সাব্রুম-এর লুধুয়া চা বাগানের শ্রমিকদের মানবিক আবেদন

বিশেষ প্রতিবেদন

আজ থেকে ৭৫ বছর আগে অক্ষয় কুমার গুহ-এর হাত ধরে রাজন্য ত্রিপুরার দক্ষিণ অংশের প্রত্যন্ত এলাকা সাব্রুম-এর লুধুয়াতে গড়ে তােলা একটি চা বাগানের জমি আজ প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্থানীয় বিধায়ক চা বাগানের শ্রমিকদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা শুরু করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ১৪৪৭ একর জমিতে চন্দ্রাবতী টি কোম্পানির তরফে ১৯৪৭ সালে এই বাগানটি প্রতিষ্ঠিত হয়। অপ্রতুল যোগাযোগ ব্যবস্থা, দুর্ভোগময় পরিবহন পরিকাঠামো স্বত্তেও বীরভূম বাঁকুড়া ও বিহার থেকে ট্রেডিশনাল চা শ্রমিকদের এনে এই বাগানের কাজ শুরু হয়েছিল। সেই সময়ে লুধুয়াতে উৎপাদিত চা গরুর গাড়ি করে সাব্রুম হয়ে ফেনী নদীতে নৌকা করে চট্টগ্রাম নিলাম বাজারে বিক্রি করা হত।

১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর নানা কারণে অক্ষয় বাবু বানানটি চালিয়ে যেতে অনাগ্রহী হয়ে উঠেন। বাগানের পুরহিত ধীরেন্দ্র ভট্টাচার্য কিছুদিন বাগানটি পরিচালনার দায়িত্ব নেন। ১৯৬২ সালে নিরুপায় হয়ে ধীরেন্দ্র বাবু আগরতলা নিবাসী ফনিভূষণ কর- এর কাছে বাগানটি লিজে দিয়ে দেন। ফনিভূষণ কর ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত চালিয়ে রণে ভঙ্গ দেন।

এসময় চরম দুর্ভোগে পড়েন বাগান শ্রমিকরা। বাগান বন্ধ হওয়ায় কাজ খাদ্য না পেয়ে আশেপাশের জোতদারদের খপ্পরে পড়েন। জীবন বাঁচাতে শ্রমিকরা বিনা পারিশ্রমিকে পেটে-ভাতে কাজ করতে বাধ্য হয়। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাগান শ্রমিকরা তৎকালীন মন্ত্রী কালিপদ ব্যানার্জির কাছে কাতর আবেদন জানালেও কোন বিহিত হয়নি। এই সময় তরুণ বামপন্থী শ্রমিক নেতা হারান সরকারের নেতৃত্বে শ্রমিকরা সংগঠিত হতে শুরু করে।

১৯৭৮ সালে রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সাবরুমের মনু বাজারে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তীর সঙ্গে লুধুয়া চা শ্রমিকরা সাক্ষাৎ করেন। ওনার আন্তরিক উদ্যোগে এক মাসের মধ্যে মন্ত্রী বিমল সিনহার উপস্থিতিতে গঠিত হয় লুধুয়া চা বাগান শ্রমিক সমবায় সমিতি। ১৯৭৯ এর ৮ই মে নবগঠিত সমবায়টি রেজিট্রি হয়।

চন্দ্রাবতী কোম্পানির সেই সব মেশিন দিয়ে তখনো কাজ চলছে। নব গঠিত সমবায় নবকলেবরে বাগানে চারা রোপণ, উৎপাদন ইত্যাদি বাড়াতে উদ্যোগ নেয়। লুধুয়া চা বাগানের বিশেষত্ব হল গোটা বাগান অর্গানিক চা উৎপাদনে সক্ষম। এমনকি ১৯৯৭ সালে অর্গানিক সার্টিফিকেট পাওয়ার স্বার্থে সুদূর জার্মানির এক দল বিশেষজ্ঞ দল কে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সব ঠিকঠাক থাকলেও পুরাতন পরিকাঠামো বাদ সাদে।

নতুন ভাবে কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হলেও বাগানের জায়গা চন্দ্রাবতী কোম্পানির নামে থাকার কারণে কোন লোন অনুদান ইত্যাদি পাওয়া যাচ্ছিল না। এই পরিস্থিতিতে বাগানের জায়গা লুধুয়া চা শ্রমিক সমবায়-এর নামে করার উদ্যোগ নেয়া হয়। যেহেতু জায়গার পুরোটা জোত জমি সেই জমি শ্রমিক সমবায়ের নামে করার স্বার্থে এক বিশেষ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে পুরো ১৪৪৭ একর জোতজমি খাস জমিতে রূপান্তরিত করা হয়।

এর মধ্যে ১২৯৭ একর জমি এডিসি এলাকার অন্তর্ভুক্ত। যার মধ্যে ১২৫২ একর জমি ২০০৩ সালে বাগানের নামে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। যার পুরোটা স্বশাসিত জেলা পরিষদ এলাকার মধ্যে। সাধারণ এলাকায় থেকে যায় ১৫২ একর জমি। যা এখনও বন্দোবস্ত হয় নি। অর্থাৎ খাস জমিটা সবটা নিরেট খাস নয়। এটা একটা সমগ্র প্রক্রিয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায়। জমিকে খাস করা হয়েছিল সমবায়ের নামে জোত করার জন্য।

কিন্তু সম্প্রতি সাব্রুম- এর গর্ব লুধুয়া চা বাগানের সমৃদ্ধির প্রশ্নে একে রক্ষা করার বদলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি রাষ্ট্র ক্ষমতার অপব্যবহার করে চা বাগানের জমি অন্য কাজে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন।

অভিযোগ, প্রথমে একলব্য কেন্দ্রীয় ইস্কুল স্থাপনের নামে কিছু জায়গার দখল নেয়া হয়। ভালো উদ্দ্যোগ বলে শ্রমিকরা আপত্তি করেননি। ইস্কুল বাড়ি নির্মাণের জন্য ঠিকেদার চা বাগানের জায়গা সাফ করতে থাকে। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিন রাতের অন্ধকারে চা বাগানের বেশ কয়েক হেক্টর জায়গায় বুল-ড্রজার দিয়ে ফলন্ত চা গাছ নষ্ট করে সমবায়ের অনুমতি ব্যতিরেকে নির্ধারিত জমির অধিক জমির দখল নেওয়া হয়। এতে যেখানে প্রায় ১লক্ষ ৫০ হাজার চারা চা গাছ ছিল এবং মোট ৫৫ থেকে ৬০ হাজার ফলন্ত চা গাছ ছিল। নতুন চারা সহ মোট প্রায় ২লক্ষ চা গাছ এতে নষ্ট হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, এ সবই স্থানীয় জনপ্রতিনিধির ইশারাতে হয়েছে।

শুধু তাই নয়, স্থানীয় জন প্রতিনিধি ব্যাম্বো মিশনকে বেশ কয়েক হেক্টর জায়গা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাছাড়া, শুকরের মাংসের প্রক্রিয়াজাতকরনের একটি প্রকল্পের জন্য বাগানের জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব কোন ক্ষেত্রেই শ্রমিক সমবায়ের অনুমতি ছাড়াই করা হচ্ছে।

অভিযোগ, শুধুমাত্র লুধুয়াতে নয়, আমলীঘাটে ফিসারির একটি প্রকল্প করবে বলে ১৬ দ্রোন জায়গা দখল করার চেষ্টা চলছে। ২০১৮ সালে বিজেপি’র সরকার গঠনের পর পরই ৬ মাসের মধ্যে বিএড (B Ed) কলেজ করবে বলে জায়গা দখল নেওয়া হয়েছে। সার্কিট হাউস করবে বলে এক নিম্ন বিত্ত যুবকের ফলন্ত গাছ গাছালি কেটে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। গত কমাস ধরে সাব্রুমে এপোলো হাসপাতাল হবে বলে প্রচার চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কার মাথায়'যে এজন্য বারি পরে সময়ে জানা যাবে। অথচ সাব্রুমে এস ই জেড হবে বলে বিশাল পরিমাণ জমি নিয়ে রাখা হয়েছে। প্রকল্পের কাজ কিছুই এগুয়নি। এভাবে নানা ধরনের প্রকল্পের নামে প্রচার চালানো হচ্ছে। এরকমই সাব্রুম-এর আমলীঘাটে একটি আনারস বাগানের নামে পাচ কোটি টাকার মন্জুরীর প্রচার করা হয়েছিল। কিন্ত ৫ কোটির কোন খবর নাই। এই অবস্থায় স্বাভাবিক ভাবেই লুধুয়া চা বাগানের জমি জবর দখল নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন বাগানের শ্রমিকরা। চা বাগানের জমি সুরক্ষিত রাখতে তারা শুভ বুদ্বিসম্পন্ন মানুষের সাহায্য চাইছেন ।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.