পূর্বোত্তরে মোগল প্রতিরোধ ও বীর লাচিত
পান্নালাল রায়
দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে মোগলরা প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল।সপ্তদশ শতকের বিভিন্ন সময়ে মোগলদের সঙ্গে তুমুল লড়াই হয়েছে ত্রিপুরা ও অসমের রাজকীয় বাহিনীর।অষ্টাদশ শতকে মোগলদের বিরুদ্ধে প্রতিবেশী রাজ্য সমূহকে নিয়ে জোট গঠনে উদ্যোগী হয়েছেন অসমের রাজা স্বর্গদেব রুদ্র সিংহ।সপ্তদশ শতকে আসামে মোগল প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছেন বীর লাচিত বরফুকন। এবছর তাঁর চারশত জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে দেশব্যাপী নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন হচ্ছে।
বঙ্গদেশে অধিকার প্রতিষ্ঠার পর পূর্বোত্তরের প্রান্তীয় রাজ্য গুলো নানা সম্পদ সম্ভাবনার জন্য মোগলদের আকৃষ্ট করেছিল।সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকে হস্তী সম্পদের লোভে তারা ত্রিপুরা আক্রমণ করেছিল। শেষপর্যন্ত অবশ্য ত্রিপুরার পক্ষে এই যুদ্ধ সুখকর হয়নি, তবু বশ্যতা স্বীকারের চেয়ে মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাই শ্রেয় মনে হয়েছিল রাজার কাছে। সপ্তদশ শতকের নানা সময়ে আসামের সঙ্গে মোগলদের যুদ্ধ হয়েছে। এরমধ্যে ১৬৭১ সালের সরাইঘাট যুদ্ধ এবং লাচিতের বীরত্বের কাহিনী উল্লেখযোগ্য। এই যুদ্ধে প্রবল পরাক্রান্ত মোগল বাহিনীকে লাচিত বরফুকনের নেতৃত্বে পর্যুদস্ত করেছিল আহোম বাহনী। সেনাপতি হিসেবে লাচিতের উত্থানও চমকপ্রদ। মীর জুমলার আসাম আক্রমণ কালে লাচিত শত্রুসেনার মোকাবেলায় খুবই বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। এরপর রাজা চক্রধ্বজ সিংহ লাচিতকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করেন।মোগল আক্রমণ প্রতিরোধে লাচিতের বীরত্বের কথা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। বিভিন্ন দুর্গ দখল করে তিনি মোগল বাহিনীর মধ্যে ত্রাসের সঞ্চার করেন। এরপর ক্রুদ্ধ ঔরঙ্গজেব আহোম বাহিনীর বিরুদ্ধে এক বিশাল বাহিনী পাঠান রাম সিং-১ এর নেতৃত্বে।এই বাহিনীতে ছিল ৩০ হাজার পদাতিক,১৫ হাজার তীরন্দাজ,১৮ হাজার অশ্বারোহী,৫ হাজার গোলন্দাজ এবং বহুসংখ্যক কামান ও রণতরী। এই বিশাল বাহিনী ঢাকা থেকে আসামের গৌহাটি অভিমুখে ধাবিত হয়। মোগলদের প্রতিরোধে লাচিত বিরাট প্রস্তুতি নেন।যুদ্ধের প্রথম পর্বে রাম সিং-এর নেতৃত্বে মোগল বাহিনী আহোমদের বিরুদ্ধে অগ্ৰসর হতে পারেনি।মোগল সেনাপতি নানা ছলচাতুরির আশ্রয় নেন। কিন্তু সবই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।আহোমদের তুলনায় মোগল বাহিনী অনেক বিশাল ছিল। কিন্তু সেনাপতি লাচিত আহোম বাহনীকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে মোগলদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।১৬৭১ সালের মার্চ মাসে সরাইঘাটে ব্রক্ষ্মপুত্রে সংঘটিত এই যুদ্ধ সরাইঘাট যুদ্ধ নামে খ্যাত। আহোমদের তুলনায় মোগল বাহিনী অনেক বিশাল থাকা সত্ত্বেও তাদের পরাজয় ঘটে সেনাপতি লাচিতের রণনৈপুণ্যে। লোকবল ও অস্ত্রশস্ত্র মোগলদের অনেক বেশি থাকা সত্ত্বেও গেরিলা যুদ্ধ কৌশল সহ লাচিতের যুদ্ধ কৌশলে মোগলরা সেই যুদ্ধে পর্যুদস্ত হয়েছিল। সেনাপতি সেসময়ে অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও সশরীরে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এতে আহোম বাহিনীর সৈন্যদের মনোবল অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল। অসুস্থ শরীরে যুদ্ধ করার জন্য সরাইঘাট যুদ্ধের প্রায় এক বছর পর ১৬৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ এপ্রিল যোরহাটে লাচিতের মৃত্যু ঘটে।আপার আসামের প্রথম বরবরুয়া এবং আহোম বাহিনীর কম্যান্ডার ইন চীফ মোমাই তামুলি বরবরুয়ার কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন লাচিত বরফুকন।১৬২২ সনের ২৪ নভেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন।প্রতি বছর ২৪ নভেম্বর এদিনটি লাচিত দিবস হিসেবে পালিত হয়।এবার লাচিতের ৪০০তম জন্মজয়ন্তী ব্যাপক ভাবে পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। রাজধানী দিল্লিতেও এ উপলক্ষে অনুষ্টানের আয়োজন হয়েছে। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা সম্প্রতি দিল্লিতে বলেছেন, আগামী দিনে লাচিতের বীরত্বের কথা সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে। তিনি বলেন,এন সি ই আর টি'র পাঠ্যসূচিতে লাচিতের জীবনী সন্নিবিষ্ট করার উদ্যোগ যেমন নেয়া হয়েছে, তেমনই প্রতিটি রাজ্য সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়েছে যাতে রাজ্যস্তরের ইতিহাসের সিলেবাসে লাচিতের উপর একটি অধ্যায় সংযোজন করা হয়।
আসামের সরাইঘাট যুদ্ধেরও অনেক আগে মোগলদের হাতে আক্রান্ত হয়েছিল ত্রিপুরা।সম্রাট তখন জাহাঙ্গীর।ত্রিপুরার হস্তী সম্পদের উপর লোভ পড়ল তাঁর। তিনি ত্রিপুরার রাজার কাছে কর হিসেবে চাইলেন কয়েকটি হস্তী ও অশ্ব। কিন্তু ত্রিপুরার স্বাধীনচেতা রাজা যশোধর মাণিক্য (১৬০১-২৩ খ্রীঃ) সম্রাটের প্রস্তাব অস্বীকার করলেন।ফলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠলো।এই যুদ্ধ অবশ্য ত্রিপুরার বিপর্যয় ডেকে এনেছিল।বাংলার সুবাদার তখন ইব্রাহিম খাঁ ফতেজঙ্গ। সম্রাটের নির্দেশে তিনি ত্রিপুরা আক্রমণের বিরাট প্রস্তুতি নিলেন।মোগল স্হল বাহিনীকে দু'ভাগে ভাগ করে ত্রিপুরার দিকে পাঠানো হল। মির্জা ইসফানদিয়ার নেতৃত্বে একটি বাহিনী অগ্ৰসর হলো কৈলারগড় অভিমুখে। মির্জা নূরউদ্দিন এবং মুসা খানের নেতৃত্বে মেহেরকুলের দিকে ধাবিত হল অপর একটি বাহিনী। এছাড়া একজন দক্ষ নৌ সেনাপতি বাহাদুর খানের নেতৃত্বে কুমিল্লা হয়ে গোমতী নদী পথে পাঠানো হল এক বিরাট নৌ বাহিনী।বিশাল মোগল বাহিনী ধেয়ে আসছে জেনেও ভয় পেলেন না ত্রিপুরার রাজা। তিনি মেহেরকুল ও কৈলারগড় দুদিকেই মোগলদের প্রতিরোধে সমর সজ্জা করলেন।ত্রিপুরার সৈন্যগণ প্রাণপণে লড়ে গেলেও বিশাল মোগল বাহিনীর বিরুদ্ধে তারা দাঁড়াতে পারলনা। শোচনীয় পরাজয় ঘটল ত্রিপুরার।রাজাকে বন্দি করে ঢাকা হয়ে নিয়ে যাওয়া হল সম্রাটের দরবারে।এই যুদ্ধে বিপর্যয়ের সূত্রে ত্রিপুরার সমতল অঞ্চলে মোগল আধিপত্যের সূচনা ঘটেছিল।যুদ্ধে ত্রিপুরার পরাজয়ের কারণ হিসেবে অবশ্য অনেকে মোগলদের উন্নত আগ্নেয়াস্ত্রের সুবিধার কথা উল্লেখ করেছেন।ত্রিপুরার বাহিনীতে তখন বন্দুক গোলাবারুদের ব্যবহার শুরু হলেও মোগলরা এ ব্যাপারে অনেক দক্ষ এবং তাদের অস্ত্রও অনেক উন্নত ছিল। তদানীন্তন মোগল সেনাপতি মির্জা নাথান-এর স্মৃতিকথা 'বহরিস্তান-ই-ঘায়েবী' গ্রন্হে ত্রিপুরার এই যুদ্ধের বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে। উল্লেখ্য সেই সময় মির্জা নাথান বাংলাদেশে বেশ কিছু মোগল অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন।১৬১৮ থেকে ১৬২১ সালের মধ্যে কোনো সময়ে ত্রিপুরায় এই মোগল আক্রমণ ঘটেছিল বলে জানা যায়।
পরবর্তী রাজা কল্যাণ মাণিক্যের (১৬২৬-৬০ খ্রিঃ) সময়কালেও ত্রিপুরায় মোগল আক্রমণ ঘটে।রাজা বিপুল বিক্রমে মোগলদের প্রতিরোধ করেন।সেবারও হস্তী সম্পদের লোভেই ত্রিপুরা আক্রান্ত হয়।কৈলারগড়ে শিবির সন্নিবেশ করে রাজা স্বয়ং রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। মোগলদের শিবির স্হাপিত হয়েছিল কমলাসাগরের পশ্চিমে।ত্রিপুরার বাহিনী প্রবল বিক্রমে প্রতিরোধ করে মোগলদের।উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। শেষপর্যন্ত মোগলদের পরাজয় ঘটে। ঐতিহাসিক কৈলাস চন্দ্র সিংহ এই যুদ্ধ সম্পর্কে লিখেছেন,"কল্যাণ মাণিক্যের শাসনকালে বাঙালার শাসনকর্তা সুলতান সুজা ত্রিপুরা আক্রমণ করেন। কিন্তু কল্যাণ মাণিক্যের বাহুবলে মোগলগণ পরাজিত ও ত্রিপুরা পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।" পরবর্তী সময়ে অবশ্য কল্যাণ মাণিক্য মোগলদের কিছুটা বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন বলে কৈলাস চন্দ্র উল্লেখ করেছেন। ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপীয় পর্যটক পিটার হেলস ভারত সফর করেন। তিনি লিখে গেছেন ত্রিপুরার সঙ্গে মোগলদের অনবরত যুদ্ধ লেগে থাকত।ত্রিপুরার পাহাড় পর্বতের জন্য মোগলদের প্রতিরোধ সম্ভব হতো।১৭২৯ খ্রিস্টাব্দে রচিত 'নৌবহর-ই-মুরসিদকুলিখানী' গ্রন্হেও উল্লেখ রয়েছে যে পাহাড় পর্বত আর গভীর অরণ্যের জন্য ত্রিপুরা মোগলদের কাছে দুর্ভেদ্য ছিল।সুজার নির্দেশে মোগল সেনারা ত্রিপুরা অভিযান করে। কিন্তু এক বছর চেষ্টা করেও তারা এই রাজ্যের একটি দুর্গও অধিকার করতে পারে নি।
সপ্তদশ শতকে পূর্বোত্তরে আসাম ও ত্রিপুরার সঙ্গে মোগলদের যেমন যুদ্ধ হয়েছিল তেমনই অষ্টাদশ শতকেও আসামের রাজা স্বর্গদেব রুদ্র সিংহ মোগলদের বিরুদ্ধে প্রতিবেশী রাজ্য সমূহকে নিয়ে এক জোট গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।এই রাজা তখন ত্রিপুরায় রত্নকন্দলী শর্মা ও অর্জুনদাস বৈরাগী নামে দুজন দূত পাঠিয়েছিলেন।দূতদ্বয়ের সঙ্গে তিনি ত্রিপুরার রাজার উদ্দেশ্যে এক গোপন পত্রও পাঠিয়েছিলেন। এই গোপন পত্রে মোগলদের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হবার আহ্বান ছিল ত্রিপুরার রাজার প্রতি।ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তখন মোগল সাম্রাজ্যের ভিত দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই সুযোগে আহোমরাজ রুদ্র সিংহ পূর্ব ভারতকে মোগল শৃঙ্খলমুক্ত করতে চেয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি কোচবিহার, ত্রিপুরা সহ পার্শ্ববর্তী রাজ্য সমূহে দূত পাঠিয়েছিলেন।আহোম রাজা স্বর্গদেব রুদ্র সিংহ নিজের সেনাবাহিনীর শক্তিবৃদ্ধি সহ অস্ত্রশস্ত্রের মজুদ বৃদ্ধি করেছিলেন।কাছাড় ও জয়ন্তিয়ার রাজা সহ অন্যান্য স্হানীয় জনজাতি লোকেরা তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন বলে জানা যায়। মোগল বিরোধী অভিযানে সামিল হতে কাছাড়ের রাজা চৌদ্দ হাজার ও জয়ন্তিয়ার রাজা দশ হাজার সৈন্য পাঠান।সব মিলিয়ে রুদ্র সিংহ চার লক্ষ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী গঠন করেছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত আর আহোম রাজার মোগল বিরোধী তৎপরতা ফলপ্রসূ হয়নি।অভিযানের আগেই ১৭১৪ সালে গুয়াহাটিতে তাঁর মৃত্যু ঘটে। ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছেন এই আহোম রাজা। ভারতের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন সহ সাংস্কৃতিক আদান প্রদানেও উদ্যোগী ছিলেন তিনি।পূর্ব ভারতকে মোগল শৃঙ্খলমুক্ত করতে উদ্যোগের জন্য পরবর্তী কালে আচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁকে আখ্যা দিয়েছিলেন 'পূর্ব ভারতের শিবাজী'।
এই ভাবে সপ্তদশ -অষ্টাদশ শতকের সুদীর্ঘ কাল পূর্বোত্তরে নানা ভাবে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে মোগল বাহিনী। কখনো তাদের জয়লাভ ঘটেছে, কখনো পরাজয়।এই অঞ্চলে মোগল অভিযানকে প্রতিহত করার ক্ষেত্রে উজ্জ্বল হয়ে আছেন লাচিত বরফুকন।এবার তাঁর ৪০০তম জন্মজয়ন্তী উদযাপনে নিশ্চিত তাঁর বীরত্ব,দেশপ্রেম ইত্যাদি নিয়ে আরও চর্চা হবে। নতুন ভাবে ঝিলিক দিয়ে উঠবে আঞ্চলিক ইতিহাসের নানা সুবর্ণ অধ্যায়!