"সংযমের অভাবে সাহিত্য অকালে ঝরে যায়।"
সৌম্যদীপ দেব
উত্তরপূর্বাঞ্চলের নিজস্ব কথাস্বর যাঁর বয়ানে বারংবার আন্দোলিত হয়েছে, এই অঞ্চলের গল্প-উপন্যাস নিয়ে ভিন্নতর জিজ্ঞাসা তাঁকে সকলের মধ্যে রেখেও বিশেষ করে তুলেছে। কথাসাহিত্যের কানাগলি হয়ে ইতিহাস পুনরুদ্ধারে পারদর্শিতার নজির গড়েছেন ইতিপূর্বেই। আজ লেখক-গবেষক সৌম্যদীপ দেবে'র সঙ্গে মুখোমুখি আলাপচারিতায় অমর্ত্য দাস।
অমর্ত্য : শুরুতেই আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, এই ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দেওয়ার জন্য। প্রথমেই যেটা জানতে চাইবো যেকোনও একজন সফল লেখক হয়ে ওঠার পেছনের প্রস্তুতি পর্বটি কেমন? আমরা যতদূর জানি বাংলা সাহিত্যের অনেক বিখ্যাত লেখকের সান্নিধ্য আপনার ঘটেছে কিংবা যোগাযোগ আছে। তা আমাদের যদি একটু বলেন।
সৌম্য : দেখুন যেকোনও সাধনার জন্য আরাধ্য বিষয়ের পূর্ব উপলব্ধি, সংযম ও আত্ম-জিজ্ঞাসা প্রয়োজন। সাহিত্য সাধনার বিষয়। এখানে সকলেই সাধক, মাতব্বর হলে সাহিত্য করা যায় না। যেকোনও একটা ক্লাসিক উপন্যাস পড়ার আগে সেই সম্পর্কিত পাঠ অভিনিবেশ যেমন প্রয়োজন হয়, তেমনি লেখালেখির সফলতার পূর্ব প্রেক্ষাপট নির্মাণ হওয়ার জন্য সময় খরচ করতে হয়। যেকোনও লেখকই প্রথমে একজন পাঠক, তারপর তিনি লেখক। যে লেখক যত বেশি পাঠ করেন সেই লেখকের পাঠ রচনার ধার এবং ভার দুটোই ততোধিক বেশি। উপযুক্ত সময়ের জন্য লেখককে অপেক্ষা করতে হয়। এমনও কবিকে আমি দেখেছি যিনি দশ বছর কবিতার সাধনা করার পর তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। এইযে অনন্ত অপেক্ষা তা নিজেকে গড়ে নেওয়ার। বলি নির্মাণ পর্ব। এখনকার লেখক-সাহিত্যিকদের (বেশিরভাগ) মধ্যে আপনি দূরবীন দিয়ে খোঁজ করলেও এহেন সংযম পাবেন না! সংযমের অভাবে সাহিত্য অকালে ঝরে যায়। এখন লেখার আগে প্রকাশ পাত্র ঠিক হয়ে যায়!
অমর্ত্য : আপনার প্রথম দিককার গল্পে মৃত্যুচেতনা একটা বড়ো ফ্যাক্টর হিসেবে উপস্থিত ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে জীবনের ভিন্নতর উদ্ভাস আপনার আখ্যানবিশ্বকে বর্ণময় করে তুলেছে। — বেশকিছু সিরিয়াস ও বাণিজ্যিক পত্রিকাতে আপনার গল্প প্রকাশিত হচ্ছে নিয়মিত। বিষয়ের অন্তরে প্রাণসঞ্চার নিয়ে কী বলবেন?
সৌম্য : হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। সকলেই বলেন প্রবন্ধ সাহিত্যের লোক। কিন্তু প্রবন্ধে যা বলতে পারিনি তা ছোটগল্পে অনায়াসে বলা যায়। এইজন্যই গল্পে এসেছিলাম। মৃত্যুচেতনা আমার বেশকিছু গল্পে বারবার ফিরে ফিরে এসেছে। জীবনে মৃত্যুকে খুব কাছথেকে দেখেছি। আমার বহু স্বজন অকালে একা করে দিয়ে চলে গেছেন, হয়তো তারই পরোক্ষ প্রভাব।
প্রত্যেক সার্থক গল্পের ভিতর একাধিক গল্পের বীজ থাকে। তা দেখার জন্য একটা আখ্যান-মন দরকার। চেষ্টা করি আমার গল্প যাঁরা পড়েন বা পড়বেন তাঁদের নতুন কিছু দিতে। তথাকথিত গল্প লেখায় আমি বিশ্বাসী নই। দেশভাগ, দলিত, সন্ত্রাস, নারীমনের ভিন্ন আলাপন, মনস্তত্ত্ব, প্লট থেকে আঙ্গিক নিরীক্ষা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখতে গিয়ে আখ্যানের অন্তরে গল্পের বীজটিকে কখনও দোআঁশ মাটি আবার কখনও বেলে মাটিতে বপন করতে হয়েছে। যখন যে মাটিতে বীজ দিয়েছি সেই মাটিই আমার গল্পে প্রাণ প্রতিমার গড়ন দিয়েছে। আখ্যান নিজেই নিজের কায়া তৈরি করে, চরিত্রেরা ক্রিয়া সিদ্ধি করে, লেখক উপলক্ষ মাত্র। আরোপিত কিছু গল্পে মানায় না।
অমর্ত্য : কখনও কী এমন মনে হয়েছে যে, লেখা (গুণমান সম্পন্ন) তৈরির চেয়ে কোনও প্রকাশক যেন বিপণনে বেশি মনোযোগী?
সৌম্য : বহুবার এমন দৃশ্যের জন্ম দেখেছি অন্য কারও বেলায় বিভিন্ন কার্যকারণে। কনটেন্ট তৈরির আগে মার্কেটিং চেইন নিয়ে কী অসম্ভব ওঠাপড়া। দেখে নিজেই অনুতপ্ত হয়েছি! ভাবতে বাধ্য হয়েছি, এই লেখা তার এই গতি! কনটেন্ট গৌণ হয়ে ধনলক্ষ্মী যখন মুখ্য হয় তখন সেই সাহিত্যকে আপনি আর পাঁচটা বাজারী পণ্যের সঙ্গে তুলনা করতেই পারেন। সাহিত্য পণ্য নয়, একটা অংশ সাহিত্যকে তার সম্ভ্রম নিলামে তুলে বাজারের খোলা রাস্তায় নামিয়ে এনেছে। আর এই সাহিত্য দেখে কেউ যদি বলে 'সাহিত্য তোর সম্ভ্রম কোথায়?' উত্তরে সাহিত্য নির্বাক।
অমর্ত্য : আপনার কয়েকটি বই মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বেশ নন্দিত হচ্ছে। — আমাদের জিজ্ঞাস্য এখানে ভিন্ন। এইযে লেখকরা মুক্তকণ্ঠে বলে চলেছেন বাংলা সাহিত্যের পাঠক তৈরি হচ্ছে না! এটা কতটা সত্য? না-কি অনেক ভাল লেখা মনস্বী পাঠক অবদি গিয়ে ঠিকঠাক পৌঁছুতে পারছে না? পাঠক তৈরিতে শুধুই কী প্রকাশকের দায়, লেখকের কোনও দায়বদ্ধতা নেই?
সৌম্য : দেখুন লেখকের নাম ভেজে বহু খাজা লেখাও বিক্রি হয়। আবার মৌখিক প্রচারে অনেক কাঁচা লেখাও প্রচুর কাটতি পায়। শুধু বিক্রির নিরিখ ধ্রুপদী সাহিত্যের শেষ কথা নয়। অনেক ভাল লেখাও অনেক সময় পাঠকের অভাবে পড়ে থাকে৷ বুঝতে হবে এর বৈষয়িক গুরুত্ব। কেনো এই গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটকটি এই সময়ে প্রয়োজন? কোথায় এর কালোত্তীর্ণ হওয়ার দাবি? সময়কে ছাড়িয়ে ভিন্ন সময়ে যে লেখা প্রাসঙ্গিক সেই লেখাকে পাঠল অবহেলা করতে পারে না (অবশ্য এমন উপেক্ষার নজিরও আছে)। সময়কে যে লেখা যতবেশি নিজের মধ্যে রাখতে পারে, সেই লেখা সেই সময়কে বহন করে, প্রতিনিধিত্ব করে।
না, এটা একেবারেই সত্যি নয়। অন্তত আমি বিশ্বাস করি না। পাঠক তো সবাই। কে পাঠক নন? যিনি বাজার থেকে আনা চিনির ঠোঙাটা পড়ছেন তিনিও পাঠক, যিনি দৈনিক খবরের কাগজটা পড়েন তিনিও পাঠক, যিনি অফিসের কাজে কাগজপত্র পড়েন তিনিও পাঠক। হ্যাঁ, পাঠকের রকমফের আছে। একটা সময় ছিল অবসর বিনোদনের জন্য খুব বেশি উপাদান ছিল না। তখন মোটামুটি সম্ভ্রান্ত সকল বাড়িতেই বইপত্রের জন্য একটা ঘর দেখা যেতো। কিংবা বিছানায় বালিশের পাশে উপন্যাস, কবিতার বই সে-সব নতুন কিছু নয়। বাড়ির মেয়ে-বউরা যাঁরা লেখাপড়া জানত তাঁরাও নিঝুম দুপুরে বইয়ের সঙ্গ নিতো। কিন্তু সময় বদলে গেছে। চাইলেও সেই ফেলে আসা দিনের কাছে ফেরার পথ বন্ধ।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিনোদনের নানা মাধ্যম সহজলভ্য হয়ে গেছে। ফলত এই আকস্মিক মন্তব্য। এখনকার সময়ে ই-বুক, ইন্টারনেট, অডিও স্টোরি, পডকাস্ট কত কত মাধ্যমে দৃশ্য ও শ্রব্য উপাদান লভ্য হয়েছে। তাই এই প্রজন্ম পড়ে না, তা বলা একেবারেই অনুচিত। বরং এটা বলা শ্রেয় পাঠ পদ্ধতিতে বদল এসেছে অনেকানেক। পাঠক ঠিকই তৈরি হচ্ছে, তাঁরা ভাল লেখার খোঁজখবরও রাখে। তবে হ্যাঁ লেখক, প্রকাশক ও পাঠক সম্মিলিত প্রয়াসেই গুণমান সম্পন্ন লেখাকে আরও বেশি করে 'প্রান্ত' থেকে 'কেন্দ্রে'র কাছে নিয়ে যেতে হবে তা কারও একক প্রাপ্তির জন্য নয়, বরং করতে হবে বাংলা সাহিত্যের অনাগত ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করেই।
অমর্ত্য : 'ভিন্ন ভাষার লেখালেখি পাঠ না হলে সীমাবদ্ধতা বাড়ে। আত্তীকরণের সুযোগ কমে যায়।' — আপনিও কি এটাই মনে করেন? ত্রিপুরায় অনুবাদ সাহিত্যের বর্তমান গতিপ্রকৃতি কীরূপ?
সৌম্য : অনুবাদের কথা বলছেন! অনুবাদক কোথায়? কাঁরা করবে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ? হাতেগোনা কয়েকজন আছেন এই কর্মটিকে অল্পবিস্তর প্রাণবায়ু দিয়ে রেখেছেন। অনুবাদের একটা নিজস্ব ধারা আছে, কিন্তু তা ত্রিপুরায় অসম্ভব ক্ষীণ। ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ সুবর্ণজয়ন্তীর দোরগোড়ায়, কিন্তু আজ অবদি ত্রিপুরা একটা তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ পায়নি। হিন্দি ভাষার যাঁরা এখানে অধ্যাপনা দিতে আসেন, বেশিরভাগের এই পার্বত্য মাটির দায় তাঁদের নেই। রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য বিভাগ ছেড়েই দিন, যে রাজ্যে প্রায় ৭০ % মানুষ বাংলাভাষী সেখানে বাংলা বিভাগ আজ পর্যন্ত হল না!
'হাচুক খুরিঅ'র অনুবাদ 'পাহাড়ের কোলে' যে গভীরতায় গিয়ে হয়েছিল তা দ্বিতীয়বার ত্রিপুরায় আর হবে না। হবার মতো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এখানে মৌলিক কাজ বেশি হয়, অনুবাদের দিকে ঝোঁক কম। আমি আগেও বিভিন্ন বক্তব্যে বলতে চেষ্টা করেছি কোনও অঞ্চলের বা কোনও ভাষার অনুবাদ ও সমালোচনা সাহিত্য দুর্বল হলে তা সেই অঞ্চল বিশেষের সাহিত্যের জন্য অন্যতম প্রধান অন্তরায়।
গতবছর (২০২২ সালে) রাজ্যের এক বর্ষীয়ান কবির সঙ্গে এনিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে আমাদের কয়েকজনের। তিনি অবশ্য আমায় এ-বিষয়ক কিছু দায়িত্ব নিতে আবদার করেছেন, আমি ভাবনাচিন্তায় রেখেছি। হয়তো 'ত্রিপুরা ট্রান্সলেটর ফোরামে'র জন্ম হবে। কিন্তু এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও অভিমুখ কতটা উজ্জ্বল তা এখুনি বলা সমীচীন হবে না। অনুবাদের মধ্য দিয়ে এক ভাষা থেকে অন্য ভাষার মধ্যে যে আদান-প্রদান হয় এতে সামঞ্জস্য বিধানের পাশাপাশি, ভাষা-সংস্কৃতি-যাপন প্রণালীর পরিমন্ডল ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। চাইলাম আর অনুবাদ করে নিলাম এটা অনুবাদ নয়, এটা আবেগ। যে বিষয়ক লেখার অনুবাদ হবে তার অর্থগত, ভাষাগত, বিন্যাসগত, শ্রেণিগত দিক বিবেচনা করতে হয়। কোন অর্থে শব্দটি ব্যবহার হচ্ছে তা বুঝে অনুদিত করতে হয়। আরও সচেতন থাকতে হয় মূল ভাষা ও অনুদিত ভাষার মাঝখানে তৃতীয় কোনও ভাষা চলে এলে মূল লেখার মেজাজ নষ্ট হবার সর্বাধিক সম্ভাবনা থাকে। এটা বলতে দ্বিধা নেই, বাংলা অনুবাদের ধারাটি শুধু উপেক্ষিত নয়, সমানভাবে অবহেলিতও।
অমর্ত্য : ছোটগল্পে ফর্ম, প্লট, বয়ন রীতি, নিরীক্ষা নিয়ে ইদানীং অনেক কাজ হচ্ছে। আমরা শুনেছি ছোটগল্পের এই পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে কেন্দ্র করে আপনার একটি কাজ প্রকাশকের টেবিলে আছে। এবিষয়ে আপনার পাঠকদের উদ্দেশ্যে যদি কিছু বলেন।
সৌম্য : হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। গর্ভকালের কথা গর্ভসঞ্চারের আগে বেশি বলতে নেই। ত্রিপুরার শুধু নয় বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ কবিদের একজন শ্রী পল্লব ভট্টাচার্য বিষয়টি নিয়ে আমায় কাজ করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন অত্যন্ত স্নেহ ও আশা নিয়ে। আমি হয়তো তাঁর আশার মান রাখতে পারব। কথাসাহিত্যিক শ্রী দুলাল ঘোষ ভীষণভাবে সাহায্য করেছিলেন এই সংকলন তৈরির জন্য। এবারে পাঠকের হাতে যাওয়ার পালা। ভিন্ন রীতির সব গল্প। বাংলা সাহিত্যে এমন কাজ একেবারেই বিরল এটুকু বলতে পারি। খুব শীঘ্রই আসবে 'ত্রিপুরার ছক ভাঙা গল্প'।
অমর্ত্য : তন্ত্র-মন্ত্র, সাধনা, ভৌতিক ফিকশন কী বাংলা সাহিত্যকে গ্রাস করছে? আমরা জানি লেখক সৌম্যদীপ দেব একজন অভিনিবেশ সম্পন্ন পাঠক। কী বলবেন? ট্র্যাশ লেখার সংখ্যা কী দিনদিন কেবল বাড়ছে?
সৌম্য : আপনি রবীন্দ্রনাথের 'জীবিত ও মৃত'কে কী ট্র্যাশ বলতে পারবেন? না তো। বিশ্ব সাহিত্যের বহু নামজাদা লেখক ভৌতিক-অলৌকিক নিয়ে লিখেছেন। তাতে অসুবিধার তো কিছু দেখছি না। এমনকি গ্রাস করার মতো কোনও পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। ফিকশনের বহু টাইপ আছে, একেকজন একেক টাইপে কাজ করবেন এটাই তো শ্রেয়। একই সময়ে প্রতিটি ভাষার সাহিত্যে দুটি ধারা সামানে চলে, একটি অপরটির পরিপূরক যেমন নয়, তেমনি ক্ষতিকারকও নয়। তবে এটা তো অস্বীকার করা যায় না মূলত গত দুই দশকে বিভিন্ন জঁর সাহিত্য নিয়ে তুলনামূলকভাবে কাজ বেশি হচ্ছে। এটাও মনে রাখার কথা একটা যুগের হয়ে পাঁচ-দশ জনের বেশি কবি-সাহিত্যিক পাঠক মনে বেঁচে থাকেন না সাধারণত। ফলত যা-ই লেখা হোক পাঠক ঠিক জারণ-বিজারণ করে নেবে।
এখনকার একটা বই মনস্বী পাঠক দ্বিতীয়বার আর পড়ে না। মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ,শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, নজরুল, জীবনানন্দ, মানিক, সুকান্ত কেন এই প্রজন্মের কাছেও বহুল চর্চিত? ভাবতে হবে এখনকার লেখকদের। জীবীতের চেয়ে প্রয়াত লেখকরাই আজও বাংলা বইয়ের বাজার ধরে রেখেছেন তা স্বীকার করতে হবে।
অমর্ত্য : সমালোচকরা ইদানীং খুব বলেন 'বিষয় বৈচিত্র্যে বাংলা সাহিত্য যথেষ্ট পিছিয়ে বিশ্ব সাহিত্যের তুলনায়।' — আপনি নিজেও কথাসাহিত্যের পাশাপাশি সমালোচনা সাহিত্যে অবদান রেখেছেন। কী বলবেন এই মন্তব্যের সত্যতা নিয়ে?
সৌম্য : সমালোচকদের এই মন্তব্যটি নস্যাৎ করে দেওয়া যায় না — আংশিক হলেও সত্যতা রয়েছে। সমকালকে তো বিচার করা যায় না। উত্তরকালে এর মূল্যায়ন হয় পাঠকের কাঠগড়ায়। এপিস্টোলারি কাঠামো, চতুর্থ বিশ্বের নাগরিক, আঞ্চলিক সংস্কৃতির গোড়ায় বিশ্বায়নের বেনোজল, মানুষের মধ্যেকার স্থিতিশীল সম্পর্কের পারদে এই-যে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের নাম করে নিউক্লিয়াস পরিবারের ধারণাকে ছাড়িয়ে ক্রমশ একা হওয়া, একা বাঁচার যে তাগিদ তৈরি হচ্ছে — এসব-ই উপাদান হতে পারে। শুধু বিষয় বৈচিত্র্য নেই বললে তো হবে না। আনার যে চেষ্টাটুকু হচ্ছে তা-ও তো দেখতে হবে। শিবাশিস মুখোপাধ্যায়ের 'কাহ্ন', রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের 'ধনপতির সিংহল যাত্রা', স্বপ্নময় চক্রবর্তীর 'চতুষ্পাঠী', অনিতা অগ্নিহোত্রীর 'লবণাক্ত', পাপড়ি রহমানের 'বয়ন', প্রীতম বসুর 'প্রাণনাথ হৈও তুমি' সুতপা দাসের 'সোনার দুয়ারী ঘর রূপার দুয়ারী ঘর', 'নিশি অন্ধারী', শ্যামল বৈদ্যের 'উজানভাটি', 'বনফড়িংয়ের ডানা', দীপক ভট্টাচার্যের 'কলশীমুখের উপকথা' প্রভৃতি বাংলা সাহিত্যে শুধু বিষয়ের বৈচিত্র্য নয়, নবনির্মিতিরও দাবিদার।
অমর্ত্য : শতবর্ষে ত্রিপুরার কথাসাহিত্যের এই সন্ধিক্ষণে শতাব্দীর কথাসাহিত্য চর্চা নিয়ে আপনার বেশ কয়েকটি কাজ প্রকাশিত হয়েছে। একবার যদি বলেন সেই কাজগুলো করার অনুভব।
সৌম্য : যতক্ষণ না প্রকাশ হচ্ছে ততক্ষণই আমার দায়। প্রকাশ হয়ে গেলে পাঠকের, পাঠোদ্ধারের দায়। ত্রিপুরা আজও এমন প্রত্যন্ত অঞ্চল এখানে শতবর্ষ নিয়ে উদযাপনের আয়োজন হয় না। বসন্ত আসে আবার কেমন মিলিয়ে যায়, কোনও উত্তেজনা নেই। একটা অঞ্চলের কথাসাহিত্য চর্চার শতাব্দী পূর্ণ হচ্ছে, অথচ একটা আয়োজন, একটা আলোচনা সভা, একটা সেমিনার দেখেছেন? পাবেন না। স্ব-স্বীকৃতি দেওয়ার মানসিকতা এখানে বড্ড বিরল৷ শতবর্ষ নিয়ে পাঁচটি কাজ। 'শতবর্ষে ত্রিপুরার গল্প সংগ্রহ' দুই খণ্ডে, ত্রিপুরার উপন্যাসের একশো বছর নিয়ে 'ত্রিপুরার উপন্যাস সমীক্ষা' প্রথম খণ্ড আগেই বেরিয়েছে, দ্বিতীয় খণ্ড আসবে। আর 'শতবর্ষে ত্রিপুরার কথাসাহিত্য'। সবকটাই পাঠক মহলে ভাল সাড়া পেয়েছে। পাঠকের দরবারে স্বীকৃতির থেকে বড় কোনও পুরস্কার হয় না৷
অমর্ত্য : সময়ের কথাভাষ্য দ্রুত সমাজ মানুষের সামনে তুলে ধরার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্প হল নাটক, যে কথা সাধারণত বলার সুযোগ হয় না বা বলা যায় না, নাটকে তা অনায়াসেই বলা যায়। নাটক এমনই এক শিল্পরূপ — ত্রিপুরায় নাটক চর্চা নিয়ে কতটা কাজ হয়েছে?
সৌম্য : ত্রিপুরার নাটক বলতে হলে খোয়াইয়ের কথা বলতে হবে। খোয়াই আমার জন্ম মাটির শহর। পথনাটক, গণনাটক একের পর এক অসাধারণ সব পারফরম্যান্স। এখন খোয়াইতে নাটক অতটা হয়তো হয় না। কিন্তু খোয়াইয়ের শিরায় শিরায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে নাটক বেঁচে আছে। 'সাদা পায়রার জন্য', 'দেব না তিতুন', 'রাইমা সাইমা' প্রভৃতির মতো নাটক তো ত্রিপুরার আইডেনটিটি। কত কত মঞ্চ সফল নাটক দিয়েছেন ত্রিপুরার নাট্যকারেরা। প্রচুর ভাল কনটেন্ট এখানে আছে। কিন্তু অভাব যেটা তা হল নাটক নিয়ে আজ পর্যন্ত আনখশি একটা সিরিয়াস গবেষণা গ্রন্থ যা আকর হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে তা করতে কেউ এগিয়ে এলো না (যেগুলো আছে তা 'সম্পূর্ণ' বলা যায় না)। একটা বড় গবেষণা কাজ হওয়া খুব দরকার এবং সুযোগ রয়েছে।
অমর্ত্য : রাজনৈতিক আনুকূল্যতা লেখকের জনপ্রিয়তার মাপকাঠি হতে পারে। তবে কী রাজনীতি প্রত্যক্ষে বাংলা সাহিত্যের অলিন্দে রাজ করে? কী মনে হয় আপনার?
সৌম্য : আমি রাজনীতির লোক নই, রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা এবিষয়ে বিশদে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বলতে পারবেন। তবে লেখক সাহিত্যিকদের কেউ কেউ রাজনীতির রঙটা যত্নের সঙ্গে লালন করেন। ব্যক্তিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে। রাজনীতিকে হাতিয়ার করে মঞ্চ-পুরস্কারের বাসনা তৃপ্ত করতে। সাহিত্যিক নেতা হয়ে মাতব্বর হতে। সিরিয়াস সাহিত্যের মহলে চিরকাল এইসব রাজনৈতিক রঙধারী সাহিত্যিকরা ব্রাত্য।
অমর্ত্য : পাঠকের পাতে সম্পাদিত লেখার চেয়ে ইদানীং অসম্পাদিত লেখাই বেশি পরিবেশিত হচ্ছে। এতে সাহিত্যের সিরিয়াস পাঠক কী বিরক্ত না-কি এই সম্পাদনা হীনতাকেই বেশ উপভোগ করছেন? কী বলবেন?
সৌম্য : আপনি আম আর আম্রাকে এক বাটখারায় তুলতে পারবেন না। লেখা বেশি হোক প্রচার হোক তাতে অসুবিধা নেই। লিখতে লিখতেও শাণিত হয়। আগেও বলেছি, বহু লেখার ভিড়ে ভাল লেখাটি উপযুক্ত পাঠকের নজর যেন এড়িয়ে না যায়। মুখোবইতে লিখছে, এগুলোই আবার প্রকাশকের কাছে ছাপতে নিয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ — লেখালেখিতে সম্পাদনা বলে একটা বিষয় আছে এটা কোনও কোনও লেখক আত্মগরিমায় ভুলে যান। এনারা কুয়োর ব্যাঙ হয়ে পৃথিবীর পাঠ না নিয়ে নিজের লেখাকেই পৃথিবীর একমাত্র শ্রেষ্ঠ লেখা ভাবেন৷ লেখাকে রোদে দিতে হয়, চোখের আড়াল করতে হয়। এ-সবের কিছুই নেই। বেশকিছু লেখা একত্র করে ছেপে দিলাম এটা তো সম্পাদনা নয়, শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্য আজকালকার বেশিরভাগ লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক (ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছেন) সম্পাদনা বলতে এটাই বোঝেন৷ স্বাভাবিকভাবেই ওইসব ম্যাগাজিনের সারস্বত ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হওয়াটাও অভিপ্রেত!
প্রকাশ নিয়ে এতো তাড়া কীসের! কোথাও কী তাঁদের মধ্যে আত্ম প্রকাশের সংকট তাড়া করছে? প্রকাশক টাকার বিনিময়ে হাত পেতে বসে থাকলে ভাল পাণ্ডুলিপি পাবেন কোথায়? পাণ্ডুলিপি নির্বাচন আজকাল বহু প্রকাশকই (সকলে নয়) আর গুরুত্বের সঙ্গে করেন না। শিল্পে আজকাল শিল্পসুষমার চেয়ে ধনলক্ষ্মীর কদর বেশি।
অমর্ত্য : আমরা দেখেছি কথাসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক ধরে ধরেও আপনি কিছু কাজ করেছেন৷ এটা যেমন একটা দৃষ্টান্ত তেমনি উত্তর প্রজন্ম হিসেবে আপনার দায়বদ্ধতার নজির। আগামীদিনে আর কাঁদের নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে?
সৌম্য : বেশকটা তো হল। কথাসাহিত্যিক অরুণোদয় সাহা, উত্তরপূর্বের গুরুত্বপূর্ণ কথাকার দুলাল ঘোষ, ঔপন্যাসিক শ্যামল বৈদ্যকে নিয়ে তো করলাম৷ যেসকল লেখক সমসময়ে প্রাসঙ্গিক হয়েও ব্রাত্য, যাঁদের অবদান বাংলা সাহিত্যকে ঐশ্বর্যময় করেছে — তাঁদের নিয়ে আরও করার ইচ্ছে আছে। পরবর্তী কাজ কাকে নিয়ে করছি এখন বলবো না।
অমর্ত্য : আপনার জন্ম শহর খোয়াই। খোয়াই নদীর বুক আপনার যৌবন-সন্ধ্যা। সংস্কৃতির শহর, নাটকের শহর খোয়াই। খোয়াই আপনাকে কতটা সম্মান দিয়েছে?
সৌম্য : হ্যাঁ, খোয়াই! কিন্তু এই খোয়াই আমায় চেনে না, স্নেহভরে ডাকে না। অন্য সংস্কৃতজনেরা সেখানে সমাদর পান৷ এই খোয়াইয়ের প্রতি আমার কোনও দায়বদ্ধতা নেই, এই খোয়াইতে আমার কোনও সাংস্কৃতিক শেকড় নেই৷
অমর্ত্য : উত্তরপূর্বের বাংলা উপন্যাস নিয়ে নিরন্তর কাজ করে চলেছেন। সে-সব কাজ যথেষ্ট প্রশংসিতও হচ্ছে। কিন্তু কখনও কী মনে হয়েছে এই অঞ্চলে নভেলে'র চেয়ে নভেলেটে'র চাষ বেশি হয়?
সৌম্য : হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। উত্তরপূর্বের আখ্যানের বাগানে নভেলেটের ফলন খুব ভাল হয়। আখ্যানের 'উপন্যাস' হিসেবে উত্তরণ হওয়ার পথটা মসৃণ নয়। অমসৃণ পথকে যে-সব ঔপন্যাসিক শিল্পের দাবি মেনে মসৃণ করতে পেরেছেন আখ্যান তাঁদের হাতে 'উপন্যাস' হয়ে উঠেছে। উত্তরপূর্বের বাংলাভুবনে 'উপন্যাস' ও 'উপন্যাসিকা' নিয়ে বিস্তর দ্বন্দ্ব রয়েছে। সমালোচনা সাহিত্য গড়ে না ওঠার জন্যই প্রধানত এই দ্বন্দ্ব। চাষ বেশি কী বলছেন, বলুন প্রচুর, অগুনতি। যা ফলে তার বড়ো অংশ তো নভেলেট। একমুখী, আত্মগদ্য। সার্থক উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য নভেলেটের মধ্যে অন্বেষণ করা, আর অন্ধকার ঘরে কালো বেড়াল খোঁজা সমান কথা।
অমর্ত্য : কয়েকজন পছন্দের ঔপন্যাসিকের নাম জানতে চাই।
সৌম্য : অপছন্দের কেউ নেই। আমি খুব সিলেক্টিভ। সব পড়ি না, পড়তে চাইও না। ভাল উপন্যাস যেকেউ লিখবেন, আমি পড়তে রাজি। ওরকম ধ্বজাধারী পাঁচ-ছয়জনের দিকে বিস্ফারিত হয়ে চেয়ে থাকব তা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ।
অমর্ত্য : লোকগান আপনার আরোগ্যলাভ। কাঁদের কণ্ঠ বেশি পছন্দ?
সৌম্য : অনেকেরই গানই শুনি যখনই সময়-সুযোগ হয়। কালিকা প্রসাদ, শামসুল হক চিশতী, কাঙালিনী সুফিয়া, শফি মন্ডল আরও অনেকেই আছেন, এই মুহূর্তে সবার নাম মনে পড়ছে না। বেশ কয়েকটা ফোক ব্যান্ডও আমি শুনে থাকি।
অমর্ত্য : আপনার কাছে সর্বশেষ প্রশ্ন, নতুন কী কী কাজ করছেন? আপনার পাঠক জানতে চায়।
সৌম্য : সবগুলোর কথা বলতে পারবো না। একটা বলি, দেশভাগ নিয়ে একটা কাজ কমপ্লিট অনেকদিন। এখন প্রকাশকের হাতে আছে। উত্তরপূর্বে একাজ এই প্রথম৷ পাঠকের হাতে চলে যাবে খুব শীঘ্রই।