছাড়,জয়ন্তিয়া কিংবা ত্রিপুরার রাজা বাংলাতে কাব্য চর্চা করেন।কেন সেদিন প্রান্তীয় রাজ্য সমূহে বাংলার প্রতি এই আকর্ষণ ছিল? এই ধারণা মোটেই অসঙ্গত নয় যে এইসব রাজ্যে অতীত কাল থেকেই ভালো পরিমানে বাঙালি বসতি ছিল। তা না হলে রাজকীয় স্মারক মুদ্রা,শিলালিপি,মোহর,স্ট্যাম্প ইত্যাদি বাংলাতে হবে কেন?কেনই বা পাখির পালকের ডগায় ঝরে পড়েছিল বাংলা ভাষার মমতা?